রাজা রামমোহন রায়। উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সতীদাহ প্রথা রদ করা থেকে শুরু করে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা। আমাদের আধুনিকতার শুরুই হয়েছিল তাঁর হাতে। তারপর বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ প্রমুখ তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় সেই পথকে আরও প্রসারিত করেছেন। কিন্তু আজ এই একুশ শতকীয় ভারতবর্ষে, বিজেপি-র মধ্যপ্রদেশীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যে আমোদিত প্রতিবেশে, স্বীকার করতেই হচ্ছে, সেদিন তো বটেই, এমনকী আজকেও বঙ্গের বাইরে, উনিশ শতকের চেতনার উন্মেষ বা জ্ঞানচর্চার প্রসার দাগ কাটতে পারেনি।
আরও পড়ুন-পুলিশে বদল
এতদিন যখন দেখতাম যে গোঁড়ামি ও ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ- বিবেকানন্দদের আজীবন লড়াই, তাঁদের কালপর্বের আড়াইশো বছর পরেও তা বিদ্যমান। দেখতাম, সাম্প্রদায়িক হিংসা থেকে শুরু করে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং সে-সবকে ঘিরে একদল উন্মত্ত জনতার উচ্ছ্বাস, তখন মনে মনে বহুবার আমাদের প্রচলিত আলোকপ্রাপ্তির ধারণাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু আজ যখন শুনছি, রামমোহন ‘ব্রিটিশদের দালাল’ কিংবা রবীন্দ্রনাথ সর্বতোভাবে বর্জ্য, তখন টের পাচ্ছি, রামমোহন-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতা কূপমণ্ডূকতায় পর্যবসিত হয়েছে। আর সেই সূত্রে মনে হচ্ছে, রামমোহন-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-বিরোধী জীবদের শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গোড়ায় গলদ রয়ে গিয়েছিল সেই উনিশ শতকীয় নবজাগরণের সময় থেকেই। নচেৎ, রামমোহন খামোখা ব্রিটিশদের দালাল হতে যাবেন কেন?
‘ব্রিটিশদের দালাল’ হিসেবে আজ যাঁকে চেনাতে চাইছে বিজেপি বা সংঘ পরিবার, তিনি আসলে ছিলেন দুয়ার পেরিয়ে বিশ্বের দরজায় দাঁড়াতে চাওয়া একটি অবাধ্য মন। তাই ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লব হোক বা ইতালির মুক্তি সংগ্রাম, আয়ারল্যান্ডের আন্দোলন হোক বা আমেরিকার দাসপ্রথা বিলোপের লড়াই, সবকিছুই তাঁকে বিচলিত, আন্দোলিত, উদ্বেলিত করত। ঔপনিবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক মানচিত্রে দাঁড়িয়ে তিনিই ‘ক্যালকাটা জার্নাল’-এর সম্পাদক জেমস সিল্ক বাকিংহামকে বুঝিয়েছিলেন, বিভিন্ন দেশের মুক্তির অনিবার্যতার কথা। আর ভিক্তর জাকমোঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা কোনও স্থায়ী বিষয় নয়। ভারতবর্ষ তার হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধারের দাবিও জানাবে। কোনও ‘ব্রিটিশ দালাল’-এর পক্ষে এসব কথা ভাবা কিংবা বলা সম্ভব? ‘অন কলোনিয়াল পলিসি অ্যাজ অ্যাপ্লিকেবল টু দ্য গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি দেখালেন, ভারত থেকে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছে। কোনও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালের পক্ষে এমনটা সরাসরি লেখা সম্ভব?
আরও পড়ুন-হাসিনাকে ফাঁসির সাজা, আজ বাংলাদেশে বন্ধ, রায় পক্ষপাতদুষ্ট : মুজিবকন্যা
১৮২৩-এ লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠিতে তিনি যখন পশ্চিমি ধাঁচে বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে জোর সওয়াল করছেন, তখন সেটা করেছেন ভারতবাসীর বস্তুগত উন্নতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষা ও বেদান্তশিক্ষার অকার্যকারিতার কথা উপলব্ধি করেই। ব্রিটিশদের দালালি করার জন্য নয়। রামমোহন যদি সাভারকরদের মতো অকৃত্রিম ব্রিটিশ-ভক্ত হতেন, তবে কোম্পানি শাসনের সমালোচনা বা আইনের শাসন প্রবর্তনের পক্ষে নিরন্তর কথা বলা কিংবা সংবাদপত্রের স্বাধিকার রক্ষার দাবিতে আগাগোড়া সরব হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হত না। কিন্তু এত কথা, এত চিন্তা দর্শনের গভীরতা, এত মনোগত গাম্ভীর্য বিজেপি পাবে কোথা থেকে! তাও বাঙালি হলে না হয় একটা কথা ছিল, ইন্দর সিং পারমার তো একেবারে কৈলাস বিজয়বর্গীয়দের রাজ্যের মানুষ। সুতরাং বিদ্যাসাগারের মূর্তি ভাঙা থেকে ‘জনগণমন’ বর্জনের ডাক দেওয়া, র-সু-ন (রবীন্দ্রনাথ-সুকান্ত-নজরুল) সংস্কৃতির প্রতি বিষোদ্গার (এই শব্দবন্ধটি অবশ্য এক বঙ্গজ, তথাগত রায়ের সৃষ্টি) থেকে শুরু করে রামমোহনকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলা, সব কিছুই এঁদের সংঘী বিশ্বাসের পরিধিজাত।
কেউ তাঁদের বোঝাতে পারবে না, একটা গাছ যখন লতায় পাতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন তার নীচে দাঁড়ালে সূর্যালোক পাওয়া যায় না। মুক্ত আলো নীল আকাশের দেখা মেলে না। নির্মল বাতাসে বুক ভরা শ্বাস নেওয়া যায় না। এ-দেশের হিন্দু সমাজের জীবন-আকাশে সেদিন যখন এরকম অবস্থা দেখা দিয়েছিল, অসংখ্য দেবদেবী, সতীদাহ প্রথার মতো অজস্র সংস্কার-বিশ্বাস-প্রথা-প্রকরণে ছেয়ে গিয়েছিল হিন্দুর ধর্মীয় জীবনের আকাশ, তখন বহু দেবতাদের ডালপালা ছেঁটে রামমোহন ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তনার সূত্রে একেশ্বরবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর ধর্ম সংস্কার মানে ধর্মের অজস্র জটিলতায় আর একটা জটিল সূত্রের সংযোজন নয়, ভারতবর্ষের ধর্মীয় জীবনকে জটিলতা মুক্তির দিকে এগিয়ে দেওয়া। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, রামমোহনের ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ নতুন কোনও কথা নয়, ইসলাম বা খ্রিস্ট ধর্মের ভাষ্যও নয়। সেটা ছিল বেদান্ত, উপনিষদের কথা। আজ তিনিই ‘ভুয়ো সমাজসংস্কারক’ হয়ে গেলেন বিজেপির চোখে!
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
রামমোহন এদেশের মানুষকে অতীতমুখী মধ্যযুগীয় মানসিতার গণ্ডি থেকে বের করে এনে নতুন জীবন দর্শনের আলো দেখাতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই এক সময় গোঁড়া, ধর্মান্ধ, অসহিষ্ণু কিছু মানুষ তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত চালিয়েছিল। সেইসব রাধাকান্ত দেব, রামকমল সেন, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের উত্তরসূরি আজকের বিজেপি। ওঁরা যাই বলুক, যাই করুক, রামমোহন রায় আজও ‘ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ’ হিসেবে, জনগণমনে ‘রাজা’র আসনেই অধিষ্ঠিত। আর সেটা হবে না-ই বা কেন! রামমোহনের দেখানো পথেই তো বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহর সপক্ষে শাস্ত্রীয় যুক্তির অনুসন্ধান ও মান্যতা প্রাপ্তি। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধের গোড়াপত্তনও ওই রামমোহনের ধর্মসংস্কারের পথ ধরেই। রামমোহন না এলে রবীন্দ্রনাথ কি মেলাতে পারতেন বিজ্ঞানের নব-আবিষ্কৃত সম্বন্ধতত্ত্ব ও কবির সর্বগ্রাহী বিশ্ব পিপাসা— ‘যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে অন্তহীন আপনা।’
বাঙালির রাম রামকৃষ্ণ, বিবেক বিবেকানন্দ, রবি রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বর বিদ্যাসাগর আর রাজা রামমোহন। তাই সত্যিকার ‘ব্রিটিশ দালাল’দের উত্তরসূরিরা যখন রামমোহনকে ‘ব্রিটিশদের দালাল’ বলেন, বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙেন, রবীন্দ্র সংগীতকে দেশদ্রোহী হিসেবে দেগে দেন, তখন রবি-গানের একটা পদ বারবার বাঙালির মনের মধ্যে জলের মতো ঘুরে ঘুরে কথা কয়, কইতেই থাকে, ‘ভাবছ তবে তুমিই যা চাও, জগৎটাকে তুমিই নাচাও, / দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে হয় না যেটা সেটাও হবে।’
বিজেপির অযুত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রামমোহন-রবীন্দ্রনাথরা বঙ্গজন হৃদয়ে বিরাজ করছেন, আগামীতেও করবেন। বরং বিজেপির বঙ্গদেশে কী হাল হবে, সেটাই কোটি টাকার প্রশ্ন।
লজ্জার ফর্দ
১৪ মে, ২০১৯ : কলকাতার অমিত শাহের র্যালি থেকে আক্রমণ নামিয়ে আনা হল বিদ্যাসাগরের মূর্তির ওপর। বিদ্যাসাগর কলেজে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙল বিজেপি।
৯ ডিসেম্বর, ২০২০ : বিশ্বকবির জন্মস্থান নাকি কলকাতা নয়, বিশ্বভারতী, জানায় বিজেপির একটি পোস্ট।
৬ নভেম্বর, ২০২৫ : বিজেপি সাংসদ বিশ্বেশ্বর হেগড়ে কাগেরির দাবি, ‘জনগণমন’ রচিত হয়েছিল ব্রিটিশ রাজাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
২৩ জানুয়ারি ২০২১ : কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বিজেপি সমর্থকরা নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে নেতাজির জন্মোৎসব পালনকালে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেয়।
২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩ : স্বামী বিবেকানন্দের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য কেন্দ্রের হাফপ্যান্ট মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারের।
নভেম্বর, ২০২০ : বাঁকুড়ায় রাস্তার পাশে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মূর্তিতে বীরসা মুন্ডার মূর্তিজ্ঞানে মাল্যদান করেন অমিত শাহ।
৯ জানুয়ারি, ২০২১ : কাটোয়ার জগদানন্দপুরের একটি মন্দিরকে শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাসগ্রহণের স্থান হিসেবে উল্লেখ জে পি নাড্ডার, শ্রীচৈতন্য অন্তর্হিত হওয়ার অন্তত ৩০৫ বছর পর ওই মন্দিরটি নির্মিত হয়!
২০২৪ : সর্বতোভাবে বঙ্গসন্তান বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ‘বহিরাগত মুঘল’ বলেন কৃষ্ণনগর লোকসভায় বিজেপি প্রার্থী।
এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন রাজা রামমোহন রায়, মধ্যপ্রদেশের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী যাঁকে ‘ব্রিটিশদের দালাল’ বলেছেন।

