মায়ের কার্তিক

আবহমানকাল ধরে মায়ের অতিপ্রিয় আদরের দুলাল কার্তিক ঠাকুর। তিনি এই সমাজে যতই গুরুত্বহীন হন না কেন, বংশ ধরে রাখতে তাঁকেই চাই! নারীমনের সুপ্ত মাতৃত্বের ইচ্ছেপূরণের একমাত্র পথ তিনিই। কে তিনি? কীই-বা তাঁর জন্মবৃত্তান্ত? সন্তানলাভের আশায় কেন তাঁকেই আসতে হয় গৃহস্থের দরজায়! আগামী কাল কার্তিক পুজো— এই উপলক্ষে লিখলেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চারক

Must read

কার্তিক ঠাকুর যেন আমবাঙালির আদরের দুলাল। মায়ের সেই লাজুক ছেলে যার নামও নেই, আবার বদনামও নেই। কার্তিক ঠাকুরকে দেখে মনে হয় বেচারার না আছে কোনও দায় না আছে দায়িত্ব। তাই বুঝি ছেলে ভোলাতে মা পার্বতী আর বাবা বিশ্বম্ভর তাঁকে একটা ভারি মজার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। কেউ একটু কষ্ট করে তাঁকে কোনও নবদম্পতি বা সন্তানহীন দম্পতির দোরে রেখে এলেই ব্যস। একটু নিয়ম মেনে পুজো করতে হবে। এতে কী হবে? কার্তিক ঠাকুর তাঁকে আশীর্বাদ করবেন আর তাহলেই কেল্লা ফতে। মায়ের কার্তিকের আশিসে বাড়িতে আসবে ফুটফুটে শিশু। মনুষ্যকুলে প্রায় গুরুত্বহীন এই দেবতাটির গুরুত্ব এতেই একলাফে বেড়ে গিয়ে একেবারে ছাদে। আসলে এ এক বহু পুরনো লোকাচার। মনে করা হয় বন্ধুবান্ধব বা পরিচিতজনেরা নবদম্পতি বা সন্তান-প্রত্যাশী দম্পতির বাড়িতে যদি কার্তিকের মূর্তি ফেলে আসেন তাহলে সেই কার্তিক ভক্তিসহকারে পুজো করলে দেব সেনাপতি কার্তিকের বরে ফুটফুটে কার্তিক অর্থাৎ পুত্রসন্তান লাভ হয়। আর কোন মা-ই বা চান না তাঁর কার্তিকের মতো সুন্দর ছেলে হোক।
তাই অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে মায়ের সঙ্গে মেয়েদের সঙ্গে বা নারীজাতির মঙ্গলের সঙ্গে কার্তিক জুড়ে রয়েছেন। আবহমানকাল ধরে মায়েদের মনে সুপ্ত মাতৃত্বের ইচ্ছেকে তিনি পূরণ করে আসছেন। কথিত আছে, ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর পুত্রীদের বিয়ে করেন কার্তিক। ব্রহ্মা ও সাবিত্রীর মেয়ে হলেন দেবী ষষ্ঠী। পুরাণ অনুযায়ী, কার্তিকের স্ত্রী হলেন এই দেবী ষষ্ঠী। সন্তানদের রক্ষা করা ও আগলে রাখাই দেবী ষষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য। আবার দেবী ষষ্ঠীর পুজো করলেও সন্তান লাভ হয়। সবটাই খুব সুন্দর একে অপরের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। সেই কারণেই এই বঙ্গে সন্তান লাভের বরপ্রাপ্তির একমাত্র পথ হলেন কার্তিক।
আবার সমাজ থেকে যাতে অন্যায় মুছে যায় তাই অনেকে কার্তিক পুজো করে। কারণ তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমস্ত অপশক্তির বিরুদ্ধে অন্যতম যোদ্ধা হিসাবে লড়াই করেছিলেন।

আরও পড়ুন-কী চাইছেন আসলে সাফ বলুন মোদি-শাহ

নানা নামে কার্তিক
অম্বিকেয়, কৃত্তিকাসুত, কুমার, দেব সেনাপতি, গৌরীসুত, শক্তিপানী— এমন বৈচিত্র্যময় নামের মালিক তিনি। অত্যন্ত সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারা তাঁর এবং তিনি চিরকুমার। তাঁর আরও একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। শুধু সুপুরুষই নন মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধাও তিনি। তাঁকে ঘিরে রয়েছে নানা চমকপ্রদ পৌরাণিক কাহিনি। তিনি দেবাদিদেব মহাদেব ও পার্বতীর পুত্র কার্তিক। তবে দেবাদিদেব মহাদেব ও পার্বতীর পুত্র হলেও ঋষিপত্নী কৃত্তিকা তাঁকে লালনপালন করেছিলেন আর তাই তাঁর নাম হয়েছিল কার্তিক। কথিত আছে, কার্তিকেয় বা কার্তিককে যুদ্ধের দেবতা ও দেব সেনাপতিও বলা হয়। তিনি আবার বিঘ্ননাশক গণেশের সহোদর।
তাঁর জন্মবৃত্তান্ত
পৌরাণিক কাহিনি থেকে জানা যায়, স্ত্রী সতীর দেহত্যাগে শিব অত্যন্ত শোকগ্রস্ত ছিলেন। এর বেশ কিছুকাল পরে জন্ম নিয়েছিলেন পার্বতী। দীর্ঘ ও জটিল পথ পেরিয়ে তাঁর সঙ্গে বিয়েও হয় দেবাদিদেবের। পরিণয়ের পর জগৎ সংসার ভুলে তাঁরা নিজেদের প্রেমেই মত্ত ছিলেন।
যার ফলে জগৎ সংসার বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। এইরকম পরিস্থিতি দেখে দেবতারা অগ্নিদেবকে পাঠান পরিস্থিতি অনুকূল করতে। ঠিক হল তিনি শিবকে অনুরোধ করবেন পুত্রের জন্মদানের জন্য। অগ্নিদেব যখন পৌঁছলেন, তখন শিব পার্বতী কৈলাসের এক গুহায় বাস করছিলেন এবং নিজেদের নিয়ে নিমগ্ন ছিলেন। অগ্নিদেব হঠাৎ সেই গুহায় প্রবেশ করলে হরপার্বতীর প্রবল তেজের কারণে এক প্রকাণ্ড অগ্নিগোলকের সৃষ্টি হয়। মহাদেব তা নিক্ষেপ করলেন অগ্নিকেই। কিন্তু হরপার্বতীর তেজ থেকে উৎপন্ন সেই গোলক অগ্নিদেবও আয়ত্ত করতে পারলেন না। ফলে মা গঙ্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি।
শেষে মা গঙ্গাও সামলাতে না পেরে সেই গোলক জঙ্গলের এক শরবনে ফেলে দেন। এবং সেখান থেকে এক সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর ছ’টি মুখ। এমন সময় ছয় কৃত্তিকা স্নান করতে এসে দেখলেন একটি শিশু পদ্মে শায়িত রয়েছে। তাঁরা শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পালন করতে লাগলেন নিজ সন্তানেরই মতো। ছ’টি মাথা নিয়ে ছয় কৃত্তিকার কাছ থেকে একসঙ্গে স্তন্যপান করেছিল সেই শিশুটি যার জন্য কার্তিকের আরেক নাম ষড়ানন। একটি মতে মানুষের ষড়রিপু দমন করবার জন্য কার্তিকের জন্ম হয় এমনটাও বলা হয়ে থাকে।
ছ’টি মাথা দিয়ে এই বীর যোদ্ধা কার্তিক ষড় রিপুকে (কাম ক্রোধ লোভ মদ মোহ মাৎসর্য) নিয়ন্ত্রণ করার বার্তা দেন। আসল মা-বাবার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েই বড় হয়ে উঠতে লাগলেন কার্তিক।
যত বড় হতে থাকলেন তত শাস্ত্রজ্ঞানী হয়ে উঠলেন কার্তিক। পরে অবশ্য দেবতাদের কাছে কার্তিক তাঁর বংশ পরিচয় জানতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন-শহরের কোথায় কতটা ভূগর্ভস্থ জল খতিয়ে দেখতে সমীক্ষা করবে রাজ্য

কার্তিকের রূপ
মৎস্য পুরাণ ও অগ্নি পুরাণে কার্তিকের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাতে তিনি কখনও দুই হাত যুক্ত, কখনও ছয় ও বারো হাত বিশিষ্ট এবং এক ও ছয় মুখ বিশিষ্ট। মৎস্য পুরাণে আবার এও বলা আছে যে গ্রামে পুজো করতে হলে কার্তিক মূর্তি হবে দুই হাত বিশিষ্ট, শহরে চার হাত বিশিষ্ট এবং মহানগরীতে বারো হাত বিশিষ্ট হতে হবে।
এইসব হাতে শস্ত্র হিসেবে থাকবে শক্তি, পাশ, খড়্গ, শর, শূল, অভয়, ধনুক, পতাকা, মুষ্টি, তর্জনী, তাম্রচুর। তাঁর গায়ের রং হবে সোনা উত্তপ্ত করলে যে রং হয় তেমনি। গরুড় তাঁকে ময়ূর দিয়েছেন বাহন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
তিনি কেন দেব সেনাপতি
পুরাণে বর্ণিত আছে, কার্তিক ছিলেন মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধা। তারকাসুরকে বধ করা দেবতাদের পক্ষে যখন সম্ভব হয়ে উঠছিল না ঠিক সেই সময়ে দৈব বলে প্রাপ্ত অজেয় শক্তির অধিকারী কার্তিক তারকাসুরকে নিধন করেছিলেন। সেই থেকে তিনি দেব সেনাপতি হিসেবে পূজিত হন। স্কন্দ পুরাণে এর উল্লেখ রয়েছে।
কার্তিক চিরকুমার না বিবাহিত
অনেকেই বলে থাকেন চিরকুমার কার্তিক তবে কথাটা নিয়ে মতভেদও রয়েছে। পুরাণ অনুযায়ী, দেব সেনাপতি যখন তারকাসুরকে বধ করে স্বর্গরাজ্য দেবতাদের ফিরিয়ে দেন তখন কৃতজ্ঞতা স্বরূপ নিজের কন্যা দেবসেনার সঙ্গে কার্তিকের বিয়ে দেন দেবরাজ ইন্দ্র। তাই তিনি দেব সেনাপতি। এমনটাও বলা হয়ে থাকে।
আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে, দেবসেনা ছিলেন ব্রহ্মার মানসকন্যা। তিনি হলেন দেবী ষষ্ঠী। অর্থাৎ আরেক মতে, কার্তিকের স্ত্রী হলেন দেবী ষষ্ঠী। দেবী ষষ্ঠীর পুজো করলে সন্তান লাভ হয়। সেই থেকেই কার্তিক পুজোয় নিঃসন্তান বা নবদম্পতিদের বাড়িতে কার্তিক ফেলার চল বলে মনে করা হয়। এখানেই মতভেদের শেষ নয়।
কার্তিকের আরেক স্ত্রীর কথাও বলা হয়েছে— তিনি হলেন দক্ষিণ ভারতের উপজাতি নম্বিরাজের কন্যা বল্লী। মা-বাবার ওপরে অভিমান করে কৈলাস ত্যাগ করেছিলেন কার্তিক।
প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে দক্ষিণ ভারতের পাহাড়ি এলাকায় এসে বাস করতে শুরু করেন তিনি। সেখানকার উপজাতি মানুষরা কার্তিক এবং তাঁর স্ত্রীকে সাদরে গ্রহণ করেন। একদিন এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন একলা কার্তিক, হঠাৎ পাহাড় কেটে শস্য পাহারারত এক কালো মেয়ের প্রেমে পড়েন কার্তিক। সেই প্রেম এতই গাঢ় তখন এক বৃদ্ধের ছদ্মবেশে গিয়ে নাম-পরিচয় জানতে চান কার্তিক। জানা যায়, যুবতী উপজাতি রাজা নম্বিরাজের কন্যা বল্লী।
এরপরই যুবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। বৃদ্ধ বেশে কার্তিকের সেই প্রস্তাব পেয়ে রেগে আগুন বল্লী। বিপদ বুঝে কার্তিক স্মরণ করলেন বিঘ্ননাশকরী দাদা গণেশকে।
গণেশ ভাইয়ের কথায় এক মত্ত হাতির রূপ ধরে আটকে দাঁড়ালেন বল্লীর রাস্তা। মত্ত হাতির ভয়ে তিনি জড়িয়ে ধরলেন সেই বৃদ্ধকে। ভীষণ ভয়ে তার দু’চোখ বোজা। এবার বুদ্ধি করে কার্তিক বললেন এই মত্ত হাতিটাকে তাড়াতে পারলে বল্লী তাঁকে বিয়ে করবেন, নয়তো দু’জনেই মরবেন। প্রাণ বাঁচাতে সেই শর্তে রাজি হলেন বল্লী।

আরও পড়ুন-ইউনুস জমানায় সংকটে নারী-নিরাপত্তা

এরপরই চোখ খুলে দেখলেন বৃদ্ধের জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এক রূপবান যুবক। রূপবান কার্তিকের অনিন্দ্যকান্তি রূপ দেখে মুগ্ধ তিনি। বিয়ের আপত্তির কথা ভুলে গেলেন। বিয়ে হল ধুমধাম করে।
বল্লীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন প্রেমময় ভাবে উপভোগ করার জন্য দক্ষিণ ভারতের ছ’টি জায়গায় ছ’টি শস্ত্রাগার নির্মাণ করেন কার্তিক। সেই শস্ত্রাগারগুলোকে আজ ভারতের সবচেয়ে পবিত্র কার্তিক মন্দির বলে মনে করা হয়। সেগুলো হল পালানি স্বামী মালাই, পাঁঝামুদির চোলাই, থিরুচেন্দুর, থিরুথানি এবং থিরুপ্পা রামকুমারাম। তামিলনাড়ুর রক্ষাকর্তা হিসেবে ও কার্তিককে মানেন ভক্তরা।
দরজায় কেন কার্তিক
সন্তান প্রত্যাশী বা নবদম্পতির দরজায় কার্তিক ফেলার পেছনের ইতিহাস। মহাভারতের কাহিনিতে কার্তিকের নাম স্কন্দ। তিনি যেই ছয় কৃত্তিকার দ্বারা লালিত-পালিত হন তাঁরা প্রত্যেকেই ঋষি পত্নী। কিন্তু ঋষিরা কার্তিককে মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের ধারণা ছিল যে কৃত্তিকাদের অন্য পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ থাকাতেই কার্তিকের জন্ম হয়েছে। এই সন্দেহে তাঁরা কৃত্তিকাদের তাড়িয়ে দেন।
বিতাড়িত কৃত্তিকাদের মায়ের সম্মান দেন কার্তিক এবং নিজের পুজো প্রচারের কাজে লাগান।
প্রচারের কাজটা তিনি করেন একটু বাঁকা পথে। তিনি কৃত্তিকাদের বলেন যে, যে ছেলেমেয়েদের বয়স ষোলো পার হয়নি তাদের নানারকম অনিষ্ট করতে। সেইসঙ্গে নিজের অনুগত যেসব গন কিংবা অপদেবতা ছিল তাদের আদেশ দিলেন মহিলাদের গর্ভস্থ ভ্রূণ নষ্ট করতে। তাদের সম্মিলিত আক্রমণে সংসারের মানুষের পুত্র-কন্যা হারিয়ে হাহাকার রব উঠল। আর ঠিক তখনই প্রচারিত হল যে কার্তিকের পুজো করে তাঁকে তুষ্ট করলে সমস্ত বিঘ্ন নাশ হবে এবং অপুত্রক পুত্র পাবে।
তখন থেকেই সন্তান কামনায় ও সন্তানের মঙ্গল প্রার্থী মা ও পরিবারের কাছে পূজনীয় হয়ে উঠলেন কার্তিক। সন্তানের মঙ্গল প্রতিষ্ঠার দেবতা হিসেবে পরবর্তীকালে কার্তিকের মূর্তি গৃহস্থের দরজায় ফেলার প্রবণতা শুরু হল।
দরজায় ফেলা কার্তিককে পুজো না করে বিসর্জন দিলে বা উপেক্ষা করলে যদি সন্তান-সন্ততির ক্ষতি হয় সেই আশঙ্কা থেকেই কার্তিক পুজো করতেই হবে এমন ধারণার জন্ম।
ক্রমশ দেব সেনাপতি থেকে সন্তান-সন্ততিদের রক্ষাকারী দেবতা হয়ে ওঠেন কার্তিক। আবার স্ত্রী ষষ্ঠী দেবী ও শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী। এমনটাই প্রচলিত বিশ্বাস সমাজে সংসারে। উত্তর ভারতে তিনি মহাসেন এবং কুমার হিসেবে পূজিত হন। দক্ষিণ ভারতে তামিলনাড়ু রাজ্য ও দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য অংশ এবং শ্রীলঙ্কা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মরিশাসে তিনি মরুগান নামে পূজিত হন। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ ভারতে কার্তিক পুজোর আধিক্য দেখা যায়। তামিল ভাষায় কার্তিক ঠাকুর মরগান বা ময়ূরীস্কন্দ স্বামী নামে এবং কন্নড় ও তেলুগু ভাষায় তিনি সুব্রহ্মণ্যম নামে পরিচিত। তামিল বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি অর্থাৎ মরগান তামিল দেশের রক্ষাকর্তা। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাংশে কার্তিকের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত কথারাগম (সিংহলি ভাষায় কথারাগম দেবালয়) এই মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে হুগলি জেলার চুঁচুড়া, বাঁশবেড়িয়া, কাটোয়া অঞ্চলের কার্তিক পুজো বিখ্যাত। দক্ষিণ ভারতের ষড়ানন কার্তিক অত্যন্ত জনপ্রিয় দেবতা। কিন্তু এই দেবতারই পুজো এই বঙ্গে কতকটা যেন ফিকে। শৌর্য-বীর্যের প্রতীক দেবতাদের সেনাপতি পৌরাণিক আখ্যানের নায়ক কার্তিক আজ জনপ্রিয়তায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে। হুগলি, নদিয়া, বর্ধমান এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কিছু অঞ্চল ছাড়া দেব সেনাপতিকে বেশ কিছুটা অবহেলিতই বলা যায়।
বাংলার ঘরে ঘরে কার্তিক ঠাকুর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিঃসন্তান দম্পতির সন্তান উৎপাদনের জন্য পালিত উপাচার মাত্র। এই সংস্কার ও বিশ্বাস থেকে ময়ূরবাহন বিক্ষিপ্তভাবে বাংলায় পুজো পেলেও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের কার্তিক কিন্তু আজও খুবই জনপ্রিয় দেবতা।
এ-ছাড়া গণিকা সমাজেও কার্তিক পুজো খুব সমাদৃত। আজও বর্ধমানের কাটোয়ার যৌনপল্লিতে কার্তিকের আরাধনা করা হয়।

আরও পড়ুন-কান্দিতে SIR-আতঙ্কে আত্মঘাতীর পরিবারের পাশে আছে তৃণমূল

সমাজতত্ত্ববিদদের মতে, সেখানকার উপেক্ষিত গণিকাদের কাছে কার্তিক ঠাকুর পৌরুষ ও বীরত্বের প্রতীক। তাই দেব সেনাপতির মধ্যেই তাঁরা বেঁচে থাকার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্য আরেকটি মতে, বিবাহবঞ্চিতা এই নারীরা কার্তিকের মধ্যে তাঁদের কল্পিত জীবনসঙ্গীকে দেখতে পান। তবে এ-বিষয়ে আরেকটিও মত আছে। অতীতে জলপথ ছিল যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম।
নদীর তীরে হাট-বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্য উৎসব অনুষ্ঠান পুজো, বিদেশি সওদাগরদের আনাগোনায় সেইসব জায়গায় জমজমাট থাকে। স্বাভাবিকভাবে বিদেশে সওদাগরদের মনোরঞ্জনের জন্য নদীর ধারের বন্দর। শুধু নদীতে জলপথে ছিল যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। নদীর তীরে হাট-বাজার ব্যবসা-বাণিজ্য উৎসব-অনুষ্ঠান ও পুজোর জন্য হত বিদেশি সওদাগরদের আনাগোনা। স্বাভাবিকভাবে বিদেশি সওদাগরদের মনোরঞ্জনের জন্য নদীর ধারে গণিকাদের দেখা মিলত। এই বন্দরবাসী গণিকারা বিভিন্ন দেবতাদের মধ্যে থেকে কার্তিককেই তাঁদের উপাস্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ অন্য দেবতাদের পুজো করার অধিকার তাঁদের ছিল না।
দেবতা হিসেবে কার্তিক কিন্তু বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। কোথাও তিনি স্বর্গের সেনাপতি, কোথাও বীর যোদ্ধা, কোথাও আবার সন্তান ধারণের প্রতীক। তবে, রূপ বিভিন্ন হলেও সন্তান উৎপাদনের দেবতা হিসেবেই কার্তিক আধুনিককালে তাঁর অস্তিত্ব বজায় রেখেছেন।

Latest article