বাংলা অনেক অশ্রু নদীর সাক্ষী।
বাংলা রক্ত নদী অনেক দেখেছে।
চর্যাপদের যুগ থেকে তুর্কি আক্রমণ, সেখান থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, সিপাহি বিদ্রোহ থেকে নীল চাষিদের ওপর অত্যাচার, সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে অগ্নিযুগ, ’৪৭ এর দেশভাগ থেকে যুক্তফ্রন্ট আমলে নৈরাজ্যের প্রসৃতি, সেখান থেকে সাম্প্রতিক অতীতে বাম আমলে হিংসার উৎসব, অনেক, অনেক কিছুর সাক্ষী এই রাজ্য।
শশাঙ্কের আমল থেকে মরিচঝাঁপি, সেখান থেকে ২১ জুলাই, গণহত্যার রক্ত বঙ্গ দেশের আনাচে-কানাচে, নদীতে-নালায়, অনেক বয়েছে।
বাংলার চাষি অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। বাংলার মা-বোন অনেক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বাঙালি হিন্দু, বঙ্গবাসী মুসলমান নানা সময়ে হিংসার, হামলার, অগ্নিকাণ্ডের যন্ত্রণা সয়েছে। কিন্তু হিংসার এমন নির্বিকার প্রকাশ, নির্যাতনের এমন নিরুপদ্রব পৈশাচিকতা, প্রাণ হরণের বীভৎসতার প্রতি এমন প্রশাসনিক ঔদাসীন্য ইতোপূর্বে পশ্চিমবঙ্গ কখনও দেখেনি।
নিধনের এমন তমসাচ্ছন্ন প্রতিবেশে আলোকস্তম্ভের মতো মানবিকতার প্রদীপ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন কেবল জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তাঁর পাশে সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর যেন কিচ্ছুটি নেই কোত্থাও, ‘সূর্য নিভে গেছে’।
হিংসার নাম এখন এসআইআর।
জিঘাংসার নাম এখন এসআইআর (Election Commission_SIR)।
নির্মম হননোৎসবের নাম এখন এসআইআর।
দিল্লির জমিদারবাবুরা বলেন, এ হল স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিসন, ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন।
আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখছি, এ হল সাইলেন্ট ইনহিউম্যান রেনেগেড (special inhuman renegade)। নীরব অমানবিক পক্ষ পরিবর্তন। যা হতে পারত জনগণকে ভোট প্রক্রিয়ায় অংশীদার করণ প্রক্রিয়ার শুদ্ধ রূপ, সেটা হয়ে উঠেছে জনগণের ভোটাধিকার হরণের সুচতুর নোংরামি।
বাম আমলের সায়েন্টিফিক রিগিং এখন নির্বাচন কমিশনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে হয়ে উঠেছে চুপচাপ নিবিড়ভাবে রিগিং বা ভোট লুঠের প্রক্রিয়া।
এবং তা প্রাণঘাতী। আতঙ্কে মৃত্যু হচ্ছে ভোটারদের। কাজের চাপে আত্মঘাতী হচ্ছেন বিএলওরা। বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা প্রবাহ।
২৩ নভেম্বর , ২০২৫, রবিবারের ঘটনা। ঘটনাস্থল বর্ধমান জেলার কাটোয়া বিধানসভা এলাকা। এনুমারেশন ফর্ম সংগ্রহ করতে গিয়ে যুগপৎ কর্মব্যস্ততার চাপে ও কমিশনের বিজেপির ভোটসখাসুলভ হুমকিতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এক বিএলও। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। কোনও রাজনৈতিক দল নয়, বিএলওর স্ত্রী জানিয়েছেন, ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) কাজ নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় ছিলেন স্বামী। সেখান থেকেই এই অসুস্থতা। কাটোয়া বিধানসভার ১৪৭ নম্বর বুথের ওই বিএলওর নাম শুকদেব দাস।
কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
আরও এক বিএলওর কথা। ঘটনাস্থল দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর। শনিবার ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) অভিযানের মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়েন কমলপদ নস্কর। হরিনারায়ণপুর পঞ্চায়েতের ৩১ নম্বর বুথের বিএলও তিনি। পেশায় স্কুলশিক্ষক। বছর পঞ্চাশের কমলপদ শনিবার বিকেলে বাড়ি বাড়ি এসআইআরের ফর্ম সংগ্রহ করে ফেরার পথে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান। তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। গত কয়েক দিন ধরে এসআইআর (Election Commission_SIR) সংক্রান্ত কাজের চাপে মানসিক এবং শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন প্রৌঢ়। অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট বুথে প্রায় ১১৬০টি ফর্ম তাঁকে একা বিলি করতে হয়েছে তাঁকে। ফর্ম হাতে পেতে দেরি হওয়ায় বিলিতেও দেরি হয়েছে। ফলে ফর্ম ফেরত নেওয়ার সময়সীমা দেখে চাপে পড়ে যান তিনি। শনিবার পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক ফর্ম ফেরত আনতে পেরেছিলেন কমলপদ। এ দিনই আবার পঞ্চায়েত দফতরে বৈঠকে নির্দেশ দেওয়া হয়, দ্রুত সমস্ত এসআইআর ফর্ম ফেরত আনতে হবে।
আরও পড়ুন-দৃষ্টিহীনদের ক্রিকেটেও এবার ভারতের মেয়েদের বিশ্বজয়
কম সময়ে প্রচুর কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ায় রাজ্যের বহু কর্মী এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। কারও মৃত্যু হয়েছে, কেউ আত্মহত্যা করেছেন। এভাবে এসআইআর প্রক্রিয়ায় রাজ্যে প্রতিদিনই কোনও না কোনও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটছে। এনুমারেশন ফর্ম পূরণ পর্বে দিকে দিকে ঘটছে বিপত্তি। এবার জলপাইগুড়িতে ঘটল ভূতুড়ে কাণ্ড! বাড়ি বাড়ি ঘুরে এসআইআরের এনুমারেশন ফর্ম সংগ্রহ করে ডিজিটাইজেশনের কাজ করছেন বিএলও। কিন্তু নিজের নামই ডিজিটাইজ করতে পারছেন না তিনি। কারণ, ২০০২ সালের ভোটার তালিকার হার্ড কপিতে জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম; কিন্তু যখন তিনি অ্যাপে ঢুকে নিজের নাম ডিজিটাইজেশনের জন্য ২০০২ সালের ভোটার তালিকার সঙ্গে ম্যাচ করাতে যাচ্ছেন, তখন একই সিরিয়াল নম্বরে অন্য এক মহিলার নাম দেখাচ্ছে। প্রশাসনকে জানিয়েও এখনও পর্যন্ত কোনও সুরাহা হয়নি। ফলে নিজের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার আশঙ্কায় চিন্তিত সঞ্জয়কুমার ঘোষ।
এসআইআরে (Election Commission_SIR) ৪৭ লক্ষ কমে বিহারে ৭ লক্ষ ৪২ হাজার ভোটার, অথচ ভোট পড়েছে ৭ কোটি ৪৫ লক্ষ ২৬ হাজার ৮৫৮টি! এটা সত্যি চুরি না অন্যকিছু তার সাফাই দিতে কেউ মহামান্য জ্ঞানেশ কুমারকে এখনও বাধ্য করতে পারেনি। কমিশনই সুপ্রিম সাংবিধানিক সংস্থা! কিন্তু সজাগ কমিশনের নজর এড়িয়ে ভোটের আগের রাতেও মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কীভাবে ১০ হাজার টাকা ঢুকল তার ব্যাখ্যা চাওয়া কি অন্যায়? এটা কি নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে না? যেদিন ভোট ঘোষণা হয় সেদিন থেকেই সব রাজনৈতিক দল ও সরকারের সব ডানা ছেঁটে দেয় কমিশন। কিন্তু কেন্দ্রের শাসক সেই একই ভুল করলে সাত খুন মাফ? আসলে বশংবদ তাঁরাই হতে পারেন যাঁদের শত প্ররোচনাতেও মাথা ঠান্ডা আর চোখের দৃষ্টি সর্বদা শীতল। এই গুণের অধিকারী না হলে সদা শাসকের হুকুম তামিল করা কোনও সাংবিধানিক পদাধিকারীদের পক্ষে অসম্ভব? সংঘী জ্ঞানেশজিকে বাহবা দিতেই হয়! এই বাহবার সঙ্গেই তারজন্য আর একটা কুর্নিশও প্রাপ্য!
গোটা একটা নির্বাচনে দলীয় হিংসায় যত মানুষের মৃত্যু হয় তাকে ছাপিয়ে এসআইআরে ৩৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে এই বাংলায়।
এর দায় কে নেবে?

