রবিবারের গল্প: ‘দারুণ’

অফিস যাব। মেট্রো রেলের সব কম্পার্টমেন্টে উপচে পড়া ভিড়।

Must read

তন্ময় মজুমদার
অফিস যাব। মেট্রো রেলের সব কম্পার্টমেন্টে উপচে পড়া ভিড়। গুঁতোগুঁতি করে ভিড় কম্পার্টমেন্টেই উঠে পড়লাম। কপাল ভাল, আমার সামনে দাঁড়ানো এবং বসে থাকা কয়েকজন যাত্রী পরের স্টেশনে নেমে যাওয়ায় বসবার সিটও পেয়ে গেলাম। আমার নামার দেরি আছে। চোখ বুজে বসেছিলাম। হঠাৎ তন্দ্রায় ব্যাঘাত এল। কর্কশ চেঁচামেচি। সামনের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ানো একটি মহিলা— কণ্ঠস্বর, খুব উত্তেজিত। তিনি কাউকে বলছিলেন, আপনি এত অসভ্য কেন?
এক পুরুষ কণ্ঠ উত্তর দিল, ভিড় ট্রেনে এত ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার অচল। আপনার উচিত ছিল ভিড় কমলে ট্রেনে ওঠা।
মহিলা কণ্ঠস্বর এবার আরও উত্তেজিত। বলছিলেন, এই কম্পার্টমেন্টে আরও কত পুরুষ যাত্রী। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শুরুতে ভাবলাম ভিড়ের চাপ সহ্য করতে পারছেন না। তাই ডাইনে সরলাম, বাঁয়ে সরলাম, এগিয়ে-পিছিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু উপোসী ষাঁড়ের মতো আপনি আমার শরীরের সঙ্গে একই রকম লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকছেন।
কম্পার্টমেন্টে গিজগিজ ভিড়, প্রচুর পুরুষ-মহিলা। সবাই মোটামুটি উদাসীন। অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা চেঁচামেচির জায়গা থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বাড়িয়ে দাঁড়াল। ট্রেন বাসের ভিড়ে এসব নতুন নয়। পুরুষরা ভিড়টাকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে— যেন কোনও ইচ্ছে ছিল না, ভিড়ের জন্যই কাছাকাছি থাকা মহিলাটির এখানে-ওখানে হাত-টাত রেখেছে। আবার মহিলারাও সুবিধাজনক অবস্থানে দাঁড়ানোর জন্য শরীরে শরীর লাগিয়ে জায়গা বার করে নেয়। চোখ বুজে অপেক্ষায় ছিলাম, চেঁচামেচি থামলেই আরেকটু ঝিমিয়ে নেব। হঠাৎ পুরুষটি হুঙ্কার দিল, আপনার এত অসুবিধা হলে সামনের স্টেশনে নেমে অ্যাপ ক্যাব নিন। ভিড়ে এসব অসুবিধা একটু মানিয়ে নিতে হয়।

আরও পড়ুন-লেখকদের লেখক কমলকুমার

আমি এমনিতে শান্তিপ্রিয় নাগরিক। মনে হয়, সকালে খাওয়ার পর হাইপ্রেসারের ওষুধ খেতে ভুলে গিয়েছিলাম। সটান দাঁড়িয়ে লোকটাকে বললাম, অ্যাপ ক্যাব নিয়ে আমরা অনেকেই অফিস যেতে পারি। সেভেন্থ পে কমিশন আমাদের সেই সামর্থ্য দিয়েছে। কিন্তু যাই না কেন?
লোকটা ঘাবড়ে গিয়েছিল সম্ভবত। চুপ করে আমাকে মাপছিল। প্রশ্নের উত্তর আমিই দিয়েছিলাম৷— কারণ খরচ বাঁচাই।
তারপর আরও কিছুটা গলা চড়িয়ে বলেছিলাম, ফাজলামি পেয়েছেন? বদমায়েশি করবেন আপনি। আর ভদ্রমহিলাকে গুনাগার দিয়ে অ্যাপ ক্যাবে খরচ করতে হবে?
জানি না, পরের স্টেশন লোকটার গন্তব্য ছিল কি না! কিন্তু, হাবভাবে বোঝাল জায়গামতোই ও নেমে যাচ্ছে। লোকটা নেমে যাওয়ার পর আমি আবার চোখ বুজলাম। যতটুকু বিশ্রাম নেওয়া যায়!

[২]
আমি ইন্ডিয়ান রেলের কর্মী। রিজার্ভেশন কাউন্টারে রিলিভারের অপেক্ষায় বসে ছিলাম। অনেকক্ষণ কোনও যাত্রী আসেনি। ঝিমুনি এসেছিল। হঠাৎ কাউন্টারের ওপারে মেয়েলি গলার স্বর। আড়মোড়া ভেঙে তাকাই। দুটো চোদ্দো-পনেরো বছরের কিশোরী। একজন বলল, দুটো মুম্বই সেন্ট্রাল স্টেশনের টিকিট দিন। রিজার্ভড সিট। কত টাকা লাগবে?
বেশ বেপরোয়া কথা বলার ভঙ্গি। ভাল করে জরিপ করলাম দু’জনকে— দামি আধুনিক পোশাক, পিঠে ব্যাকপ্যাক। সঙ্গে দুটো মাঝারি ট্রলি ব্যাগ। কাউন্টারের ওপার থেকেও পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে ঝাপটা মারছিল। আমি সাংসারিক মানুষ। সন্তানের বাবাও। একটা উদ্বেগ আমাকে চেপে ধরল। ভাবলাম, দুটো কিশোরী কোনও ভুল করছে না তো! কিংবা মেয়েদুটোর কোনও দুর্বলতার সুযোগে মানব পাচারের সম্ভবনা নেই তো? যতদূর সম্ভব মিষ্টি স্বরে ওদের বলেছিলাম, রিজার্ভেশনের ফর্ম ফিল আপ করতে হবে। আইডি প্রুফের ফটো কপি লাগবে। সেসব রেডি আছে? না থাকলে ভিতরে এসো। আমি সাহায্য করব।
কিশোরীদুটো দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল। চোখে-চোখে কথা বলল। তারপর একটু সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সন্তর্পণে আলোচনা করল। আমি ধুলো জমে অস্বচ্ছ হয়ে যাওয়া কাচের এপার থেকে সব লক্ষ করছিলাম।

আরও পড়ুন-জঙ্গলরাজ তৈরি করেছেন মোদি : কল্যাণ

কিছু সময় পর ওরা এগিয়ে এসে জানতে চায় ভিতরে ঢোকার দরজা কোথায়? আমি বলবার পর সেদিকে সরে যায়। সময় নষ্ট করি না। ভিতরে থাকা এক সহকর্মীকে বলি, একটা সন্দেহজনক কিছু ঘটতে পারে। তুই আরপিএফ-এর কম্যান্ডান্টকে বল নিজে আসতে। কিংবা রেসপন্সিবল কাউকে পাঠাতে।
ওরা ভিতরে ঢুকেই বলেছিল, ফর্ম দিন।
ঠিক কিশোরী নয়, সদ্য যুবতী বলা যায়। মুখ আর গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। অবশ্যই সুশ্রী। কিন্তু কথা ও হাবভাবে বেশ বেপরোয়া। মিষ্টতার সঙ্গে বললাম, আগে চেয়ারদুটো টেনে বসো। জল খাও। আধার কার্ড দাও। ওগুলো ফটোকপি করতে হবে। এখন তো আইডি প্রুফ ছাড়া রেল, প্লেনের টিকিট হয় না।
ওরা ব্যাকপ্যাক খুলে হয়তো আধার কার্ড বার করছিল। সেই অবকাশে দেখলাম দু’জনের ব্যাকপ্যাক সোনার গয়না আর টাকার বান্ডিলে ঠাসা। এছাড়াও মনে হল এদের মুখ ও গড়ন একরকম। হয়তো দু’বোন। একদম নিশ্চিত হয়ে গেলাম, মেয়ে দুটোর ব্যাপার স্বাভাবিক নয়। আরপিএফ-এর কম্যান্ডান্ট কিংবা অন্য কোনও রেল পুলিশের লোক কখন আসবে, জানি না। একটু সময় নেওয়ার জন্য বললাম, তোমরা চা কিংবা অন্য কিছু খাবে? তোমাদের খুব শুকনো দেখাচ্ছে।
একটি মেয়ে সামান্য ঘাড় বেঁকিয়ে বলল, আননেসেসারি ইন্টারেস্ট ইজ নট গুড। আপনি টাকা নিয়ে দুটো টিকিট কেটে দিলেই অবলাইজড হব।
এমন সময় আমার সহকর্মী পুলিশ নিয়ে হাজির। স্বয়ং কম্যান্ডান্ট সাহেব নিজেই এসেছেন। আমার সহকর্মী বসবার জন্য একটা চেয়ার টেনে দেয়। রিলিভার এসে যাওয়ায় তাকে জায়গা ছেড়ে আরেকটা চেয়ার টেনে কাছাকাছি বসি। আইনত আমার দায়িত্ব শেষ। এখন অপেক্ষা রহস্যের মোড়ক খোলা। সেটুকু দেখে মেট্রো রেলে বাড়ি ফিরব।
ব্যাকপ্যাক দুটোর মুখ খোলা ছিল। কম্যান্ডান্ট সাহেব অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে ভিতরের টাকা-গহনার সম্ভার দেখে বললেন, তোমরা কার বাড়িতে আয়ার কাজ করতে? সেখান থেকে টাকা-গয়না চুরি করার জন্য এখনই তোমাদের অ্যারেস্ট করব।
কথাগুলো বলেই তিনি নিজের মোবাইল ফোন থেকে কাউকে দুটো লেডি কনস্টেবল পাঠানোর জন্য আদেশ করলেন।
দুটো মেয়েই প্রবল ঘাড় নেড়ে কম্যান্ডান্টের কথায় আপত্তি জানিয়ে বলল, আমরা দুই বোন। কেন আয়ার কাজ করব? আমাদের বাড়িতে দুটো সবসময়ের কাজের লোক আছে। চোর-ডাকাত নই। মুখ সামলে কথা বলুন।
— পাঁচটা কাজের লোক থাকলেও বাড়ির ছেলেমেয়েরা চোর হতে পারে। এসব অনেক দেখেছি। এত গয়না-টাকা কোথা থেকে চুরি করলে?
— এসব আমাদের বাড়ির গয়না-টাকা।
— তা, বাড়ির গয়না-টাকা তোমাদের ব্যাকপ্যাকে কেন?
কখনও কখনও নীরবতা শ্রেয়, বিশেষ করে যদি উত্তরটা প্রীতিকর না হয়। দুই বোন মাথা নিচু করে একে অন্যের দিকে তাকায়। সামান্য অপেক্ষার পর কম্যান্ডান্ট রুক্ষ স্বরে বললেন, এই মেয়ে! যা জানতে চাইছি সব উত্তর দাও। নাহলে এক্ষুনি অ্যারেস্ট করে হোমে পাঠিয়ে দেব। সেখানে বিরাট বিরাট গোঁফওয়ালা দারোয়ান। দুটো কচি মেয়েকে পেলে তারা কতটা মজা লুটবে, জানি না।
তারপর মহিলা কনস্টেবলদের উদ্দেশে বললেন, দুটো মেয়েই খুব ত্যাঁদোড়। আপনারা প্রিজন ভ্যান রেডি করুন।

আরও পড়ুন-গাড়িচালকদের নিখরচায় চক্ষুপরীক্ষা পুলিশের

দুই বোনই আমার দিকে তাকাল। ভয়ংকর ঘৃণাপূর্ণ সে দৃষ্টি। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিই। নিজেকে বোঝালাম, আমি সঠিক কাজই করেছি। নাহলে দুটো বাচ্চা মেয়ে কোথায় কার খপ্পরে পড়ত! আমিও সন্তানের বাবা। হঠাৎ বাড়ি থেকে সন্তানরা উবে যাওয়ায় ওদের বাবা-মায়ের দিশাহারা করুণ মুখ দুটো কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম। আমার কল্পনায় ব্যাঘাত এল। শুনতে পেলাম দুই বোন একে অন্যকে ছাপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, আমাদের ফেভারিট হিরো বরুণ ধাওয়ান— মুম্বইয়ের খারে যাচ্ছিলাম ওর সঙ্গে দেখা করবার জন্য— আমরা হিন্দি ফিল্মে অ্যাকটিং করারও সুযোগ খুঁজছি— প্লিজ আমাদের সরকারি হোমে পাঠাবেন না— নিজেদের বাড়িতেই ফিরে যাব— আমাদের ছেড়ে দিন প্লিজ—
কমান্ডান্ট সামান্য হেসে বললেন, এতকিছুর পর এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া যায় না। তোমাদের বাড়িতেই পাঠাব। কিছু খারাপ কথা বলার জন্য দুঃখিত। সেসব বলেছি সত্যটা জানার জন্য।
তারপর আমাকে বললেন, থ্যাঙ্কস গড! আপনার জন্যই মেয়েদুটো বড় কোনও সমস্যায় পড়ল না। এদের সঙ্গে থাকা টাকা-গয়নার একটা লিস্ট করতে বলছি। সব মিলিয়ে সাক্ষীর জায়গায় সই করে দিলে আপনার ছুটি। দুটো লেডি কনস্টেবল সঙ্গে দিয়ে পুলিশের গাড়িতে এদের বাড়ি পাঠিয়ে দেব। আধার কার্ডগুলো লাগবে, নাম ঠিকানার জন্য। লিগাল পার্সপেক্টিভ ঠিক হওয়া দরকার। নাহলে এসব বিচ্ছু মেয়ে হয়তো মিডিয়ার লোক ডেকে মলেস্টেশন অব ডিগনিটির অভিযোগ করে দিল। সময় খুব খারাপ।
ফটোকপি করার অছিলায় আধার কার্ড দুটো নিয়েছিলাম। ওগুলো দেওয়ার সময় দেখলাম এদের ঠিকানা আমার বাড়ির কাছাকাছি। বললাম, এতো আমার বাড়ির কাছাকাছি ঠিকানা।
— খুব ভাল। তাহলে আপনি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে চলে যান।

[৩]
খোলা জানালা দিয়ে আসা ধুলো ধোঁয়া এবং ঝোড়ো হাওয়ার মুখোমুখি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিলাম। এটা আমার পরিচিত অঞ্চল। রাত প্রায় দশটা। এখন মোবাইল ফোন বাছবিচারহীন সবার হাতে। এই মেয়েদুটোও নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম নয়। অবাক হচ্ছিলাম, এদের একটা ফোনও কেন এতক্ষণ ধরে একবারও বাজল না। তবে কি সুইচ অফ করে রাখা? হয়তো। ফোনে কথা হলেই আমরা ওদের সম্পর্কে আরও কিছু জেনে যাব। ভাবছিলাম, কী ভয়ংকর এই মেয়েদুটো।
আমার ভাবনা থমকে যায়। দুটো মেয়েই স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে, ব্যস! ব্যস! রাস্তার ওপর এই দোতলা বাড়িটা আমাদের।
জিপ দাঁড়িয়ে যায়। একটি মেয়ে নামতে নামতে বলে, এবার আপনারা চলে যেতে পারেন। আর আপনাদের বসকে বলে দেবেন আমরা কারওর আয়া নই, বরং দরকারে আয়া রাখি।
পিছনে এক মহিলা কনস্টেবল বললেন, অ্যাই মেয়ে। টাকা-সোনা সব আমার কাছে। তোমাদের বাবা-মা সব মিলিয়ে দেখে কাগজে সই করবে, তারপর রেহাই। বাড়াবাড়ি কোরো না। মনে রেখ জেনারেল ডায়েরি হয়েছে।
ভেবেছিলাম, নামব না। এখন মনে হল সন্তানরা ফিরে আসার পর এদের বাবা-মার প্রতিক্রিয়াটা দেখা দরকার। পিছন পিছন নামলাম। সামনে ওই মেয়েদুটো, দুই পাশে দুই কনস্টেবল। একটি মেয়ে কলিং বেল বাজাল। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম বজ্রপাতে পুড়ে যাওয়া গাছের মতো। কেননা, দরজা খুলে হাসি মুখে বেরিয়ে এল সকালে মেট্রো রেল কম্পার্টমেন্টে অসভ্যতাকারী লোকটা। অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article