কী চাইছেন আসলে সাফ বলুন মোদি-শাহ

বারবার নানা ঘটনায় প্রমাণিত, বিজেপি আমাদের মারতে চায়। এদের কেন ভোট দেব আমরা? প্রশ্ন তুলে ধরলেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

এই তো গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির।
মেয়ের নামে আসেনি এনুমারেশন ফর্মে। এই নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলেন বাবা। বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ির পাশে গাছ থেকে তাঁর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে। শুধু এই ঘটনা নয়, গত কয়েকদিন ধরে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় এসআইআর আতঙ্কে বেশ কয়েকজন আত্মঘাতী হয়েছেন।‌
পাশাপাশি, প্রায় সমান্তরালে অন্য আর এক ছবি।

আরও পড়ুন-খরচ ৮ কোটি, ৪০ কিমি রাস্তায় কেবল ডাক্ট বসাবে পুরসভা, মার্চের মধ্যে ১০ রাস্তা থেকে উধাও তার-জট

স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআরের জাঁতাকলে পড়ে বিভিন্ন সরকারি স্কুলে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে পড়াশোনা। যেমন, শান্তিপুর ব্লকের তিওয়ারি মাঠ ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক সংকটে বন্ধ ক্লাস। তিনজন শিক্ষক নিয়ে চলা এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তিনজনকেই বুথ লেভেল অফিসার বা বিএলও হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ায় গত তিনদিন ধরে তালা পড়েছে ক্লাসে। আগামী ডিসেম্বর মাসেই স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা আগাম ঘোষিত। এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনা ডকে ওঠায় দিশেহারা পড়ুয়া ও অভিভাবকরা।
শিক্ষকরা পরিষ্কার জানাচ্ছেন, সমস্যা ভীষণ গুরুতর। হাতে অল্প সময়ের মধ্যে ফর্ম বিলি, সংগ্রহ ও ডিজিটাইজেশনের কাজ করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় স্কুল চালানো অসম্ভব। তাঁদের দোষ দেওয়া চলে না।
দোষ দেওয়া যাবে না অভিভাবকদেরও। পরীক্ষার আগে পড়াশোনার প্রয়োজন রয়েছে। ওদিকে বেশিরভাগ পড়ুয়ার অভিভাবকদেরই সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই যে, বাড়িতে গৃহশিক্ষক রেখে পড়াবেন। স্কুলে পড়াশোনা না হলে তার প্রভাব পড়তে পারে খুদে পড়ুয়াদের রেজাল্টে। ওই এলাকায় ছাত্রছাত্রীদের পঠনপাঠনের জন্য উল্লিখিত তিওয়ারি মাঠ ফ্রি প্রাইমারি স্কুল অন্যতম ভরসা।
কিন্তু এসবে মোদি সরকারের কীই-বা আসে যায়!

আরও পড়ুন-ফের রবিবার বন্ধ বিদ্যাসাগর সেতু

ওঁদের হঠাৎ ইচ্ছা হয়েছিল পুরনো নোট বদলে দিয়ে নতুন নোট চালু করার। তাই প্রধানমন্ত্রী কোনও একটি দিনকে মর্জিমাফিক বেছে নিয়ে রাত ৮টার সময় নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করে দিলেন আজ রাত ১২টা থেকে আর পুরনো দুটো নোট চলবে না। একথা জানিয়ে তিনি সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ১৪০ কোটি মানুষকে জাগিয়ে রেখে। সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে এনে ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই নোটবাতিল নামক একটি খামখেয়ালি খেলার জেরে ব্যাঙ্কে অথবা এটিএমে টাকা জমা দেওয়া এবং টাকা তোলার লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে দেশজুড়ে বহু মানুষের মৃত্যু হল। আত্মহত্যা ঘটল একের পর এক। বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। স্রেফ কর্মহীন হয়ে চরম অন্ধকার ও অনিশ্চিত জীবনে প্রবেশ করল অসংগঠিত ক্ষেত্রের বহু গরিব নিম্নবিত্ত। ক্ষুদ্র শিল্প আজ পর্যন্ত আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারল না।
প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আর কোনওদিন বলতেও শোনা গেল না যে, আমি ভুল করেছিলাম। ভারত যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গিয়েছে। কালো টাকা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি সব একইভাবে বয়ে চলেছে সমাজে। ওই যে মানুষগুলির মৃত্যু হয়েছিল, তাঁদের পরিবার ছাড়া কেউই মনে রাখেনি তাঁদের মৃত্যুর কারণ। বিজেপি মনের আনন্দে নিজের বিজয়গাথা গেয়ে চলেছে নানারকম ইস্যুতে।
আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড সব পেয়ে গিয়েছে যখন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ এবং স্থায়ী নাগরিকের মতো ভোট দেওয়া থেকে সব রাষ্ট্রীয় কার্যে বছরের পর বছর ধরে অংশ নিয়েছে, তখন হঠাৎ একদিন মোদি-শাহর মনে হয়েছিল, অনেকদিন কিছু করা হয়নি। কেমন যেন জোলো হয়ে গিয়েছে লাইফটা। বোরিং। তাই হঠাৎ করে তারা স্থির করল, সেই নাগরিকদেরই আবার নাগরিকত্ব পেতে হলে আবেদন করতে হবে। অন্য কাজ নেই। তাই গবেষণা করে রাষ্ট্র ঠিক করল ২০১৪ সালের আগে যারা যারা এসেছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে, তাদের সিএএ নামক একটি নয়া আইনে নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। প্রবল তোলপাড় হল। পুলিশ গুলি চালাল। সংঘর্ষ হল। শুধু সিএএ আন্দোলনের জেরে ৩১ জনের মৃত্যু হল। এঁদের কেন জন্ম হয়েছিল, এঁদের কেন মৃত্যু হল— এসব নিয়ে মোদি সরকারের কোনও ভ্রুক্ষেপই আর দেখা গেল না। আবার জীবন নিজের ছন্দে চলল।

আরও পড়ুন-ইউনুস জমানায় সংকটে নারী-নিরাপত্তা

২০২০ সালের মার্চ মাসে একদিন মহামান্য মোদিবাবুদের মনে হল করোনা নামক রোগের জন্য এখনই সব লকডাউন করে দেওয়া উচিত। সব উন্নত দেশই করছে। আমরাও করব। সব আধুনিক উন্নত দেশের কত জনসংখ্যা, সেসব দেশের সামাজিক অবস্থাটা ঠিক কেমন, কোন কোন জীবিকার উপর কী ধরনের মানুষ নির্ভর করে বেঁচে থাকে দু’বেলা খাওয়ার জন্য, এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করল না মোদি সরকার। আবার নাটকীয়ভাবে টিভির পর্দায় এসে মোদি ঘোষণা করে দিলেন আজ রাত ১২টার পর সব বন্ধ।
হাজার হাজার মানুষ হাজার কিলোমিটার করে হাঁটতে শুরু করল। এইসব পরিযায়ী শ্রমিক যখন খোলা আকাশের নিচে হাঁটছিল, মৃত্যু হচ্ছিল, খাবার পাচ্ছিল না, অনাহারে হাহাকার করছিল, বিনা আয়ে আত্মহত্যা করছিল, সেই সময় মোদিবাবুরা নির্দেশ দিলেন, ব্যালকনিতে এসে থালা বাসন বাজাও। উচ্চবর্গের বুদ্ধিমান শহুরে নাগরিকরা হাসিমুখে এই অভিনব সার্কাসের অঙ্গ হয়ে থালা বাজাতে বাজাতে সেলফি তুলছিল। একজনও গরিব খেটে মানুষের কিন্তু ওরকম ছবি পাওয়া যাবে না। করোনায় তো বটেই, অক্সিজেনের অভাবেও অসংখ্য ট্যাক্স দেওয়া, ভোট দেওয়া থালা বাজানোদের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে মৃত্যু হয়েছে। আজ আর এঁদের কারও কথা মনে নেই কারও।
এবার এসেছে ভোটার তালিকা সংশোধন। আমাদের রাজ্যজুড়ে মাঝেমধ্যেই নিয়ম করে শোনা যাচ্ছে এসআইআরের আতঙ্কে মানুষের মৃত্যুর সংবাদ। আত্মহত্যার সংবাদ সবথেকে বেশি।
এইসব নোটবাতিলে, সিএএ আন্দোলনে, দাঙ্গায়, করোনায়, এসআইআরে অথবা বোমা বিস্ফোরণে আমরা যেহেতু বেঁচে আছি, তাই হয়তো মনে হচ্ছে যে, আমরা ভাগ্যবান। বেঁচে আছি।
কিন্তু মোদি সরকার কী চায়? নাগরিকরা সব মরে যাক।
আমাদের ক্ষতি অথবা আমাদের বেঁচে থাকা-না থাকায় মোদিবাবুদের যে কিছুই আসে-যায় না, এই অন্তহীন মৃত্যুমিছিল থেকেই পুনঃ পুনঃ প্রমাণিত।
এই মৃত্যুর ফেরিওলাদের ভোট দেবেন? ভেবে দেখার সময় এসেছে।

Latest article