গানকেও যে বিভেদের অস্ত্র করা যায় দেখিয়ে দিল বিজেপি

দেশবাদী নয়, বিদ্বেষবাদী বিজেপি। ওরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকেও ছুঁড়ে ফেলতে চায়। দিকে দিকে সেই চেষ্টা চলছে পুরোদমে। লিখছেন সঙ্গীতা মুখোপাধ্যায়

Must read

‘ব’-এ বিদ্বেষ, বৈরিতা, বিভাজন ও বর্জন। এটা একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ক্রমপর্যায় হতে পারে। এবং হয়েই থাকে। ইতিহাস তার সাক্ষী। কিন্তু এখন সমকালে লক্ষিত হচ্ছে আর একটি বিষয়। এই প্রক্রিয়ার কারক বা সম্পাদক পদটির ইংরেজি নামের সংক্ষিপ্ত রূপের প্রতিবর্ণাকরণ করলেও যেটি পাওয়া যাবে, সেটিরও আদ্য অক্ষর বাংলার ‘ব’।
‘ব’-এ ‘বিজেপি’।

আরও পড়ুন-রবিবারের গল্প: ‘দারুণ’

বঙ্কিমচন্দ্রকে নিজেদের শিবিরে অর্জনে এবং সামগ্রিকভাবে রবীন্দ্রনাথকে বর্জনে তাদের এখন প্রবল উৎসাহ। আর, তারই পরিণতি স্বরূপ ‘জনগণমন’ বনাম ‘বন্দেমাতরম’, এই দুই দেশাত্মবোধক গানের গুঁতোগুঁতি রচনায় বিজেপির প্রচণ্ড আগ্রহ। ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে নিজেদের মতো ভাষ্য (ন্যারেটিভ) রচনায় এই দলটি যে সিদ্ধহস্ত, সেকথা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে, এবারেও হচ্ছে। বিজেপি-আরএসএস, মোদি-যোগীদের যৌথ ভাষ্য পরিবেশনার সুবাদে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি, ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় সম্পাদক পদে রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তরসূরি ছিলেন।
আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যে ‘বন্দেমাতরম’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাইবার জন্য বিজেপির এত উৎসাহ, সেই ‘বন্দেমাতরম’-এ বর্ণিত মাতৃরূপী দেশের প্রশস্তি রবীন্দ্রনাথের আর একটি গানেও। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানে গীতিকার যাঁকে বারংবার ‘মা’ রূপে সম্বোধন করেছেন, বঙ্কিমের ‘বন্দেমাতরম’-এ তিনিই বন্দিতা মাতা। রবি ঠাকুরের গানে গীতিকার লিখেছেন ‘ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি’। আর ‘বন্দেমাতরম’ বঙ্কিম উচ্চারণ করেন, ‘সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং শস্যশ্যামলাং… সুহাসিনীং সুমধুর ভাষিণীম্ সুখদাং বরদাং মাতরম’। দুটোতেই দেশের অভিন্ন রূপ কল্পনার উপস্থাপনা। কিন্তু কী আশ্চর্য! ‘বন্দেমাতরম’ গাইতে যাঁদের আগ্রহ তাঁরাই ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলে জেলে পোরার ব্যবস্থা করছেন।
এবং হিন্দুত্ববাদী বিজেপি রবীন্দ্র-বর্জনে মেতেছে, ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইলে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করছে, ‘জনগণমন’ পরিত্যাগ করার আওয়াজ তুলছে।
রামজন্মভূমি আন্দোলনের সময়ে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আহ্বানে বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেত্রী সাধ্বী ঋতাম্ভরা একটি অডিও ক্যাসেটে দারুণ মুসলমান-বিদ্বেষী বক্তৃতা দিয়েছিলেন, উত্তর ভারতের পথে পথে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই বক্তৃতার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের গানকে দেশদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার নিদর্শন বলে চালানাে হয়েছে। তানিকা সরকারের একাধিক নিবন্ধে সেই বক্তৃতার উল্লেখ আছে। বাঙালি যেন ভুলে না যায়, ‘জনগণমন’কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা যিনি প্রথম দিয়েছিলেন, তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ‘দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’-এর প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ২ নভেম্বর, ১৯৪১-এ জার্মানির বার্লিন শহরে। সুভাষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এনজি গণপুলের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ওই অধিবেশনেই গৃহীত হয়েছিল ব্রিটিশ-বিরোধী যুদ্ধের স্লোগান ‘জয় হিন্দ’, সেই যুদ্ধের জাতীয় নেতার ‘নেতাজি’ সম্বোধন এবং জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’।

আরও পড়ুন-জঙ্গলরাজ তৈরি করেছেন মোদি : কল্যাণ

কেন এই গানটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে, তার কারণও ব্যাখ্যাত হয় ওই অধিবেশনে। সেখানে বলা হয়, যেহেতু ওই সঙ্গীতে ভারতের সমস্ত ধর্ম ও প্রদেশের মিলন-কেন্দ্রের আদর্শ উচ্চারিত হয়েছে, সেহেতু ওই সঙ্গীতটিই জাতীয় সঙ্গীত রূপে বিবেচ্য হতে পারে।
‘জনগণমন’ ইস্যুতে গান্ধী ও সুভাষের কোনও মতপার্থক্য ছিল না।
১৯ মে, ১৯৪৬-এ ‘হরিজন’ পত্রিকায় মহাত্মা গান্ধী লেখেন, ‘(জনগণমন অধিনায়ক) তো শুধু গান নয়, সমগ্র জাতির প্রার্থনামন্ত্র’। অথচ গান্ধীজি নিজে ‘বন্দেমাতরম’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ব্যবহারের প্রবল সমর্থক ছিলেন। অথচ গান্ধীজি নিজে মনে করতেন, বন্দেমাতরমকে জাতীয় সঙ্গীত করা উচিত।
পরিশেষে, রবীন্দ্রনাথের দুটি মন্তব্যের উল্লেখ করা আবশ্যক। দুটোই আজকের বিজেপির জন্য না হলেও তাদের জানা দরকার।
প্রথমেই বলি বন্দেমাতরম নিয়ে তাঁর কথা, ‘বাংলাদেশের একদল মুসলমানের মধ্যে যখন (বন্দেমাতরম-এর বিরোধিতার বিষয়ে) অযথা গোঁড়ামির জেদ দেখতে পাই তখন সেটা আমাদের পক্ষে অসহ্য হয়। তাদের অনুসরণ করে আমরাও যখন অন্যায় আবদার নিয়ে জেদ ধরি তখন সেটা আমাদের পক্ষে লজ্জার বিষয় হয়ে ওঠে। বস্তুত এতে আমাদের পরাভব।”
সুভাষচন্দ্রকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে তিনি কথাগুলো লিখেছিলেন।
দ্বিতীয় কথাটি তাঁর অন্তরের বেদনার কথা। ১৯২৭ সালে জাভা থেকে কন্যা মীরাকে লেখা এক দীর্ঘ চিঠিতে একথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
“দেশাত্মবােধ বলে একটা শব্দ আমরা কথায় কথায় ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু যার দেশজ্ঞান নেই তার দেশাত্মবােধ হবে কেমন করে।”
মোদি-যোগী-শাহদের কথাগুলো শোনানো দরকার।

Latest article