কিংবদন্তি সুরস্রষ্টা সলিল চৌধুরী। বাংলা, হিন্দি, মালায়লমের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন ভাষার চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। কালজয়ী হয়েছে তাঁর অসংখ্য গান। আজও মুখে মুখে ফেরে। তাঁর গানে দেখা যায় প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন। শচীন দেব বর্মন তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। রাহুল দেব বর্মন মানতেন গুরু। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সলিল চৌধুরী সুরারোপ করেছেন বহু বেসিক অ্যালবামের গানে। তাঁর সুরে প্রচুর গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, লতা মঙ্গেশকর, সবিতা চৌধুরী প্রমুখ। বাজাতেন বাঁশি, পিয়ানো, এসরাজ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। সঙ্গীত-সৃষ্টির পাশাপাশি রচনা করেছেন গল্প, কবিতা। নাটকের সঙ্গেও একসময় ছিল যোগ।
আরও পড়ুন-ঋতু বদলে
জন্ম ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর। বুধবার ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ। সেই উপলক্ষে কলকাতার কলামন্দিরে ‘স্বপ্ন রঙিন সলিল সঙ্গীত’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল আনন্দপুর সলিল চৌধুরী বার্থ সেন্টিনারি সোসাইটি। সহযোগিতায় বোরোলিন। শুরুতেই ধ্বনিত হয়েছে সলিল চৌধুরীর কণ্ঠে তাঁরই লেখা ‘একগুচ্ছ চাবি’ কবিতার আবৃত্তি। যেন জানান দিলেন পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে নিজের আশ্চর্য উপস্থিতি। সমগ্র অনুষ্ঠান জুড়ে ছিলেন তিনিই। পরিবেশিত হয়েছে তাঁর সুরারোপিত বেশকিছু বাংলা এবং হিন্দি গান। বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল মঞ্চে সুসজ্জিত তাঁর ছবির দিকে। আশ্চর্য রকমের উজ্জ্বল। তিরিশ বছর আগে, ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি যে চিরবিদায় নিয়েছেন, মনেই হচ্ছিল না।
ফেরা যাক অনুষ্ঠানের কথায়। গাছের চারায় জল দিয়ে উদ্বোধন করেছেন বেহালাবাদক-সুরকার ড. লক্ষ্মীনারায়ণ সুহ্মমণ্যম। উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ, সুরকার কল্যাণ সেন বরাট, সংগীতশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য, সলিল চৌধুরীর দুই কন্যা অন্তরা চৌধুরী ও সঞ্চারী চৌধুরী এবং পুত্র সঞ্জয় চৌধুরী প্রমুখ। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত হয়েছে সলিল চৌধুরীর উপর একটি বই। সেই মুহূর্তে ভায়োলিনের সুরে বেজে উঠেছিল ‘না যেও না’। তারপর ক্যালকাটা কয়্যারের সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত শিল্পীরা সমবেতভাবে গেয়ে ওঠেন ‘ও আলোর পথযাত্রী’। সবমিলিয়ে অসাধারণ সূচনা। এরপর একে একে মঞ্চে আসেন বিশিষ্ট শিল্পীরা।
আরও পড়ুন-২৬ নভেম্বর সংবিধান দিবস সংসদে শীতকালীন অধিবেশনে একগুচ্ছ বিল
লোপামুদ্রা মিত্র শোনালেন দুটি গান। ‘প্রান্তরের গান আমার মেঠো সুরের গান আমার’ এবং ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা’। পরের শিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। সলিল চৌধুরীর সুরে প্রচুর গান গেয়েছেন, সেই কথা স্মরণ করে শোনালেন ‘মন বনপাখি চন্দনা’ এবং ‘ভালোবাসি বলেই ভালোবাসি বলি না’। গান নয়, সলিল চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করলেন অনুষ্ঠানের অতিথি স্বামী দেবানন্দ। বলেন কিছু কথা।
দুটি গান উপহার দিয়েছেন মনোময় ভট্টাচার্য। ‘আমার এ জীবনে শুধু’ এবং ‘যদি জানতে’। স্বপন বসু গাইলেন ‘আমি রাজনীতি-ফিতির ধার ধারি না’ এবং ‘নন্দলাল দেবদুলাল’। দুই ভাষায় গান শোনালেন রূপঙ্কর বাগচী। বাংলা গান ‘যায় যায় দিন’ এবং হিন্দি গান ‘টুটে হুয়ে খাবোমে’।
অন্তরা চৌধুরী ও সুরধ্বনির কচিকাঁচাদের নিবেদনে ছিল ‘বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু’ এবং ‘ছুক ছুক ছুক ছুক রেলগাড়ি’। গৌরব সরকার শোনালেন ‘বাজে গো বীণা’। হিন্দি গান ‘তড়প তড়প’, গৌরবের সঙ্গে গাইলেন দীপান্বিতা চৌধুরী। পরে দীপান্বিতা এককভাবে শোনালেন ‘ধরণীর পথে পথে’।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকলি’ অবলম্বনে ‘সেই মেয়ে’ রচনা করেছিলেন সলিল চৌধুরী। গানটি পরিবেশন করলেন জয়তী চক্রবর্তী। পরে জয়তী শোনালেন হিন্দি গান ‘রজনীগন্ধা ফুল তুমহারা’। গিটারে ছিলেন সুনীল কৌশিক, যিনি মূল রেকর্ডিংয়ে বাজিয়েছিলেন।
সৈকত মিত্র গাইলেন হিন্দি গান ‘আহা রিমঝিম’। পরে দীপান্বিতা চৌধুরীর সঙ্গে শোনালেন ‘ইতনা না মুঝসে তু’। শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবেশন করেন দুটি গান— ‘কী যে করি’, ‘ও তুই নয়ন পাখি’।
এরপর মঞ্চে আসেন সুরকার শান্তনু মৈত্র। কেন সলিল চৌধুরী তাঁর পছন্দের সুরস্রষ্টা, বলেন সেই কথা। শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইলেন হিন্দি গান ‘ও সজনা’ এবং বাংলা গান ‘কেন কিছু কথা বলো না’। সলিল চৌধুরীকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন গুলজার। কবিতাটি দর্শক-শ্রোতাদের শোনানো হয়।
শ্রীকান্ত আচার্য গাইলেন হিন্দি গান ‘কঁহি দূর যব দিন ঢল যায়ে’, ‘ম্যায়নে তেরে লিয়ে’ এবং বাংলা গান ‘আমি চলতে চলতে থেমে গেছি’। গিটারে ছিলেন সুনীল কৌশিক। দীপান্বিতা চৌধুরী ও গৌরব সরকার গাইলেন ‘জানেমন জানেমন’। সুনীল কৌশিকের গিটার বেজে উঠেছিল এই গানের সঙ্গেও।
করতালির মধ্যে দিয়ে মঞ্চে আসেন ঊষা উত্থুপ। তাঁর পরিবেশনায় ছিল ‘যত কিছু বন্ধন’ এবং ‘মুন্ন বড়া প্যারা’। পরবর্তী শিল্পী কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। জানালেন বাংলার প্রতি, বাংলা গানের প্রতি তাঁর ভাললাগার কথা। সেইসঙ্গে সলিল চৌধুরীর সুরে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতার কথাও। তাঁর নিবেদনে ছিল চারটি গান— ‘না জানে কিঁউ’, ‘না মন লাগে না’, ‘তেরে ইয়াদ’, ‘আ যা রে পরদেশি’।
আরও পড়ুন-‘হাঁটি হাঁটি পা পা’, গোয়া চলচ্চিত্র উৎসবে রুক্মিণী
শেষ দুই পরিবেশনা ছিল ক্যালকাটা কয়্যারের সম্মেলক গান এবং মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানির নৃত্য। মঞ্চ নির্মাণে তরুণকান্তি বারিক। সংগীতায়োজনে বুদ্ধদেব গঙ্গোপাধ্যায় এবং রকেট মণ্ডল। ভাষ্য রচনায় শুভ দাশগুপ্ত। সঞ্চালনায় দেবাশিস বসু এবং পরিতোষ সিনহা। সবমিলিয়ে সলিল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষে আয়োজিত ‘সাত রং কে স্বপ্নে’ অনুষ্ঠানটি ছিল অনবদ্য। মনে রাখার মতো।

