পাতাঝরার ঋতু
বাংলার ঋতুচক্রে হেমন্ত আসে নীরবে, নিঃশব্দে। এই সময় রোদের তেজ অনেকটাই কমে যায়। হিমেল স্পর্শ নিয়ে তিরতির করে বয়ে যায় উত্তরের বাতাস। মনে করিয়ে দেয় ঋতু বদলের গোপন সঙ্কেত। দিনের আয়ু ফুরিয়ে যায়। দুপুর দ্রুত গড়িয়ে গিয়ে নেমে আসে ধীর, শান্ত বিকেল। দূষণ আর বিশ্ব উষ্ণায়নের দাপটে হেমন্ত এখন অনেক ক্ষীণ হয়ে গেলেও তাকে পুরোপুরি অস্বীকার করার উপায় নেই। সোনালি স্বপ্নের ঋতু, হেমন্তের যে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তা উপভোগ করার জন্য চাই দেখার মতো চোখ আর উপলব্ধি করার মতো মন। হেমন্ত পাতাঝরার ঋতু। ঝরাপাতার সুরে একদিকে যেমন জেগে ওঠে উদাসীন বিষণ্ণতা, একই সঙ্গে বেজে ওঠে তারুণ্য আর সবুজে সাজিয়ে তোলার আনন্দ গান। বিষাদ সুখের সেই রূপ আর সুরের সাক্ষী হতে গেলে আমাদের ছুটে যেতে হয় অরণ্যের কাছে।
আরও পড়ুন-জাতীয় রাজধানী অঞ্চলে ৫০ শতাংশ কর্মী নিয়ে অফিস চালানোর সিদ্ধান্ত
কলমে আনে শব্দের তুফান
শস্যশ্যমলা বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম হল তার বিস্তীর্ণ বনভূমি। প্রকৃতির প্রাণ স্পর্শ করতে গেলে আমাদের অবশ্যই করে যেতে হবে অরণ্যের কোলে, যেখানে প্রকৃতি কথা বলে তার নিজের ভাষায়। দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহল থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের অরণ্য, অঞ্চলের প্রকৃতিভেদে অরণ্যের চরিত্র বদলে যায়। তবে ঋতু বদলের ছোঁয়া সমানভাবে ছাপ রেখে যায় অরণ্যের শরীরে। ঝাড়গ্রাম-বেলপাহাড়ির লালমাটি, পুরুলিয়ার পাহাড়ি রুক্ষতা কিংবা উত্তরবঙ্গের নরম কুয়াশা— সব মিলেমিশে হেমন্তের অরণ্য বাংলার প্রকৃতিকে সাজিয়ে তোলে অপরূপ সাজে। হৈমন্তিক অরণ্য কবি সাহিত্যিকদের কলমে শব্দের তুফান আনে, মানুষের মনে উন্মাদনা জাগায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছুটে যায় অরণ্যের কাছে। বনের শান্ত নির্জন পথে হাঁটতে হাঁটতে উপলব্ধি করে উদাসীন বিষণ্ণতা আর সৃষ্টির উল্লাসের অদ্ভুত জীবন দর্শন।
ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী
জঙ্গলমহলে হেমন্ত আসে নীরবে। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিস্তৃত জায়গা নিয়ে জঙ্গলমহল। শাল, সেগুন, পিয়াল, মহুয়া প্রভৃতির গাছে ঘেরা ঝাড়গ্রামের বিস্তীর্ণ অরণ্য হেমন্তের স্নিগ্ধ আলোয় অপরূপ সাজে সেজে ওঠে। এখানকার লাল ল্যাটেরাইট মাটি হেমন্তের নরম রোদ মেখে যেন আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। বর্ষার জঙ্গলমহল যেখানে সবুজ, হেমন্তে তা যেন হয়ে ওঠে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী। শাল সেগুনের পাতা ঝরে পড়ে মাটিতে। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় জেগে ওঠা মৃদু খসখস শব্দ, যেন নীরবে প্রকাশ করে প্রকৃতির নীরব বেদনা। পাতাঝরার টুপটাপ সুর, গাছের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ বাতাশের শোঁ শোঁ শব্দ আর রাতের ঝিঁঝির বিরামহীন সঙ্গীত, সবমিলিয়ে জেগে ওঠে এক অদ্ভুত, রোমাঞ্চকর অনুভূতি। হেমন্তে অরণ্যের পশুপাখিরাও ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। বর্ষার স্যাঁতস্যেঁতে ভাব না থাকায় প্রাণীদের চলাফেরা বাড়ে। হাতির পালের ধীর, রাজকীয় চলন; হরিণের দলের মৃদু ছোটাছুটি, দোয়েল-শ্যামা-টিয়া প্রভৃতির গান বনভূমির সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
মধুর মিলনক্ষেত্র
এখানে বাস করে সাঁওতাল, মুণ্ডা, শবর, কোল প্রভৃতি উপজাতির মানুষ। অরণ্যের সঙ্গে তাদের নিবিড় সম্পর্ক। অরণ্য তাদের কাছে জীবন, আরণ্যই তাদের কাছে ঈশ্বর। অরণ্যকে আঁকড়ে প্রবাহিত হওয়া তাদের জীবনে হেমন্ত নতুন মাত্রা আনে। নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ, বনজ সম্পদ সংগ্রহের ব্যস্ততা, শিকার প্রভৃতি ব্যাপারগুলো এইসময় বিশেষ গুরুত্ব পায়। হেমন্তে আদিবাসী সমাজ মেতে ওঠে টুসু উৎসবে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব টুসু দেবীর পুজোকে কেন্দ্র করে। এই উৎসবের প্রাণ হল টুসু গান। এই গানের মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে মেয়েদের জীবনের অনুভূতি, অরণ্যের সঙ্গে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক আর তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা। সাঁওতালদের ঢাক, ঢোল, মাদলের সুরের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় অরণ্যের সুর। এই ঋতু তাই মানুষ ও অরণ্যের মধুর মিলনক্ষেত্র।
নরম সোনালি আলোর ছটা
যাঁরা প্রকৃতি ভালোবাসেন, হেমন্তের হাল্কা হিমের উঁকি দিতেই তাঁরা পাড়ি জমান জঙ্গলমহলে। অরণ্যের শোভা উপভোগ পাশাপাশি এখানকার উপজাতি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতির স্বাদ নেন। জঙ্গলমহলের আশপাশে রয়েছে অনেক নদী, দ্রষ্টব্য স্থান, ঝরনা, ব্যারেজ। হেমন্তের রোদ মেখে মানুষ ছুটে যায় সেসবের সাক্ষী থাকতে।
ঝাড়গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে রয়েছে বেলপাহাড়ি, প্রকৃতির হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা। এখানে রয়েছে বিশাল কাকরাঝোড় বনভূমি। পাহাড়ে গায়ে ছড়িয়ে থাকা শাল, সেগুন, মহুয়ার বিস্তৃত বনরাজি হেমন্তে অসাধারণ রূপ ধারণ করে। হেমন্তের নরম সোনালি আলোর ছটায় পুরো বনকে মনে হয় ধ্যনমগ্ন। হাল্কা শীতের আমেজ গায়ে মেখে এই বনভূমির শান্ত, নির্জন পথে পরিভ্রমণ মনের মধ্যে এক অসাধারণ অভিব্যক্তি জাগিয়ে তোলে। বেলপাহাড়ির এই অরণ্যে হেমন্ত আসলে এক গভীর অনুভব।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপে হয়তো এক গ্রুপে ভারত-পাকিস্তান
জীবনের ব্যঞ্জনাময় ছন্দ
রাজ্যের পশ্চিমপ্রান্তে পুরুলিয়া। পাহাড়, টিলা, লালমাটি আর অরণ্যের অনন্য সংমিশ্রণ। এখানে অরণ্যের প্রকৃতি একদিকে যেমন রুক্ষ-কঠিন, অপরদিকে স্নিগ্ধ-কোমল। এই বৈপরীত্যের মধ্যেই তার অনন্যতা। হাল্কা হিমেল হাওয়ার স্রোত নিয়ে যখন হেমন্ত আসে, তখন অরণ্যও বদলে ফেলে তার রূপ। সবুজের উচ্ছ্বাস কিছুটা ফিকে হয়ে যায়, বাতাসে গায়ে জড়িয়ে থাকে শুষ্ক সুবাস। অরণ্য, পাহাড়, ঝরনা আর আদিবাসী জীবন সংস্কৃতি মিলে রচনা করে জীবনের ব্যঞ্জনাময় ছন্দ। অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে রয়েছে শাল, সেগুন, শিমুল, পলাশের বন। হেমন্তের আগমনে বদলে যায় তাদের রূপ। সবুজ পাতায় দেখা যায় শুষ্কতার ছোঁয়া। বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় পাতাঝরার শব্দ। হেমন্তের দুপুরে শাল সেগুনের দীর্ঘ ছায়ায় ফুটে ওঠে অনাদিকালের নকশা। পলাশের সারি আগুনরঙা ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের যেন ডুবিয়ে রাখে নীরব সাধনায়। এককথায় পুরুলিয়ার অরণ্যে হেমন্ত আসে রূপের ডালি সাজিয়ে, নীরব অথচ গভীর মায়াজল বুনে। শাল সেগুনের বন, লালমাটি, পাহাড়, ঝরনা, আদিবাসী উৎসব মিলিয়ে হেমন্ত এখানে রচনা করে জীবনের অদ্ভুত সংলাপ। অরণ্যের সেই হৈমন্তিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য অসংখ্য মানুষ এই সময় এখানে ভিড় জমায়। এককথায় হেমন্ত এখানে প্রকৃতি ও মানুষের আত্মিক মেলবন্ধনের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়।
অপূর্ব সুর মূর্ছনা
উত্তরবঙ্গের অরণ্যে হেমন্ত মানে আলো-ছায়ার অপূর্ব মেলবন্ধন। দার্জিলিং-কালিম্পং এর চিরসবুজ পাহাড়ি ঢাল, ডুয়ার্সের সমতল, বক্সার ঘন সবুজ অরণ্য হেমন্তের আগমনে সেজে ওঠে নতুন রূপে। পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্স, চা-বাগান, নদী এই সময় স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। বর্ষার সবুজকে জড়িয়ে ধরে রূপালি কুয়াশা আর সোনালি শুষ্কতা। ডুয়ার্সের অরণ্যে হেমন্ত যেন এক নীরব উৎসব। পাহাড় ঘেরা সমতলের এই অঞ্চলে হেমন্তের নরম আলো ছুঁয়ে যায় শাল, সেগুন, শিমুলের শরীর। শালের পাতায় জমে থাকা শিশির ভোরের আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে, শিমুলের খালি ডালে লেগে থাকে কুয়াশার ভেজা স্নিগ্ধতা। ডুয়ার্সের পথ ধরে হাঁটলে মনে হয় হাল্কা কুয়াশা যেন স্নিগ্ধ চাদর মেলে দিয়েছে গাছগাছালির মাথায়। মাঝে মাঝে ভেসে আসা ময়ূরের ডাক পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে তৈরি করে অপূর্ব সুর মূর্ছনা। এসময় শালগাছের পাতার ঘন সবুজ রং উঠে গিয়ে ফুটে ওঠে হলদে-সবুজ দ্যুতি। হেমন্তের আগমনে অরণ্যের প্রতিটি কোণ যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
আলোছায়ার অপূর্ব নকশা
দার্জিলিং আর কালিম্পংয়ের অরণ্যে হেমন্ত যেন এক নীরব রূপান্তর। এখানে পাহাড়ের ঢালে মাইলের পর মাইল জুড়ে রয়েছে পাইনের বন। হেমন্তের সকালে পাইনের ডগায় ঝুলে থাকা শিশির সূর্যের আলোয় ঝলমল করে ওঠে। এছাড়াও রয়েছে ওক, ম্যাপল, ফার, রডোডেনড্রনের বন। হেমন্তে ওক গাছের পাতা ধীরে ধীরে বাদামি হতে থাকে, ম্যাপলের পাতায় লাগে হলুদের ছোপ। রডোডেনড্রন ফুল যেন নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য। গাছের এই রঙের পরিবর্তন অরণ্যকে সাজিয়ে তোলে অপরূপ সৌন্দর্যে। পাতার ফাঁক গলে আসা নরম আলো মাটির বুকে তৈরি করে আলোছায়ার অপূর্ব নকশা। হেমন্তে পাখিদের সুর স্পষ্টভাবে শোনা যায়। নানারকম পাখির ডাক নীরব বনের মধ্যে জাগিয়ে তোলে সমধুর সঙ্গীত। এই সময় বনের মধ্যেকার ঝরনাগুলো হয়ে ওঠে শান্ত ও স্বচ্ছ। দার্জিলিং-কালিম্পংয়ের অরণ্যে হেমন্তের বিকেল যেন হয়ে ওঠে রহস্যময়। বিকেলে সূর্য যখন পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়ে তখন অদ্ভুত সোনালি আভা ছড়িয়ে যায় গোটা বন জুড়ে। গাছের ছায়া লম্বা হয়, কুয়াশার ঘুম ভাঙতে শুরু করে। তারপর রাত্রি নামলে বনের মধ্যে নেমে আসে গভীর নৈঃশব্দ্য। অরণ্যকে তখন মনে হয় পৃথিবীর নয়, দূরের কোনও বাসিন্দা।
নদীর ঢেউয়ের মতো
হিমালয়ের পাদদেশে তরাই অঞ্চলে হেমন্ত নিয়ে আসে স্নিগ্ধ পরিবর্তন। এখানকার জঙ্গলে রয়েছে শাল, সেগুন, পিয়াল, শিমুল, কদম প্রভৃতি গাছ। হেমন্তের আগমনে এদের শরীরে ফুটে ওঠে উজ্জ্বল সোনালি আলো। শাল সেগুনের পাতা ধীরে ধীরে তাদের রং বদলায়। ঝরে পড়া পাতা মাটির বুকে জমে তৈরি করে সোনালি কার্পেট। হেমন্তে তরাইয়ের বনে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে পাখিদের দল। তাদের ডাক স্পষ্ট ও মোহময় হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে বুনো হাতির দল যখন নদী পেরিয়ে অরণ্যের দিকে যাত্রা করে, তখন তাদের সেই যাত্রার মধ্যে ফুটে ওঠে রাজকীয় সৌন্দর্য। হেমন্তে নদীও বদলে ফেলে তার রূপ। তিস্তা, মহানন্দা প্রভৃতি নদীগুলো বর্ষার উদ্দামতা ছেড়ে হয়ে ওঠে শান্ত ও স্বচ্ছ। নদীর ধারে তখনও ফুটে থাকা কাশবন হেমন্তের মৃদুমন্দ বাতাসে নদীর ঢেউয়ের মতো দুলে ওঠে। বালিমাটির ওপর ছোট ছোট প্রাণীদের ছোটাছুটি, বাতাসে জেগে ওঠা গাছের পাতার মৃদু শব্দ কিংবা রাতচরা পশুপাখির ডাকে তরাইয়ের হৈমন্তিক রাতগুলো হয়ে ওঠে মায়াবী ও রহস্যময়। এককথায়, তরাইয়ের হেমন্ত রুক্ষ নয়, তা ধীর ও স্নিগ্ধ।
জীবনের সুর
বাংলার অরণ্যে হেমন্তের আগমন নিয়ে আসে রূপান্তরের বার্তা। পাতাঝরার শব্দ, নদীর শান্ত-স্নিগ্ধ স্রোত, কুয়াশার নরম পর্দা আর হলদে সোনালি আলো। সব মিলিয়ে হেমন্ত তৈরি করে এক ধ্যানমগ্ন পরিবেশ। এই ঋতু আমাদের শেখায় সৌন্দর্যের সূক্ষ্ম ভাষা, অনুভব করতে শেখায় নীরবতার গভীরতা। দক্ষিণবঙ্গের লালমাটি, পাহাড়, শালবন থেকে শুরু করে কুয়াশামাখা উত্তরবঙ্গ– সব জায়গায় হেমন্তের রূপ আলাদা হলেও তার সুর এক। সেই সুর জীবনের। সেই সুর প্রকৃতিকে বেঁধে রাখে এক সুতোয়।

