উৎসবের আলো

গতকাল শেষ হয়েছে ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এবারের উৎসবে বাইরে থেকে এসেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁদের কথা, ভাবনাচিন্তা সমৃদ্ধ করেছে, ছড়িয়েছে আলো। উৎসব ঘুরে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

রমেশের পরামর্শ
সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। হাতে-কলমে শিখতে হবে কাজ। তারপরই বানাতে হবে ছবি। নতুন পরিচালকদের পরামর্শ দিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক রমেশ সিপ্পি। ৩১তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি এসেছিলেন সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা দিতে। তখনই বলেন এই কথা। পাশাপাশি বলেন, প্রকৃত দর্শক আজো পয়সা খরচ করে হলে গিয়ে সিনেমা দেখে।
এবারের উৎসবে তাঁর পরিচালিত ‘শোলে’ ছবির পঞ্চাশ বছর উদযাপিত হয়েছে। সেই ছবির বহু অজানা কথা শ্রোতাদের সামনে উজাড় করেন। তুলে ধরেন টুকরো টুকরো মজাদার ঘটনাও। বলেন, ধর্মেন্দ্র প্রথমে গব্বর সিংয়ের চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন। ওটা ভিলেনের চরিত্র শুনে পিছিয়ে আসেন এবং ঠাকুরের চরিত্রে অভিনয়ের আবদার করেন। তাঁকে বলা হয়, ঠাকুর চরিত্র করলে কিন্তু হেমা মালিনীকে নায়িকা হিসেবে পাওয়া যাবে না! তখন সবকিছু ছেড়ে তিনি বীরুর চরিত্র আঁকড়ে ধরেন এবং হেমা মালিনীর নায়ক হয়ে যান!

আরও পড়ুন-কুখ্যাত এপস্টিনের গোপন ই-মেইল ফাঁসে চাঞ্চল্য

ওঠে অমিতাভ-জয়ার নীরব প্রেমের কথাও। সেই সূত্রেই আসে মাউথ অর্গান প্রসঙ্গ। ছবিতে সুরের মায়াজাল বিস্তার করেছিলেন রাহুল দেব বর্মন। তাঁকে স্মরণ করেন রমেশ সিপ্পি। বলেন, পঞ্চম ছিলেন বাংলার সন্তান। স্মরণ করেন আসরানিকেও। চিত্রনাট্যকার সেলিম-জাভেদের অবদানের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। পাশাপাশি জানান, বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় ‘শোলে’ দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ৭ নভেম্বর, তাঁর বক্তৃতার সময় শিশির মঞ্চের প্রায় প্রতিটি আসন ভরে গিয়েছিল। ছিলেন উৎসবের চেয়ারম্যান চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ।

আদুরের ঋত্বিক
চলচ্চিত্র পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণন। ছবি তৈরি করেন মালয়ালম ভাষায়। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। পাশাপাশি পেয়েছেন পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। বাংলার সঙ্গে তাঁর বহু পুরনো সম্পর্ক। যখন সিনেমা তৈরির কাজে হাত দেননি, তখন থেকেই। অনুবাদে পড়েছেন প্রচুর বাংলা বই। এবারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ১২ নভেম্বর শিশির মঞ্চে ‘ঋত্বিক ঘটক স্মারক কথামালা’য় অংশ নেন ঋত্বিক ঘটকের এই কৃতী ছাত্র। কবে আলাপ হয়েছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পরিচালকের সঙ্গে? আদুর গোপালকৃষ্ণন বলেন, আলাপ হয়েছিল ১৯৬৩ সালে, ভারতের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন। সব শিক্ষকের থেকে আলাদা ছিলেন তিনি। সবাই মুগ্ধ ছিল তাঁর থিয়েটার ও সিনেমা জীবনের কৃতিত্বে। প্রত্যেক ছাত্রকেই সাহায্য করতেন। মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন সিনেমাকে। কাজ করতে চাননি বাঁধাধরা চিত্রনাট্যে। কেমন সম্পর্ক ছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে? আদুর গোপালকৃষ্ণন বলেন, ঋত্বিক ঘটক এবং সত্যজিৎ রায়ের মধ্যে ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক।
তাঁর আক্ষেপ, শৈল্পিক সিনেমার বিশুদ্ধতা নষ্ট করছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। ভাল ছবিকে সমর্থন করার লোকজন কমে গেছে। বদলে গেছে প্রযুক্তি, সময় এবং দর্শকের রুচি। তাঁর সঙ্গে কথা বলেন চলচ্চিত্র পরিচালক অনুপ সিং এবং উৎসবের চেয়ারম্যান চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ।

আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের হয়ে খেলতে পারেন ডেকোরা, মেসির সামনে অলস্টার ম্যাচ

শান্তনুর সুর
ছিলেন বিজ্ঞাপন সংস্থার ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং এক্সিকিউটিভ, হয়ে গেলেন সুরকার। তিনি শান্তনু মৈত্র। ১৩ নভেম্বর, উৎসবের শেষ দিন ছিলেন রবীন্দ্র সদনে। কথা বলেন, শোনান গান। তিনি জানান, এজেন্সির তৎকালীন ক্রিয়েটিভ হেড প্রদীপ সরকার তাঁকে শেষ মুহূর্তে একটি জিঙ্গেল রচনা করতে বলেন। জিঙ্গেলটি ছিল ‘বোলে মেরে লিপস/ আই লাভ আঙ্কেল চিপস’। যা রীতিমতো হিট করে। একটি অ্যালবামে তাঁর সুরে গান করেন শুভ মুদগাল।
২০০২ সালে মুম্বই চলে আসেন। সুধীর মিশ্রের ‘হাজারোঁ খোয়াইশেঁ অ্যায়সি’ সিনেমায় কাজ করেন। তারপর সুর দেন প্রদীপ সরকারের ‘পরিণীতা’ ছবিতে। হাতের মুঠোয় সাফল্য। তিনি মনে করান, এই বছর পালিত হচ্ছে ‘পরিণীতা’ ছবির ২০ বছর। সেইসঙ্গে বলেন শ্যাম বেনেগল, প্রদীপ সরকার, বিধুবিনোদ চোপড়া, সুজিত সরকার, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল। পাহাড়ে বেড়াতে ভালবাসেন। পাহাড়ির সুরের প্রতি আকৃষ্ট হন। গাড়ির গতি সহায়ক হয় তাঁর সৃষ্টিতে। কীভাবে সুর ধরা দেয় তাঁর কাছে, জানিয়েছেন। বলেছেন সাফল্য ভুলে শূন্য থেকে শুরু করার কথা।
উত্তর ভারতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। বাংলার প্রতি তাঁর নিবিড় টান। শান্তনু মৈত্র বললেন, সুন্দর সুন্দর সব জিনিস আছে পশ্চিমবঙ্গে। এমন আর কোথাও নেই। যাঁরা এখানে থাকেন, তাঁরা হয়তো ঠিক বুঝতে পারেন না। আমরা প্রবাসী, বাংলাকে আঁকড়ে ধরে থাকি। আমার গান কোনও বাঙালির মন ছুঁয়ে গেলে ভাল লাগে। আমি বাইরে থেকে বাংলার দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, যাঁরা বাংলায় থাকেন, তাঁরা কেন অকারণে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন!
তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক অরিন্দম শীল। পর্বটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। শেষে জানতে চাইলাম, আপনার প্রিয় সুরকার কে? শান্তনু মৈত্র বললেন, সলিল চৌধুরী। যাঁর শতবর্ষ পালিত হচ্ছে উৎসবে।

Latest article