মধুমেহ

সামনেই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ডায়াবেটিস হল লাইফ স্টাইল ডিজিজ। এটি রুখতে ওষুধের চেয়েও বেশি জরুরি সচেতনতা এবং গাইডলাইন। এই নিয়ে জরুরি পরামর্শ দিলেন মালদহ মেডিক্যাল কলেজের ডায়াবেটিক কনসালটেন্ট ডাঃ পল্লব বসু। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

সামনেই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। চিকিৎসকেরা যখন ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মিষ্টি বাদ দেবার পরামর্শ দিচ্ছেন তখন সেই একই দিনে পালিত হবে বিশ্ব রসগোল্লা দিবসও! তা হলে কি ডায়াবেটিসে আক্রান্তেরা এই দিনটায় ভয় দূরে সরিয়ে একটা রসগোল্লা মুখে পুরবেন! বিশ্ব জুড়ে বাড়ছে ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০৫০ সালে এই রোগীর সংখ্যা পৌঁছতে পারে ১.৩ বিলিয়ন। প্রি-ডায়াবেটিক স্টেজে রয়েছে প্রায় ৫৪১ বিলিয়ন। তাহলে কী উপায়?
মহামারীর আকার নিতে-থাকা ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ হল আধুনিক অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা। তাতেই যত বিপত্তি। নিয়মিত নিজের শরীর-স্বাস্থ্য এবং খাওয়াদাওয়ার প্রতি যত্নবান হলে এক-আধটা রসগোল্লায় চিন্তা কীসের? জরুরি হল সচেতনতা এবং সতর্কতা। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য জরুরি নির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইন যেগুলো মেনে চললে অনায়াসে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এই রোগ। সেই কারণে প্রতিবছর সচেতনতা বাড়াতে গোটা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় এই দিনটি।

আরও পড়ুন-দিল্লি বিস্ফোরণে মৃত্যু বেড়ে ১২, জঙ্গি-যোগ স্পষ্ট, মোদি গেলেন ভুটান

মুধমেহ মধুময় নয়
ডায়াবেটিসের সবচেয়ে বেশি ধরনটি হল টাইপ টু। এই ডায়াবেটিসে শরীর হয় পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না অথবা উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে না। বিশদে বললে অগ্ন্যাশয় থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন হরমোন নিঃসৃত না হওয়ার কারণে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায় আবার শরীরের কোষগুলো উৎপাদিত ইনসুলিনের প্রতি সংবেদনশীল না হওয়ায় এটি কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে না। যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
মধুমেহর কারণ
এই রোগ মূলত জিনঘটিত বা জেনেটিক। পারিবারিক ইতিহাস অর্থাৎ বাবা-মা বা কাকা-কাকিমা, দাদু দিদা বা ঠাকুমা ঠাকুরদার ডায়াবেটিস থাকলে সেক্ষেত্রে একটা সম্ভাবনা থাকছে। তবে সম্ভাবনা থাকলেই ডায়াবেটিস হবে এমন নয়।
দ্বিতীয় এবং বড় কারণ হল লাইফ স্টাইল ডিজর্ডার। এই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার থেকে চারটে অবস্থা তৈরি হয়। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চ শর্করার পরিমাণ, কোমরের ও পেটের চারপাশে অতিরিক্ত চর্বি এবং উচ্চমাত্রার ট্রাইগ্লিসারাইড। যাকে একত্রে বলা হয় মেটাবলিক সিনড্রোম। এই মেটাবলিক সিনড্রোম টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এছাড়া দশজন শুগার রোগীর মধ্যে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে তার মধ্যে চারজনের হাইপোথাইরয়েডও আছে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে পিসিওএস থাকলে পরবর্তীকালে সেখান থেকে ডায়াবেটিস হতে পারে।
মেনোপজের পরেও ডায়াবেটিস হতে পারে।
এর সঙ্গে রয়েছে অ্যাক্টিভ লাইফ বা সক্রিয় জীবনযাত্রা থেকে সরে যাওয়া। সারাদিন বসে কাজ করা বা হঠাৎ করেই অ্যাক্টিভ বা সচল জীবনযাত্রা থেকে অচলতার দিকে চলে যাওয়া। এই কারণে বয়স্ক মানুষদের মধ্যে অবসরের পর শুগার হতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন-দ্বিতীয় দফাতেও রেকর্ড ভোট

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
খাবার স্কিপ করা অর্থাৎ অনেকটা সময় না খেয়ে থাকা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। শরীর যদি বুঝে যায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে সে আর খাবার পাবে না তখন শরীর নিজে কার্বোহাইড্রেটকে ফ্যাটে পরিণত করতে থাকে এবং শরীরে তা জমাতে শুরু করে ফলে ওজন আপনিই বেড়ে যায়।
তাই খালি পেট বা খাবারে অনেকটা গ্যাপ একেবারেই নয়। এর সঙ্গে একবারে অনেকটা না খেয়ে বারবার অল্প পরিমাণে খাওয়া।
কষিয়ে রান্না করা খাবারের থেকে একটু সেদ্ধ খাবার বেশি খেতে হবে। সিজনাল ফল, গাজর সেদ্ধ, ভেজিটেবল স্যুপ। এতে পেট ভরল ক্যালরি আর কার্ব শরীরে ঢুকল না। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমল।
যে কোনও খাবার শরীরে যতটা গ্লুকোজ বাড়ায় তার ওপর নির্ভর করে সেই খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স-এর পরিমাপ। অর্থাৎ যে খাবারে কোনও কার্বোহাইড্রেট নেই তার কোনও গ্লাইসেমিক ইনডেক্স নেই। যেমন নুন। নুন হল জিরো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। তবে জিরো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স-যুক্ত খাবার বিশেষ হয় না অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট সব খাবারেই মধ্যেই কম-বেশি থাকে। যেমন শাক, সবজি, ছোলা, ওটস— সবের মধ্যেই কার্ব আছে।
তাই এর মধ্যে থেকে যে-গুলোয় ফাইবার বেশি কার্বোহাইড্রেট কম অর্থাৎ লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বা মডারেট গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সে-খাবার বেছে নিয়ে খান তাহলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমবে। হাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স-যুক্ত খাবার একটু কম খান। যেমন— আলু, গাজর, বিট ইত্যাদি। ইউরিক অ্যাসিডজনিত সমস্যা না থাকলে টম্যাটো খান বিশেষ করে সবুজ টম্যাটো।
ফলের মধ্যে তরমুজ, আম, কাঁঠাল, সবেদা— একটু এড়িয়ে যান বা কম খান। পাকা পেঁপে, মুসাম্বি, নাশপাতি, আপেল— এগুলো খেতে পারেন।
ডায়াবেটিস রোগীর দশ বছর পরে হলেও কিডনি ড্যামেজ হবেই। তাতেই কার্ব পুরো বাদ দিয়ে শুধু প্রোটিন বা ফ্যাট একবারেই খাওয়া যাবে না। এতে কিডনি আরও বেশি ড্যামেজ হতে শুরু করবে। একশো গ্রাম কার্বোহাইড্রেট সারা দিনে-রাতে খেতেই হবে।
ইনসুলিন হল এমন একটা হরমোন যেটা খাবার না খেলে বেরবে না। তাই খাবার খেতে হবে নিয়ম মেনে তবেই ইনসুলিন বেরবে এবং কার্ব কম থাকবে ফলে ক্যালরি বাড়বে না।
এর সঙ্গে সপ্তাহে দেড়শো ঘণ্টা হাঁটতেই হবে। এর মধ্যে তিরিশ মিনিট একটানা হাঁটতে হবে। এবং গ্যাপ ছাড়া একটানা হাঁটা— থামলে হবে না। এর পরে ব্যায়াম। রাস্তায় হাঁটতে না পারলে ঘরে ওয়াকার বা বড় হলঘরে বা ছাদে হাঁটুন। সাঁতার-কাটা যেতে পারে।
ডায়াবেটিসের উপসর্গ প্রায় নেই
টাইপ টু ডায়াবেটিসের সাধারণত আগাম উপসর্গ থাকে না। অ্যাক্সিডেন্টাল ডায়াগনোসিস অর্থাৎ। অন্য কোনও রোগের পরীক্ষা করতে গিয়ে শুগার ধরা পড়ে।
এ-ছাড়া কারও ক্ষেত্রে ইউরিন করার সময় ইচিং হয়। ইউরিনারি অংশে ফাংগাল ইনফেকশন হয় এবং ইউরিনারি ট্যাক্ট ইনফেকশন বেশি হয়।
এ-ছাড়া কিছু ক্ষেত্রে রাতে বারবার বাথরুম যাওয়া একটা লক্ষণ।
খুব বেশি ফোড়া হওয়া বা কোনও কাটা-ঘা হয়তো দেখা গেল শুকোচ্ছে না। হঠাৎ ওজন
কমতে থাকা।

Latest article