এক নতুন দিগন্ত
ক্যাথার্টোসাইটোসিস হল সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি কোষীয় প্রক্রিয়া, যেখানে কোষগুলি দ্রুত ‘বমি’ করে বা অনাকাঙ্ক্ষিত অভ্যন্তরীণ উপাদান এবং বর্জ্য পদার্থ কোষের বাইরে বের করে দেয়। গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত এই পরিভাষাটির আসল অর্থ হল ‘কোষীয় শুদ্ধীকরণ’। গবেষকেরা মূলত ইঁদুরের পাকস্থলীর কোষে এই প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেন এবং এর নামকরণ করেন। ক্যাথার্টোসাইটোসিস এমনই একটি আকর্ষণীয় কোষীয় প্রক্রিয়া যা আঘাতের পর কোষগুলিকে পুনর্গঠনের জন্য সুবিধাজনক শর্টকাট প্রদান করে। কোষীয় শুদ্ধীকরণ নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়াটি, একটি বৃহত্তর পুনরুৎপাদনমূলক পদ্ধতি প্যালিজেনোসিস (paligenosis)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ক্যাথার্টোসাইটোসিস পদ্ধতি
কোষের বাইরের ঝিল্লির মধ্যে অনন্য, বহু-প্রকোষ্ঠযুক্ত অঙ্গুলাকার অংশ (invaginations) গঠিত হয়। কোষ এই গঠনগুলি ব্যবহার করে প্রচুর পরিমাণে কোষীয় আবর্জনা, যেমন সালফেটেড গ্লাইকোপ্রোটিন, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ঝিল্লি এবং সিক্রেটরি গ্র্যানিউল পদার্থ আশেপাশের পরিবেশে নির্গত করে। সাধারণত তিনটি স্তরে এটি ঘটে থাকে।
অ্যাপিকাল মেমব্রেন ইনভ্যাজিনেশন
ক্যাথার্টোসাইটোসিসের মূল ভিত্তি হল একটি অত্যন্ত সুসংহত কাঠামোগত পরিবর্তন। কোষের গোড়ার দিক (basal side) থেকে অ্যাপিকাল প্লাজমা মেমব্রেন-এর মধ্যে বহু-প্রকোষ্ঠযুক্ত ইনভ্যাজিনেশন গঠিত হয়। এটি হল কোষের সেই দিক যা একটি খোলা স্থানের মুখোমুখি থাকে, যেমন পাকস্থলীর গহ্বর (lumen)।
আবর্জনাকে আবদ্ধ করা
এই ইনভ্যাজিনেশনগুলি মূলত কোষের মধ্যে অস্থায়ী ‘পকেট’ বা ‘গহ্বর’ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে অবাঞ্ছিত পদার্থে ভরে যায়। এই পদার্থগুলি কেবল ক্ষুদ্র অণু নয়, বরং বড়, জটিল কাঠামো যেমন সালফেটেড গ্লাইকোপ্রোটিন (যা মেটাপ্লেসিয়া এবং ক্যানসারের চিহ্নিতকারী হতে পারে), এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের ঝিল্লি এবং সিক্রেটরি গ্র্যানুলস।
যান্ত্রিক নির্গমন
ত্রিমাত্রিক আলোক এবং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি এই প্রক্রিয়াটি দৃশ্যমান করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মনে করা হয় কোষ যান্ত্রিকভাবে এই ঝিল্লি-আবদ্ধ পকেটগুলো ‘ছিঁড়ে ফেলে’ এবং তাদের ভেতরের অংশ সরাসরি কোষের বাইরের পরিবেশে, যেমন পাকস্থলীর গ্রন্থির গহ্বরে, নির্গত করে। এর ফলে বর্জ্যকে অভ্যন্তরে ভাঙার প্রয়োজনীয়তা থাকে না।
আরও পড়ুন-আজ স্বাস্থ্য ভবনে উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী, চালু হচ্ছে ২১০টি আধুনিক মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট
উদ্দেশ্য
যখন বিভেদিত (বিশেষায়িত) কোষগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখন তাদের বিভক্ত হতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু মেরামত করতে একটি আরও আদিম, স্টেম সেল-সদৃশ অবস্থায় ফিরে যেতে হয়। এই প্রক্রিয়া, প্যালিজেনোসিস, কোষগুলিকে তাদের পরিণত কাঠামো ত্যাগ করতে বাধ্য করে। আগে মনে করা হত যে এটি শুধুমাত্র অটোফাজি-এর মাধ্যমে ঘটে, যা লাইসোসোমের মধ্যে কোষীয় উপাদানগুলোকে ভেঙে ফেলার একটি ধীর এবং পদ্ধতিগত অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া। ক্যাথার্টোসাইটোসিস একটি দ্রুত, বাহ্যিক বিকল্প সরবরাহ করে।
অটোফাজি থেকে কোথায় আলাদা
অটোফাজি হল কোষের অভ্যন্তরে লাইসোসোমের মাধ্যমে কোষীয় উপাদানগুলোর নিয়ন্ত্রিত ভাঙন। কিন্তু ক্যাথার্টোসাইটোসিস হল একটি পৃথক, যান্ত্রিকভাবে স্বাধীন প্রক্রিয়া যা বর্জ্যকে বাইরের দিকে বের করে দেয়। এটি কোষগুলিকে ধীর ও পদ্ধতিগত অটোফাজিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে নিয়ে না গিয়ে দ্রুত বর্জ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি শর্টকাট পথ দেয়।
ক্যাথার্টোসাইটোসিসের দ্বিমুখী প্রভাব
বিশেষত দীর্ঘস্থায়ী আঘাত এবং রোগের প্রেক্ষাপটে ক্যাথার্টোসাইটোসিস একটি উপকারী প্রক্রিয়া, গবেষকেরা এর সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলিও তুলে ধরেছেন।
প্রদাহ বাড়িয়ে তোলা
কোষীয় আবর্জনার দ্রুত এবং ‘অগোছালো’ নির্গমন আশেপাশের কলাতে একটি প্রদাহ-সৃষ্টিকারী অণুপরিবেশ তৈরি করতে পারে। বর্জ্য পদার্থের এই জমাটবদ্ধতা স্থানীয় প্রদাহকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ক্যানসারের সঙ্গে সংযোগ
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ এবং ক্যানসারের মধ্যে সম্পর্ক অনেকদিন আগেই প্রতিষ্ঠিত। গবেষকেরা অনুমান করছেন যে পাকস্থলীতে এইচ. পাইলোরি-র সংক্রমণের পরিস্থিতিতে, চলমান ক্যাথার্টোসাইটোসিস প্রদাহজনক পরিস্থিতিতে বেশি করে ইন্ধন জোগায়। এই সময় এই পরিবর্তিত কোষগুলি যখন প্যালিজেনোসিস এবং ক্যাথার্টোসাইটোসিসের মাধ্যমে বারবার স্টেম সেল-সদৃশ অবস্থায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়, তখন তারা সংখ্যাবৃদ্ধি করতে এবং প্রসারিত হতে পারে, যা কিনা আবার ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
আরও পড়ুন-লালকেল্লার গায়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, নিহত ৯, প্রশ্নের মুখে অমিত শাহ
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
ক্যাথার্টোসাইটোসিস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা প্রথমে ২০২৪-’২৫ সালের একটি গবেষণায় বর্ণিত হয়েছে। যদিও প্রাথমিকভাবে এটি গ্যাস্ট্রিক এপিথেলিয়াল কোষে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, গবেষকেরা অনুমান করছেন যে এই প্রক্রিয়াটি অন্যান্য কলাতেও ঘটতে পারে। স্বাস্থ্য ও রোগের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য যদিও আরও তদন্ত প্রয়োজন, তবুও এখনও অবধি আবিষ্কৃত তথ্যানুযায়ী এটিকে চিকিৎসার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রাথমিক শনাক্তকরণের জন্য বায়োমার্কার
বিজ্ঞানীরা একটি অ্যান্টিবডি তৈরি করেছেন যা ক্যাথার্টোসাইটোসিস থেকে নির্গত কোষীয় আবর্জনার সাথে যুক্ত হতে পারে। এটি থেকে বোঝা যায় যে এই আবর্জনার উপস্থিতি কোনও ক্যানসার কোষের কিনা, বিশেষত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ক্যানসারের, প্রাথমিক শনাক্তকরণের জন্য একটি বায়োমার্কার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
চিকিৎসাগত লক্ষ্যবস্তু
ক্যাথার্টোসাইটোসিসের আণবিক পথগুলি আরও ভালভাবে বোঝার মাধ্যমে, নতুন থেরাপিউটিক কৌশল তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। তীব্র আঘাতের জন্য, ক্যাথার্টোসাইটোসিসের উপকারী পুনরুৎপাদনমূলক প্রভাব বাড়ানোর এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ করা যেতে পারে। আবার, এর বিপরীতে, দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতিতে, প্রদাহ কমাতে এবং টিউমার গঠনের ঝুঁকি হ্রাস করতে অতিরিক্ত ক্যাথার্টোসাইটোসিসকে বাধা দেওয়ার দিকেও নজরদারি করা যেতে পারে।

