পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যোন্নতি মমতাময়ী-স্পর্শে

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি। বাম আমলের তমসাচ্ছন্ন দশা ঘুচিয়ে আলোকময় প্রান্তরে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। লিখছেন মৃত্যুঞ্জয় পাল

Must read

পশ্চিমবঙ্গে গত প্রায় দেড় দশকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নেতৃত্বে বাংলার স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র মানেই আজ আর নোংরা পরিবেশ, অপরিচ্ছন্ন ঘর, পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব আর সর্বগ্রাসী দালালরাজকে বোঝায় না। গত দেড় দশকে যেমন হয়েছে ২৬টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ, ৪২টি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পরই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর অঙ্গীকার ছিল, প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে মেডিক্যাল কলেজ এবং একাধিক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল গড়া হবে। সেই লক্ষ্যেই ক্রমশ এগিয়ে চলেছে এই সরকার। এই বিপুল উদ্যোগের জন্য একদিকে যেমন রোগী পরিষেবা বাম আমলের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৯০ হাজার আসন সংখ্যা হয়েছে, তেমনই মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়বার সুযোগও বেড়েছে অজস্র মেধাবী ছাত্রের। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়বার আসন সংখ্যা ২৭০৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০৬০।

আরও পড়ুন-মৎস্যজীবীদের সুরক্ষা দাবি করে বিজেপিকে তুলোধোনা ঋতব্রতর

একই সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই বিপুল উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়েছে প্রচুর কর্মসংস্থান। এই বিস্তৃত পরিকাঠামো, পরিষেবাকে জারি রাখতে এবং তাকে আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে যা অত্যন্ত আবশ্যক। এই কর্মসংস্থান রাজ্যের ছাত্র-যুবর মনে তৈরি করেছে আশার আলো। গত ১১ নভেম্বর মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, “চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান— সকলেই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়োগ প্রক্রিয়া যাতে দ্রুত শেষ হয়, সেটা দেখতে হবে।” এর ফলে দ্রুত হতে চলেছে ১৪ হাজার পদে নিয়োগ। সরকারি গেজেট অনুযায়ী এক নজরে দেখে নেওয়া যাক যে কোন কোন পদে কত সংখ্যক নিয়োগ আগামীতে আসতে চলেছে—
জেনারেল ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার ১৬৩০, সহকারী অধ্যাপক ৬২১,
মেডিকেল অফিসার (স্পেশালিস্ট) ৫২৮
সহকারী অধ্যাপক রেডিওলজি ১ নার্সিং স্টাফ (গ্রেড ২) ২৩৩০+২৫২+২০৯২+৩৪৪
রেডিয়েশন সেফটি অফিসার ৩১
ফার্মাসিস্ট (গ্রেড ৩) ৩৫০
মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (গ্রেড ৩) ৫+১৩+৩১+১২+১০+২৮৭+২২২
মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (গ্রেড ৩) ২১৩+১৪, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব, ওটি, পি অ্যান্ড ও, ক্রিটিকাল কেয়ার, অডিওমেট্রি) ২৪২, সহকারী অধ্যাপক (যোগা) ২৪, সহযোগী অধ্যাপক (যোগা) ৭, অধ্যাপক (যোগা) ৪, রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার (যোগা) ১, রিডার ১, টেকনিক্যাল অফিসার (নিউক্লিয়ার মেডিসিন) ৪, জুনিয়র অফিসার, ড্রাগ কন্ট্রোল ২, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, ড্রাগ কন্ট্রোল ২, ডিরেক্টর, ড্রাগ কন্ট্রোল ১, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (গ্রেড ৩) ২১৩+১৪
এ-ছাড়াও গত ২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শিক্ষক, নার্স, হেলথ অফিসার, টেকনিশিয়ান-সহ প্রায় ৬০ হাজারের অধিক নিয়োগ হয়েছে। বিভাগভিত্তিক আনুমানিক সংখ্যা দেওয়া হল সারণি ১-এ।
স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে আজ পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত, পাহাড়ি দুর্গম, পশ্চাৎপদ ও আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবার লক্ষ্যে ১১০টি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা যান (মোবাইল মেডিক্যাল ইউনিট)-এর শুভ সূচনা করলাম। এই ইউনিটগুলি হল একেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য ক্লিনিক, যা চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে সরাসরি রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে।

আরও পড়ুন-হাওড়ার রাস্তায় বসল স্বয়ংক্রিয় নম্বর প্লেট রিকগনিশন ক্যামেরা

এই ইউনিটগুলোতে প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসা, শিশুদের চিকিৎসা-সহ আরও নানান রোগের চিকিৎসা হবে এবং প্রয়োজনে রেফার করে অন্যত্র পাঠানোর ব্যবস্থাও করা হবে। এই গাড়িগুলোতে রোগ নির্ণয়ের জন্য হিমোগ্লোবিন, প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা, ম্যালেরিয়া, ইসিজি, ব্লাড শুগার-সহ প্রায় ৩৫টি ডায়াগনস্টিক টেস্টের সুবিধাও মানুষ বিনামূল্যে পাবেন। এই টেস্টগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি গাড়িতেই থাকবে। এমনকি জঙ্গলমহল, সুন্দরবন-সহ বিভিন্ন জেলায় গর্ভবতী মহিলাদের জন্য আল্ট্রাসোনোগ্রাফি পরিষেবা দেবার জন্য আল্ট্রাসোনোগ্রাফি মেশিনও থাকবে। তাই প্রতিটি ইউনিটেই মেডিক্যাল অফিসার, প্রশিক্ষিত নার্স, ফার্মাসিস্টের পাশাপাশি ল্যাব টেকনিশিয়ান, ইসিজি টেকনিশিয়ান, ডেটা এন্ট্রি অপারেটর থাকবেন।
বাংলার মানুষের কাছে এই ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে প্রাথমিকভাবে গাড়ি বাবদ আমাদের খরচ হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা আর এই পরিষেবা চালানোর প্রতিমাসে প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ হবে। মোট ২১০টি এমন ইউনিট চালু করবার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে, যার মধ্যে ১১০টি ইউনিট ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে। এমন নতুন আধুনিক উদ্যোগ বাস্তবায়ন যেমন প্রান্তিক অঞ্চলের দুয়ারে পরিষেবাকে পৌঁছে দিয়েছে তেমনই প্রয়োজন হয়েছে বিপুল কর্মসংস্থানের।
বিগত ১৪ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রায় ৬ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০-’১১ সালে বরাদ্দ ছিল ৩,৫৮৪ কোটি টাকা। ২০২৫-’২৬ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এই বিপুল বরাদ্দই প্রমাণ করে, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ঢেলে সাজানোয় সরকার কতটা আন্তরিক।
সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে রোগনির্ণয়, চিকিৎসা ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শুধু এর জন্যই বছরে আমরা ২ হাজার কোটি টাকা খরচ করছি। ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্পে মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালেও নিখরচায় ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলার ২ কোটি ৪৫ লক্ষ পরিবারের ৮ কোটি ৭২ লক্ষ মানুষ এতে অন্তর্ভুক্ত।
‘স্বাস্থ্য ইঙ্গিত’ টেলিমেডিসিন প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে ৯০ হাজার মানুষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে বিনামূল্যে টেলি কনসাল্টেশন পরিষেবা পাচ্ছেন। ইতিমধ্যেই উপকৃত হয়েছেন ৬ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষ।
‘চোখের আলো’ প্রকল্পে বিনামূল্যে ২৬ লক্ষ ছানি অপারেশন করা হয়েছে এবং বয়স্ক মানুষ ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৩৪ লক্ষ বিনামূল্যে চশমা বিতরণ করা হয়েছে। খরচ হয়েছে ১৮১ কোটি টাকা।
‘শিশুসাথী’ প্রকল্পে প্রায় ৬৪ হাজার ছোট ছেলেমেয়ের হার্ট বা অন্যান্য অপারেশন করা হয়েছে। খরচ হয়েছে ৩০৭ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন-ভয়াবহ দূষণ, ক্লাসরুমের বাইরে খেলাধুলোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল রাজধানী দিল্লিতে

‘রাত্তিরের সাথি’ প্রকল্পে ১৩০ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করা করেছে। রাজ্যের সকল অঙ্গনওয়াড়ি ও আশা কর্মীরা যাতে আরো সুষ্ঠুভাবে নিজেদের কাজ করতে পারেন এবং উন্নততর পরিষেবা আমাদের মা ও শিশুদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন, তার জন্য প্রত্যেককে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে একটি মোবাইল ফোন কেনার জন্য ১০ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। এর জন্য বাজেটেই আমরা ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলাম।
এছাড়াও আমার পূর্বের প্রতিবেদনে যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলাম তার পুনরাবৃত্তি করে দীর্ঘায়িত করছি না। প্রকৃত বিচারে বলতে গেলে, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে এক ধ্বংসস্তূপ থেকে নবনির্মাণ করে যে দৃষ্টান্ত সরকার স্থাপন করেছে, প্রান্তিক মানুষ থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ভরসা ও আস্থার জায়গা হয়ে উঠেছে তা বাংলার উন্নয়নের ইতিহাসে এক গৌরব অধ্যায়।

Latest article