সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মদিনে আমার ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে দু’জনের কথা। একজন হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) রত্নগর্ভা মা গায়ত্রীদেবী, অন্যজন কিংবদন্তি সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত। দু’জনেই প্রয়াত। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি বাংলার মাটিতে জন্ম হয়েছিল একটি রাজনৈতিক দলের। সদ্য জন্ম নেওয়া দলটিকে নিয়ে সেসময় অনেকে অনেকরকম ব্যঙ্গ করেছিলেন। কিন্তু গায়ত্রীদেবী এবং বরুণবাবু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন জোড়াফুলকে যারা আন্ডার এস্টিমেট করছে তারা ভবিষ্যতে হাড়ে হাড়ে টের পাবে তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।
তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে থেকেই মমতা তৈরি হচ্ছিলেন। কংগ্রেসে থেকে যে বাংলাকে সিপিএমের অপশাসনের কবল থেকে উদ্ধার করা যাবে না, সেটা তৃণমূল নেত্রীর উপলব্ধি হয়েছিল, কয়েক বছর আগেই। ১৯৯৩ সালের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনে রাজ্যবাসী বুঝে নিয়েছিলেন, মমতাকে ফিনিশ করতে চায় একটা রাজনৈতিক গোষ্ঠী। সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের একটা শক্তিশালী অংশ। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্মকর্তারা শুধুমাত্র হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ারের (তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস অফিস) ভরসায় বসে থাকেনি। তাঁদের লম্বা হাত পৌঁছে গিয়েছিল দিল্লিতে, কংগ্রেস হাইকমান্ডের দুয়ারেও! দুই পক্ষেরই টার্গেট একটাই, মমতাকে আর এক ইঞ্চিও মাটি ছাড়া যাবে না।
আরও পড়ুন-চিরদিন মানুষের সঙ্গে মমতাদি
১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে সিপিএম বিরোধী আন্দোলনের ঝড় তুলেছিলেন মমতা। জনগণের আদালতে নিজেকে ‘অগ্নিকন্যা’ রূপে প্রতিষ্ঠা করতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। কংগ্রেস যতবেশি বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে নির্লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে, মমতা ততই তেড়ে-ফুঁড়ে উঠতে থাকেন। পদে পদে বুঝিয়ে দেন সিপিএমের স্বৈরাচারী শাসনের কাছে কিছুতেই তিনি নতজানু হবেন না, সংগ্রাম চলবে। জীবন বাজি রেখে বছরের পর বছর লড়াই করেছেন মমতা। কতবার যে মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে এসেছেন, তা সবার জানা।
এইরকম একজন লড়াকু মানুষের চেষ্টায় একটা রাজনৈতিক দল তৈরি হবে, সেটা তাঁর বিরোধীরা কী করে মেনে নেবে? তাই সর্বতোভাবে চেষ্টা হচ্ছিল, মমতার নতুন দল গঠনের উদ্যোগ ভেস্তে দেবার। তবে, মমতাও তো কম যান না। যদি তাঁর শত্রুরা চলেন ডালে ডালে, তাহলে জননেত্রীও চলেন পাতায় পাতায়! সামনেই লোকসভা নির্বাচন। তার আগেই নতুন দলের স্বীকৃতি চান মমতা। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের অফিসে দলের প্রতীক চেয়ে আবেদন-সহ সব কাজ চলছে দিল্লিতে। এবং অত্যন্ত গোপনে। কারণ, শত্রুরা জানতে পারলেই, ঝাঁপিয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত সফল হলেন মমতা।
যে দু’জনের কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম, তাঁদের বিষয়ে আসি। দিল্লিতে ঘোষণা হল, মমতার (Mamata Banerjee) নেতৃত্বে নতুন দল তৃণমূল কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করল। গায়ত্রীদেবীর সঙ্গে পরেরদিন কালীঘাটের বাড়িতে দেখা করলাম। খুব খুশি। তিনি বললেন, ‘‘মমতা এতদিনে মুক্ত হল। আর ওকে কেউ পায়ে শিকল পরিয়ে রাখতে পারবে না। দেখবে, ওই পারবে, সিপিএমকে হটাতে।” আসলে গায়ত্রীদেবী ছিলেন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত দূরদর্শী মহিলা। ১৯৮২ সাল থেকে আমৃত্যু তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। মমতার জীবনে প্রতিটা রাজনৈতিক অধ্যায়ে যেভাবে তিনি মেয়েকে উৎসাহ এবং প্রেরণা জুগিয়েছেন, ঠিক সেইভাবেই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছেন একান্ত আলোচনায়।
আরও পড়ুন-প্রতিষ্ঠাদিবসে কলম ধরলেন মহাসচিব তথা শিল্পমন্ত্রী
সিপিএমকে রাজনৈতিক ভাবে খতম করার প্রশ্নে বরুণ সেনগুপ্তরও বরাবরের বাজি ছিলেন মমতা। তাই ঘাসফুলের জন্মের পর থেকেই তাঁর কলমও ‘বর্তমান’ দৈনিকে জ্বলে উঠেছিল। একবার নয়, বারবার। বরুণবাবুও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘‘যত চেষ্টাই হোক, মমতাকে আর কোনও শক্তি রুখতে
পারবে না।’’