বিশ্বকাপের সোনার মেয়েরা

২০২৫-এ মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভারত। বাইশ গজে ইতিহাস গড়ল অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌরের ব্লু ব্রিগেড। দশকের পর দশক ধরে চালিয়ে-যাওয়া লড়াইয়ের ফসল এই জয়। অনেক অবহেলা, উপেক্ষা, বিতর্কের ঊর্ধ্বে নারী আজ অর্ধেক নয়, সম্পূর্ণ আকাশ। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

সাল ২০২৪। রোহিত শর্মার নেতৃত্বে ভারতীয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দল চ্যাম্পিয়ন হল। বিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে চ্যাম্পিয়ন দলকে দেওয়া হল ১২৫ কোটি টাকা। এখানেই শেষ নয়, বিশ্বকাপ জয়ের পর খোলা বাসে সূর্যকুমার যাদবদের নিয়ে ভিকট্রি প্যারেড করা হল। মেরিন ড্রাইভ থেকে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সেই দীর্ঘ শোভাযাত্রায় হাজার হাজার ভক্ত উপস্থিত থাকলেন। করতালি আর স্লোগানে গমগম করছিল চারপাশ। সেই দিনটি আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

আরও পড়ুন-শহরের কোথায় কতটা ভূগর্ভস্থ জল খতিয়ে দেখতে সমীক্ষা করবে রাজ্য

সাল ২০২৫। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ। মহিলাদের ওডিআই বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্ব। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে হরমনপ্রীত, রিচা ঘোষ, জেমাইমা রডরিগেজ, শেফালি ভার্মা, দীপ্তি শর্মা, স্মৃতি মান্ধানার ব্লু ব্রিগেড ৫২ রানের জয় ছিনিয়ে নিল। কিন্তু মহিলা বিশ্বকাপজয়ী সেই দলকে নিয়ে হল না কোনও স্মরণীয় ভিকট্রি প্যারেড। ক্রিকেট তারকারা যে যাঁর নিজের শহরে ফিরলেন। সেখানে সাধ্যমতো ঘরোয়া সম্মানও পেলেন। কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ী মহিলা দলের সংবর্ধনাপর্ব তেমন করে স্মরণীয় হয়ে রইল না। তাহলে কি নারী তুমি অর্ধেক আকাশ বলে যে পুরুষতন্ত্র সোচ্চার তাঁরাই কোথাও সেই বৈষম্য ধরে রাখলেন!
নারী বনাম পুরুষ-পুরুষ খেলাটা তো আজও আমাদের মজ্জায়। মেয়েরা আবার ক্রিকেট খেলে নাকি! ও সব মহিলাদের মানায় না। কোথায় লেগে যাবে। পরে সমস্যা হবে। বাচ্চাকাচ্চা হবে না। সংসারে অশান্তি। কথাগুলো খুব চেনা। তাই হয়তো কোহলি আর রোহিতদের সঙ্গে হরমনপ্রীত-মান্ধানাদের বার্ষিক চুক্তিতেও একটা বিরাট ফারাক রয়েছে। পুরুষ ক্রিকেটারদের মতো এ প্লাস ক্যাটাগরি নেই মহিলাদের। সবটারই হয়তো কোনও না কোনও যুক্তি থাকবে কিন্তু সমাজে সেই নারী বনাম পুরুষ, পুরুষের অগ্রাধিকার, পুরুষ সব পারে এই ভাবটা ফল্গুধারার মতো চলতেই থাকছে।
বঞ্চনার ইতিহাসের ভাগ্যজয়
কিন্তু এমন ধুন্ধুমার লড়াই তো মেয়েরা লড়েছেন আগেও। কপিল দেব, সুনীল গাভাসকরদেরও আগে। আমরা ক’জনই বা তা জেনে বসে আছি। ১৯৭৮ সালে কপিল দেব টিমের বিশ্বজয়ের পাঁচ বছর আগেই ভারতেই আয়োজিত হয়েছিল মহিলা বিশ্বকাপ। সেটা ছিল মহিলাদের প্রথম বিশ্বকাপ। ক্রীড়া সংগঠক মহেন্দ্রকুমার শর্মার কঠিন প্রচেষ্টায় তা সম্ভব হয়েছিল। হঠাৎ একদিন রেলস্টেশনে তিনি কিছু মেয়েকে ক্রিকেট খেলতে দেখে ভাবলেন, এদেরও একটা সংগঠন দরকার। সেখান থেকেই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট সংগঠনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৭৩ সালে তৈরি করেন উইমেন্স ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (WCAI)।
‘কন্যাওঁ কি ক্রিকেট হোগি, জরুর আঁয়িয়ে’
(মেয়েদের একটি ক্রিকেট ম্যাচ হবে, আসুন)
লখনউয়ের রাস্তায় একটা অটোরিকশায় করে ঘুরে ঘুরে মহেন্দ্রকুমার শর্মা মাইক্রোফোনে এই ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় ২০০ জন কৌতূহলী মানুষ সেই ম্যাচ দেখতেও এসেছিলেন। খেলা দেখা নয়, সেদিন মেয়েরা কী পোশাক পরে ক্রিকেট খেলে সেটাই দেখতেই এসেছিলেন তাঁরা! সেই পোশাক কেমন-কী সেই বিচারও করেছিলেন তাঁরা। সেই প্রথম মহিলা বিশ্বকাপের অধিনায়ক ছিলেন শান্তা রঙ্গস্বামী।
মেয়েরা ক্রিকেট খেলবে, এমনটা বিশ্বাস করাও তখন ছিল ‘অপরাধ’। সংস্কারে বিদ্ধ সমাজে পুরুষপ্রধান যে কোনও ক্ষেত্রেই বিশেষ করে খেলায় বরাবর মেয়েরা ব্রাত্য। তাই শান্তা রঙ্গস্বামীদের তখন অসংরক্ষিত কোচে যেতে হত বিভিন্ন শহরে খেলতে। ট্রেনে টয়লেটের পাশেই ঘুমোতেন তাঁরা। ডরমিটরির মেঝেতে ঘুমোতে হত। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজেদেরই বইতে হত। ক্রিকেট কিট পিঠে ব্যাকপ্যাকের মতো বেঁধে রাখা হত। এক হাতে থাকত স্যুটকেস। সেই প্রতিকূলতা মাথায় করেই খেলেছিলেন তাঁরা প্রথম বিশ্বকাপ। এর ১৯ বছর পর১৯৯৭ সালে আবার মহিলা বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। সেবার সেই মহিলা দলের জন্য সেমিফাইনালে পৌঁছেও যায় ভারত। কিন্তু শেষমেশ জেতা হয়নি। তবুও কলকাতার ইডেনে ফাইনাল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন মেয়েরা— যেখানে তাঁদের জন্য প্যাভিলিয়নে জায়গা হয়নি! দর্শকদের সঙ্গে গ্যালারিতেই বসতে হয়। ফাইনালের সময় মাঠে ঢোকার চেষ্টা করলে গেটে আটকে দেওয়া হয়। এই তো সেদিনের কথা। মিতালি রাজের মতো ক্রিকেটারও একসময় ট্রেনে চেপে রাজ্য থেকে রাজ্যে যেতেন ম্যাচ খেলতে। দিন বদলেছে আর একটু একটু করে হালকা হয়েছে মনের অন্ধকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও নারী বনাম পুরুষের সেই দ্বন্দ্ব মেটেনি।
২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-এর নির্দেশে অনিচ্ছা সহকারে মহিলাদের দলকে নিজের আওতায় আনে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। ২০১৫ পর্যন্ত কোনও ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার কেন্দ্রীয়ভাবে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন না।
কাজেই হরমনপ্রীত, রিচা, দীপ্তি জেমাইমা, শেফালিদের এই বিপুল গর্বের জয় দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা সেই লড়াইয়ের মুকুটে একটা ময়ূরপুচ্ছ। যুগের পর যুগ নিরন্তর হতে থাকা অবিচার, অপমান,অবহেলার জবাব। যে-দেশে নারী পাচার, শিশুকন্যা পাচার আম ঘটনা, যে-দেশে বাল্যবিবাহ স্বাভাবিক নিয়ম, সেই দেশে ব্যাট আর বল হাতে মেয়েদের ময়দানে নামাটাই তো অলীক কল্পনা! সেই দেশের সেরা মহিলা ক্রিকেটার হয়ে ওঠার লড়াই করতে হয় ঘরে-বাইরে, মাঠে-ময়দানে সর্বত্র।

যাঁরা ফেরালেন ভাগ্য
অধিনায়ক হরমন
বিতর্ক পিছু ছাড়ে না তাঁর। ২০২৫ সালের আইসিসি মহিলা ওয়ান ডে বিশ্বকাপে ভারতের ঐতিহাসিক জয়ের একদিন পরই তাঁকে নিয়েই নতুন বিতর্ক। প্রাক্তন অধিনায়ক শান্তা রঙ্গস্বামী বলেছেন, ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের ভবিষ্যৎকে আরও শক্তপোক্ত করার স্বার্থে হরমনপ্রীত কৌরের উচিত অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়ানো। এ-কথাই মিডিয়ায় প্রকাশ।
তাঁর মতে, ৩৬ বছরের হরমন ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ও ফিল্ডার হলেও নেতৃত্বের চাপে তাঁর স্বাভাবিক খেলা প্রভাবিত হচ্ছে। এ কেমন বিচার! পাঞ্জাবের মোগা নামের ছোট্ট শহরের মেয়ে হরমনপ্রীত কৌর। কোমরে ওড়না বেঁধে ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন হরমন। হরমনপ্রীত যখন পাঞ্জাবের দারাপুরে জ্ঞান জ্যোতি সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তখন একটি ছক্কা মেরে মাঠের বাইরের একটি বাড়ির জানালা ভেঙে দেন। কোচ কমলদীশ পাল সিং সোধির তাঁকে দেখে এতটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে তাঁর মধ্যে লুকিয়ে আছে অগাধ সম্ভাবনা। বাবা হরমন্দর সিংয়ের সামর্থ্য ছিল না তাঁকে ক্রিকেট কোচিং-এ ভর্তি করার। কমলদীশ আশ্বস্ত করেন তাঁর কোচিংয়ে ভর্তি হতে কোনও টাকা লাগবে না। এমনকী প্রত্যেকদিন হরমনপ্রীতকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে যেতেন তিনি। এই ভাবে ক্রিকেট জার্নি শুরু তাঁর। বাবার কিট ব্যাগে একটা ব্যাট থাকত। একদিন বাবা বড় ব্যাট কেটে হরমনের জন্য একটা ছোট ব্যাট বানিয়ে দেন। বিশ্বজয়ী হরমন হাল ছাড়েননি কখনও।
ব্যাটে-বলে দাপুটে শেফালি
এ যাকে বলে ভাগ্যের ফের। বিশ্বকাপে হরমনপ্রীত কৌরদের দলে খেলার সম্ভাবনাই ছিল না তাঁর। মহিলাদের একদিনের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলে সুযোগ পাননি শেফালি ভার্মা। রিজার্ভ ক্রিকেটারদের তালিকাতেও ছিল না তাঁর নাম। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফিল্ডিং করতে গিয়ে পায় চোট পেয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গেলেন ওপেনার প্রতিকা রাওয়াল। স্মৃতি মান্ধানা আর প্রতিকা রাওয়াল, ওপেনার জুটি তখন সেরা ফর্মে। কিন্তু উপায় নেই কোনও। বিপাকে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের আগে পরিবর্ত হিসাবে শেফালি ভার্মাকে দলে নিলেন নির্বাচকরা। শাপে বর হল। ফাইনালে তাঁর ব্যাট-বলের দাপটে বিশ্বজয়ী হল ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। হরিয়ানার রোহতকের মেয়ে শেফালিকে সবসময় ক্রিকেট খেলতে হয়েছে ছেলেদের সঙ্গেই। কারণ ওখানে মহিলাদের ক্রিকেট খেলার কোনও সুযোগ ছিল না। তবু তিনি খেলা ছাড়েননি। আর সেই চেষ্টাই সফল হল।
তারকা ওপেনার স্মৃতি
ভারতীয় দলের তারকা ওপেনার এবং সহ-অধিনায়ক স্মৃতি মান্ধানা। ক্রিকেট আর পরিবার— এই দুটোই জগৎ তাঁর। মহারাষ্ট্রের সাংলির মেয়ে স্মৃতি ছোট থেকেই বাবা শ্রীনিবাস মান্ধানা ও দাদা শ্রবণ মান্ধানার ক্রিকেট খেলা দেখে বড়ে হয়ে উঠেছেন। দাদার মতো স্মৃতিরও স্বপ্ন ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। ৯ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৫ দলে জায়গা পান। ১১ বছর যখন বয়স তখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেন স্মৃতি। তাঁর বাবা শ্রীনিবাস একজন কেমিক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর। এর পাশাপাশি মেয়ের ক্রিকেট-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ের দেখভাল করেন। স্মৃতির মা স্মিতা তাঁর ডায়েটিং, জামাকাপড় এবং অন্য বিষয়গুলির দেখাশোনা করেন। বিশ্বের প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে এক বছরে ৪টি সেঞ্চুরি করার নজির গড়েছেন স্মৃতি এবছর। মেয়েদের আইসিসি র্যা ঙ্কিংয়ে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি শীর্ষ তিন ব্যাটারের একজন। ভারতের মহিলা ক্রিকেটে এক দিনের ম্যাচে দ্রুততম শতরানের রেকর্ড স্মৃতিরই। নিজেকে শুধু তারকা হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করেননি, হয়ে উঠেছেন ব্র্যান্ড।

আরও পড়ুন-মায়ের কার্তিক

ছোট মাহি রিচা
২২ বছরের বিশ্বজয়ী রিচা ঘোষের নামে ক্রিকেট স্টেডিয়াম গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। উইকেটকিপার এবং ব্যাটার সোনার মেয়ে রিচা হাতে পেয়েছেন সোনার ব্যাট-বল। সেই সঙ্গে রাজ্য পুলিশের ডিএসপি পদে নিয়োগপত্র দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, দেওয়া হয়েছে ‘বঙ্গভূষণ’ সম্মান। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো ছক্কা হাঁকাতে ভালবাসেন বলে সতীর্থদের অনেকেই তাকে ‘ছোট মাহি’ বলে ডাকেন। ঝুলন গোস্বামী আবিষ্কার করেছিলেন রিচাকে, সেই সালটা ছিল ২০১৩। একদম ছোটবেলায় দৌড়ঝাঁপ, গাছে চড়তে ওস্তাদ ছিলেন রিচা। গাছ থেকে পড়ে গেলে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াতেন। ডানপিটে রিচার ক্রিকেট-গুরু তাঁর বাবা মানবেন্দ্র ঘোষ। একটা সময়ে বাবা নিজেও ক্রিকেট খেলতেন। চার বছর বয়সেই মেয়েকে বাড়ির সামনে বাঘাযতীন ক্লাবে এনে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে লড়াই শুরু। তখনও গোটা সমাজের উনিশ-বিশ একই চিত্র। শিলিগুড়িতে মেয়েদের ক্রিকেট খেলার সুযোগ খুব কম। আর মেয়েদের কোচ পাওয়া তো দুঃসাধ্য। ফলে পুরুষ কোচ এবং ছেলেদের সঙ্গেই ক্রিকেট খেলতে হত রিচাকে। সেই দলে চারবছরের রিচা একাই মেয়ে। রিচার ধ্যানজ্ঞান ছিল শিলিগুড়ি কলেজ মাঠ। সকলে গেট দিয়ে খেলার মাঠে ঢোকে। এই মেয়ে কোমর সমান বাউন্ডারি এক লাফে পার হয়ে মাঠে ঢুকতেন। সারাদিন পড়ে থাকতেন মাঠে। বাঘাযতীন ক্লাবের কোচিংয়ের বাইরে বাবার কাছে নিয়মিত ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বাংলা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান। এহেন ডানপিটে বঙ্গকন্যা পাঁচটি উইকেট হারিয়ে ভারত যখন একটু ব্যাকফুটে তখন ব্যাট হাতে ময়দানে নেমে করলেন বাজিমাত। দেশের উইকেটকিপার-ব্যাটার রিচা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৯৪ রানের ইনিংস উপহার দিয়েছেন। ৮ নম্বরে নামা কোনও ব্যাটারের করা সর্বাধিক রান এটাই।
অলরাউন্ডার দীপ্তি
যে মেয়েটিকে আক্ষরিক অর্থেই একসময় বলা হয়েছিল যে মেয়েরা ক্রিকেট খেলতে পারে না। তিনি হলেন এই মুহূর্তে টিম ইন্ডিয়ার অলরাউন্ডার সেরা পারফর্মার দীপ্তি শর্মা। মুরাদাবাদের এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে দীপ্তি। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি অদম্য আকর্ষণ। দীপ্তি যখন অলি-গলিতে ছেলেদের সঙ্গে খেলে বেড়াতেন তখন ওঁকে বলা হত এটা ছেলেদের খেলা, মেয়েরা এসব করে না। কিন্তু দীপ্তি সে-কথা কানে তোলেননি। দাদা সুমিতের সঙ্গে রোজ মাঠে যেতেন অনুশীলনে। একদিন বাউন্ডারি লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন দীপ্তি। কোনও কিছু না ভেবেই বল নিয়ে ছুঁড়লেন আর সেই বল মাঠ পেরিয়ে বাইশ গজের কাছে। দাদা দেখে অবাক। তাঁর উত্থানে রয়েছে দাদা সুমিতের আত্মত্যাগ। সুমিত কানপুরের একলব্য স্পোর্টস স্টেডিয়ামে দীপ্তিকে নিয়মিত অনুশীলনে নিয়ে আসা শুরু করেন। সেই অসম্ভবের স্বপ্নকে সত্যি করে তুলতে নিরলস চেষ্টা করে গেছেন দীপ্তিও। জুতো ছিঁড়ে যেত, বল কেনার টাকা থাকত না, পুরনো বল সেলাই করে খেলেছেন দীপ্তি! বৃষ্টির দিনগুলোয় মাঠ যখন জলে ডোবা তখন ঘরে বসে প্র্যাকটিস করতেন।

আরও পড়ুন-জালিয়াতির অভিযোগে ভারত ও বাংলাদেশের জন্য এবার গণভিসা বাতিল করতে চায় কানাডা

সেরা ইনিংসে জেমাইমা
ওয়ার্ল্ড কাপ সেমিফাইনালে ভারতের হয়ে ম্যাচ জেতানো ইনিংসটি খেলেছেন জেমাইমা রডরিগেজ। আবার চূড়ান্ত বিতর্কের মুখেও পড়েছেন তিনি। ১২৭ রানের অনবদ্য ইনিংস শেষে চোখ ভরা আনন্দাশ্রু নিয়ে যিশুকে ধন্যবাদ জানিয়েই করে ফেলেছিলেন যত বিপত্তি। এই ক্লিপিং দেখার পর ধর্মের বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নেটিজেনরা। কিন্তু তাতে কী! জেমাইমা বলেন, ‘‘প্রতিটি ম্যাচের আগে আমি প্রার্থনা করি। ঈশ্বর আমাকে শান্ত থাকতে শেখান। যখন আমি ব্যর্থ হই, তখনও আমি জানি, তিনি আমার পাশেই আছেন।’’ ছোট থেকেই জেমাইমা খুব আবেগপ্রবণ আর ঈশ্বরকেন্দ্রিক। বাবা ইভান রডরিগেজ নিজে একজন ক্রিকেট কোচ ছিলেন, যিনি মেয়েকে মাঠে নামতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সমাজের অনেকেই সেই সময় প্রশ্ন তুলেছিলেন— একটা মেয়ে কেন ক্রিকেট খেলবে? কিন্তু জেমাইমার বাবা ইভান সেই কথায় কান দেননি। আর জেমাইমা শুনেছেন নিজের মনের কথা। সকাল থেকে রাত অবধি শুধু অনুশীলন। স্কুলের পরেও ব্যাট হাতে নেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করতেন তিনি। এইভাবেই গড়ে উঠেছিল এক ভবিষ্যতের তারকা। এঁরা ছাড়াও রয়েছেন গোটা টিম ইন্ডিয়ার নারীবাহিনী যাঁরা প্রত্যেকেই এক-একজন তারকা। তাঁদের কথা লিখতে গেলে হয়তো তৈরি হয়ে যাবে ছোটখাটো ইতিহাস। সেই তারকারাও কাধে কাঁধ মিলিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন দেশকে আর ছিনিয়ে এনেছেন জয়।

Latest article