“Dogs and Indians not allowed” ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবের দরজায় টাঙানো সেই বিভেদকামী সাইনবোর্ড আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে বর্তমান ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে। শুরু হয়েছে ভারতবাসীকে তার মাতৃভূমি থেকে বের করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত। ভারতীয়রা আজ যেন নিজে ভূমে পরবাসী। প্রশাসনিক স্তরে আসছে নির্মম গেরুয়া ফরমান, “Dogs and Anti-bjps are not allowed.” সার্বভৌম, গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক। ধর্মনিরপেক্ষতার লাশের ওপর ডিক্টেটরশিপের মরণকূপ গড়ে ওঠা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে জিউস রক্ত নিয়ে নাৎসিদের খেলা হিংস্র হোলির ভয়াবহ স্মৃতিচিহ্ন এখনও টাটকা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। রক্তিম লালসার সেই ন্যক্কারজনক অভিশপ্ত অধ্যায়কেই আবারও ভারতবর্ষের মাটিতে পুনরাভিষিক্ত করতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সত্যিই অদ্ভুত আঁধার এক এই ভারতবর্ষের মাটিতে আজ! প্রত্যেক ভারতবাসীকে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে এদেশের নাগরিক হিসেবে। আর না পারলে ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। ঠিক যেভাবে নিজের অপছন্দের ইহুদিদের অস্তিত্ব মুছে ফেলে অনন্তকালীন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার চূড়ায় বিরাজ করতে চেয়েছিলেন হিটলার, তারই সুনিপুণ ভারতীয় সংস্করণ এসআইআর বা স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন। ভারতীয় সাধারণতন্ত্রে এ যাবৎকাল আমজনতার ভোটে নির্বাচিত হত সরকার। জনগণের আদেশ মেনে শাসক বসত সিংহাসনে। কিন্তু মোদির ‘আচ্ছে দিন’-এর ভারতে নতুন দৃশ্য। ক্ষমতাসীন সরকার বিচার করবে আগামীতে কাদের হাতে থাকবে ভোটদানের অধিকার। বলাই বাহুল্য, এক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে গেরুয়া যন্তরমন্তরে নিজেদের মস্তিষ্ককে বিকিয়ে দেওয়া তোষামোদকারী অন্ধ অনুগ্রাহীগণ। ‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’— মিথ্যে প্রশস্তির ঊর্ধ্বে উঠে গলা চড়ালেই কেড়ে নেওয়া হবে নাগরিকত্ব। দেশ জুড়ে থাকবে না কোনও প্রশ্নের অধিকার। রাজ করবে শুধু শাসকের ফরমান। আর এই প্রবণতা প্রত্যক্ষ হয়,বিগত ১১ বছরে প্রধানমন্ত্রীর একটিও ‘অবাধ সাংবাদিক সম্মেলন’-এ সম্মুখীন না হওয়ার মাধ্যমে। কোনও একটি চাকরির পরীক্ষার প্যানেলে ভুলক্রমে একজন অস্বচ্ছভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যান্ডিডেট থাকলেই যদি পুরো প্রক্রিয়াটি বাতিল করা যায় কিংবা ‘ঢাকি সমেত ঢাক বিসর্জন’-এর মানসিক ভারসাম্যহীন জিগির তোলা যায়; তাহলে এযাবৎকাল ভুয়ো ভোটার দ্বারা নির্বাচিত সরকারকেও অবিলম্বে বাতিল বলে ঘোষণা করার কথাই জানান দেয় যুক্তির নিরপেক্ষ দাঁড়িপাল্লা। আমজনতার নাগরিকত্বের পরীক্ষা নেওয়ার আগে তো সর্বাগ্রে বরখাস্ত করা উচিত সেই ভুয়ো প্রধানমন্ত্রীকেই, যার দল বিজেপি বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোটে জয়লাভ করে ওই রাজ্যেরই ৬৫ লক্ষ ভোটারের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে পানিহাটির প্রদীপ কর, জামালপুরের বিমল সাঁতরার রক্তে স্নানের পর SIR এগিয়ে চলেছে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে…
পশ্চিমবঙ্গ নদীমাতৃক রাজ্য। বর্ষার বন্যা তার নিত্য বছরের সঙ্গী। ২০০০ সালে বাংলা প্রত্যক্ষ করেছে রাজ্যব্যাপী ভয়াবহ প্লাবন। আয়লা কিংবা আম্ফানও খুব বেশি দিনের কথা নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আকস্মিক করালগ্রাসে সুন্দরবনের ওই প্রান্তিক মানুষগুলো যখন নিজেদের অস্তিত্বরক্ষাতেই নাজেহাল, তখন নথি বাঁচাবে কী করে! কিন্তু নিরঙ্কুশ গেরুয়াকরণের স্বার্থে মহারাজ আবার সদর্পে ঘোষণা করেছেন— ‘যায় যদি যাক প্রাণ, নথি তুমি ভগবান!’ ছোট্ট শিশু ভেসে যাক জোয়ারের জলে, কাগজ বাঁচাতে হবে যে! আর ওই একটা কাগজই নাকি বলে দেবে কে ভারতীয় আর কে ভিনদেশি! ও থুড়ি! এখন আবার কাগজ নয় মুখের ভাষা-ই যথেষ্ট। কয়েক হাজারবার ডেইলি প্যাসেঞ্জারির পর বাঙালিকে জুমলার জড়িবুটি গেলাতে না পেরে এখন দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বাংলাদেশিরূপে। মহারাজার পেয়াদা অমিত মালব্য তো ঘোষণা করেই দিয়েছেন — ‘বাংলা নামে কোনও ভাষা নেই। দিল্লি পুলিশ বাংলাদেশি ভাষা উল্লেখ করে একেবারেই ঠিক বলেছে।’ আসলে কাহিনিটা একই থাকে, শুধু চরিত্রগুলো বদলে যায় হিটলার থেকে মোদিতে। রক্তের রঙ একই থাকে, শুধু শিকার বদলে যায় ইহুদি থেকে বাঙালিতে।
আরও পড়ুন-মৌলবাদী চাপে বেনজির সিদ্ধান্ত ইউনুস সরকারের
সম্প্রতি SIR-এর দ্বাদশ নথি হিসেবে আধার কার্ডকে মান্যতা দেওয়ার পরও আধার ও ভোটার কার্ড নিয়ে কেন্দ্রের দ্বিচারিতামূলক পুরনো প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যদি আধার বা ভোটার কার্ড প্রাথমিক পরিচয়পত্র না হয় তবে ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র কোনটি? একজন নাগরিকের অন্যতম অধিকার ভোটদানে ভোটার কার্ড কীভাবে গ্রহণযোগ্য হয়? পাশাপাশি রাষ্ট্রের দেওয়া খাদ্যপণ্য পেতেও রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার কার্ড সংযুক্ত করতে হচ্ছে। আধার যদি প্রাথমিক পরিচয়পত্র না-ই হয়, তবে এর পিছনে যুক্তিই বা কী? আধার ও ভোটার যদি নাগরিকের প্রাথমিক পরিচয়পত্রের মধ্যে না পড়ে, তবে ভোটার কার্ড-আধার কার্ড সংযুক্তকরণের প্রয়োজনটাই বা কী? সব মিলিয়ে অধরা প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে দিশেহারা সাধারণ মানুষ সভয়ে দিন গুনছে ডিটেনশন ক্যাম্পের অন্ধকার কুঠুরির অপেক্ষায়। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের দাবিনুযায়ী, মৃত ও একাধিকবার নথিভুক্ত ভোটারদের নাম তালিকা থেকে সরাতেই এই উদ্যোগ। কিন্তু সেক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবীভাবে প্রশ্ন উঠে আসে, তাহলে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে অজান্তেই রাজ করে গেছে ভুয়ো ভোটের রমরমা যাতে দেশ জুড়ে নির্বাচিত হয়েছে বিজেপি সরকার! অতএব বিজেপিকে ‘ভোট চোর’ আখ্যা দেওয়া খুব অমূলক কী, যেখানে আবার কর্নাটকের আলান্দ নির্বাচনী এলাকার প্রায় ৬,০১৮টি ভোট রাজ্যের বাইরের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে ভোটার পরিচয় থেকে মুছে ফেলা হয়েছে বিজেপিকে জেতাতে! উল্টোদিকে ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহের ক্ষেত্রে যখন আধারের কপি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক এবং এদেশে আধার-ভোটার ইতিপূর্বেই সংযুক্ত, তাহলে এই ভুয়ো ভোটারের দায় কি পুরো দেশ জ্বালিয়ে বিদেশ ভ্রমণে মত্ত প্রধানমন্ত্রীর নয়? আসলে ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়। ভারতবাসীর কাছে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাসযোগ্যতা এখন টেনিদারও নিচে। তার ঢপের চপে মানুষ এখন আর আশ্বস্ত নয়, বরং আতঙ্কিত হয়। ১১ বছর ধরে ১১০০ বার ব্যাংকের লাইনে দাঁড়িয়ে পাসবুক আপডেট করার পরও অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ঢোকেনি কোনও ভারতবাসীর। নরেন্দ্র মোদিকে বিশ্বাস করে রোদে পুড়ে লাইনে দাঁড়িয়ে বাতিল হওয়া ৫০০ কিংবা ১০০০ টাকার নোট ব্যাঙ্কে জমা করেছে আমজনতা বিদেশে পড়ে থাকা কালো টাকা দেশে ফেরানোর আশায়। তারপর রংবেরঙের প্রচুর টাকা বাজারে এলেও কালো টাকা ফেরেনি। মাঝে আবার বাতিল হল দু’হাজারের নোট। পিএম কেয়ার ফান্ডের নামে বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের গাজর ঝুলিয়ে শেষ দু’বছরে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় তিনগুণ। পাশাপাশি রয়েছে ব্যাকডোরে ওষুধের দাম বাড়ানোর অনুমতি দিয়ে জিএসটি কমানোর ললিপপ। স্বল্প ব্যয়ে কেবল লাইনে টিভি দেখার দিন যেন এক সুদূর ইতিহাস। মোবাইলে ৩০ টাকার রিচার্জ আজ ৩০০ টাকা! বার দশেক লাইনে দাঁড়িয়ে এই কার্ড ওই কার্ড যুক্ত করার পর এখন শোনা যাচ্ছে সবই নাকি আদতে ভাঁওতা!
আরও পড়ুন-এসআইআর আতঙ্কে শহিদ ৭ জনকে শ্রদ্ধা
কাগজের কচকচানির কাঁচি হাতে মোদিরূপী মহিষাসুর যখন বাংলার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছেন তার সংহতি ও একতাকে ছিন্নভিন্ন করে উৎসবের এই রঙিন মরশুমকে বানচাল করতে, তখন সত্তরের এক সিংহহৃদয় খাঁড়া হাতে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় শিয়রে দণ্ডায়মান গেরুয়া তাণ্ডবকে দুরমুশ করে সম্প্রীতির আলোকবর্তিকারূপে সহযোগিতা, মানবিকতা ও ঐক্যতানের ফুল ফোটানোর বর্ণালি স্বপ্ন নিয়ে… বিভেদকামিতার বিষবৃক্ষকে সংহতির হাজার প্রদীপ সম্মিলিতভাবে এবার ছারখার করবেই বঙ্গজননী মমতার হাত ধরে…

