রাজ্যে মৃত্যুমিছিল। একের পর এক বিএলও আত্মঘাতী হচ্ছেন কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এক কথায় নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনাহীনতার যূপকাষ্ঠে মরতে হচ্ছে তাঁদের। তবু নির্বিকার কমিশন। মিথ্যাচার মিডিয়ার একাংশের। উল্লাস বিজেপি শিবিরে, জল্লাদের আনন্দ প্রকাশ তাতে প্রতিফলিত।
রিঙ্কু তরফদার (৫১)-এর প্রাণহীন দেহের পাশ থেকে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে নিজের মৃত্যুর জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেছিলেন তিনি। কোনও রাখঢাক না করে। অথচ, এই মৃত্যুর জন্য কোনও এফআইআর দায়ের হয়নি, এই অজুহাতে পুরো বিষয়টা এড়িয়ে মাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে দানবিক ইলেকশন কমিশন ও অমানবিক বিজেপি শিবিরের তরফ থেকে। পাশে বাজারি কাগজের পরোক্ষ সমর্থন। আরএসএস-এর সঙ্গী এক মিডিয়া কর্মী তাঁর ফেসবুক পোস্টে আত্মহত্যার ঘটনাগুলোকে ‘সুইসাইডের নাটক’ বলতে ইতস্তত করেননি। কতটা নিচে নামলে, কতখানি অসংবেদনশীল হলে মৃত্যু নিয়ে এরকম মশকরা করা যায়!
আরও পড়ুন-শিকড়ের সন্ধানে
এইসব আসুরিক মানসিকতার ব্যক্তিবর্গ সম্ভবত জানেন না, এরকম ঘটনা যে কেবল পশ্চিমবঙ্গে ঘটছে, তা নয়। অন্য সব জায়গা বাদ দিলেও যোগী রাজ্যে ও মোদি রাজ্যেও ঘটছে, ঘটেই চলেছে, একেবারে ঘটমান বর্তমান।
৫০ বছর বয়সি বিজয়কুমার বর্মা লখনউয়ের মলিহাবাদ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষামিত্র হিসাবে কাজ করতেন। নিজের এলাকায় বিএলও-র দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। বিজয় মারা গিয়েছেন গত শুক্রবার রাতে। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায়। লখনউয়ের এই বিএলও-র মৃত্যুর পর উত্তরপ্রদেশ প্রাথমিক শিক্ষামিত্র সঙ্ঘের রাজ্য জেনারেল সেক্রেটারি সুশীল কুমার কমিশনকে কাঠগড়ায় তুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য সিনিয়র আধিকারিকেরা ওঁকে চাপ দিচ্ছিলেন। বলেছিলেন, সময়ে কাজ শেষ না-করতে পারলে ওঁর বিরুদ্ধে এফআইআর করা হতে পারে। যখন-তখন ফোন করছিলেন।’’ মৃতের পরিবারও এসআইআর-এর কারণে মারাত্মক চাপের কথা জানিয়েছেন, দাবি সুশীলের। কাজ করতে করতে গত সপ্তাহে পড়ে গিয়েছিলেন বিএলও। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচানো যায়নি।
আরও পড়ুন-হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য তৃতীয় অনুরোধ
শুক্রবারই গুজরাতে নিজের বাড়ি থেকে এক বুথ লেভেল অফিসারের (বিএলও) ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। পরিবারের দাবি, এসআইআরের কাজে মানসিক চাপে ভুগছিলেন। সেই মানসিক অবসাদ থেকেই চরম পদক্ষেপ করলেন তিনি। সুইসাইড নোটে না কি সেই কথা উল্লেখ করেছেন মৃত বিএলও।
গুজরাতের গিরের এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন অরবিন্দ ভাধের। তাঁর এলাকায় এসআইআর কাজের জন্য বিএলও হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত কয়েক দিন স্কুল সামলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এনুমারেশন ফর্ম বিলি করছিলেন অরবিন্দ। শুধু তা-ই নয়, ভোটারদের ফর্ম পূরণ হয়ে গেলে, তা সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে অনলাইনে আপলোড করা সবই করতে হচ্ছিল। তা নিয়ে মানসিক চাপে ছিলেন অরবিন্দ। শেষে শুক্রবার সকালে নিজের ঘর থেকে অরবিন্দের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। সুইসাইড নোটে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার পক্ষে এসআইআরের কাজ করা আর সম্ভব হচ্ছে না। এই কাজ গত কয়েক দিন ধরে আমি ক্লান্ত এবং মানসিক ভাবে চাপে আছি। দয়া করে আপনারা আমার পুত্রের যত্ন নিন। এই পদক্ষেপ করার ছাড়া আমার কাছে আর কোনও উপায় ছিল না।’’
এর মধ্যেই সামনে এসেছে আরেক খবর।
বিজেপির উসকানিতে তাদের নয়া শাখা সংগঠন নির্বাচন কমিশন এমন একটি কাজ করেছে, যা আদতে কমিশনের দ্বিচারিতা ফাঁস করে দিয়েছে। তাদের মুখ আরও পুড়িয়েছে।
আরও পড়ুন-অভিষেকের হস্তক্ষেপে-কৈলাসের প্রচেষ্টায় তৈরি হবে বালির ৭৬টি রাস্তা
২৫ সেপ্টেম্বর একটি টেন্ডার ডাকে সিইও দফতর। সেখানে বলা হয়, ভোট-সংক্রান্ত কাজে রাজ্য জুড়ে এক বছরের চুক্তিতে হাজার ডেটা এন্ট্রি অপারেটর নেওয়া হবে। তার জন্য বেসরকারি এজেন্সিগুলিকে দরপত্র দিতে বলা হচ্ছে। ভোটার ম্যাপিং, ইলেক্টোরাল রোল তৈরি-সহ বিপুল কাজ করতে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর প্রয়োজন ছিল। সেজন্যই এই বিজ্ঞপ্তি। এবং সেটা কখন দেওয়া হল? যখন বিধানসভা নির্বাচন বহুদূর, এসআইআরের ঘোষণাও হয়নি। অর্থাৎ, নিজেদের কাজ আগেভাগে গুছিয়ে রেখেছে কমিশন।
আর এখন, এক মাসের সময়সীমায় বিএলওদের নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া সত্ত্বেও গা নেই তাদের! ১৯ দিনে এই ১২টি রাজ্যে ১৮ জন বিএলওর মৃত্যুর খবর সামনে এসেছে। অধিকাংশই আত্মঘাতী। তারপরও ২১ নভেম্বর কমিশন বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রত্যেক জেলাশাসক তথা জেলা নির্বাচনী আধিকারিককে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এসআইআরের কাজে চুক্তিভিত্তিক ডেটা এন্টি অপারেটর, বিএসকে কর্মীদের নিয়োগ করা যাবে না। এক কথায়, বিএলওদের ডেটা এন্ট্রির জন্য কোনও সহায়ক দিতে পারবে না জেলা প্রশাসন। সব কাজ বিএলওদেরই করতে হবে।
কেন এই দ্বিচারিতা? কারণ, পালের গোদা বিজেপি এমনটাই করতে বলেছে। বঙ্গ বিজেপি চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছিল, এভাবে নাকি ভোটারদের যাবতীয় তথ্য শাসক তৃণমূলের হাতে চলে যাবে। তারই জেরে কমিশনের এমন নিষেধাজ্ঞা। অথচ, যে এক হাজার অপারেটর নিয়োগের জন্য কমিশন টেন্ডার ডেকেছিল, তাঁরাও তো বেসরকারি সংস্থারই নিয়োগ! সেক্ষেত্রে তথ্য ফাঁসের ভয় নেই? ওয়েবেল কিংবা এনআইসির মতো সরকারি সংস্থাকে দায়িত্ব না দিয়ে বেসরকারি অপারেটরদের হাতে কেন এই কাজ ছাড়া হল? আর এটা করার পর এখন বিএলওদের পাহাড়প্রমাণ চাপ কমাতে প্রশাসন যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, বা সহায়ক নিয়োগ করে সেখানে আপত্তি কোথায়?
আসলে, এই ঘটনা নির্বাচন কমিশনের দ্বিচারিতাই প্রকাশ করেছে। বিজেপির উসকানিতে ওরা বাংলার ভোট প্রভাবিত করার খেলায় নেমেছে।
আরও পড়ুন-শাহ ও জ্ঞানেশের নামে খুনের মামলা করা উচিত
পরিশেষে আর একটা অমানবিকতার ছবি। এই ছবি আমাদের রাজ্যের, ঘাটালের। ৬৫ শতাংশ প্রতিবন্ধকতা নিয়েও দিনরাত এক করে কাজ করে যেতে হচ্ছে ২৩০-দাসপুর বিধান সভার ৮০ নম্বর বুথের বিএলও সৌগত ধাড়াকে। তিনি দু’হাতে এলবো ক্রাচে ভর করেই বাড়ি-বাড়ি এসআইআরের ফর্ম নিয়ে ঘুরছেন। এসআইআরে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষকও বিএলও’র দায়িত্ব থেকে রেহাই পাননি। আট বছর চাকরি জীবনের আগে কখনও তাঁর ভোটে বা বিএলও’র দায়িত্ব পড়েনি। কিন্তু এবারই আচমকাই তাঁর এসআইআরের মতো বিশাল চাপযুক্ত ডিউটি ঘাড়ে পড়ে গিয়েছে। ৮০ নম্বর বুথে ভোটার সংখ্যা ৮০০’র কাছাকাছি। যেখানে বিএলও সৌগত ধাড়াকে চলাফেরা করতে হলে হাত দু’টিতে ক্রাচ ধরে রাখতে হয় সেই পরিস্থিতিতে ৮০০ ভোটারের দু’কপি করে মোট ১৬০০ এসআইআর ফর্ম-সহ অন্য নথি নিয়ে দোরে, দোরে যেতে হচ্ছে। প্রত্যেক দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ি, বাড়ি গিয়েই ফর্ম পূরণের আপডেট সংগ্রহ, পূরণ করা ফর্ম ভোটারদের থেকে নিয়ে সেগুলি দায়িত্ব সহকারে আপলোড করতে হচ্ছে।
সম্প্রতি একের পর এক বিএলওর অসুস্থতার খবর সামনে এসেছে। একাধিক বিএলও আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছেন। যেখানে এসআইআরের চাপে সুস্থ কর্মীরাই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন সেখানে একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে এই ডিউটি দেওয়া কোনও ভাবেই মানা যায় কি!

