এর আগে জুলাই মাসে রাজ্যসভা সেক্রেটারিয়েট ‘হ্যান্ডবুক ফর মেম্বারস অফ রাজ্যসভা’ প্রকাশ করেছিল। তাতে সংসদের ভিতরে-বাইরে ‘বন্দে মাতরম্’ ও ‘জয় হিন্দ’ (Jai Hind-Vande Mataram) উচ্চারণের উপর নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছিল। এইবার সংসদের তরফে বুলেটিন প্রকাশ করে জানিয়ে দেওয়া হল—‘থ্যাঙ্কস’, থ্যাঙ্ক ইউ’, ‘জয় হিন্দ’ অথবা ‘বন্দে মাতরম্’ জাতীয় স্লোগান দেওয়া চলবে না (বুলেটিন নং ৬৫৮৫৫)। স্বাভাবিকভাবেই দেশব্যাপী সমস্ত বিরোধী দলই এই তুঘলকি ফরমানের বিরোধিতা করেছে। বিশেষত, ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীতটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতার লড়াইয়ের দীর্ঘ ইতিহাস। আর, ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও ‘আইএনএ’ বাহিনীর তীব্র লড়াইয়ের ইতিহাস। ২৬ নভেম্বর ছিল ‘ভারতীয় সংবিধান দিবস’। ওই নির্দিষ্ট দিনটির ঠিক আগেই বুলেটিন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এহেন নিষেধাজ্ঞা জারি করা ঠিক কোন তাৎপর্য বহন করে আনে?
বিজেপি এমন একটি দল যাদের পিছনে মূল শক্তিকেন্দ্র হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তাদের আরও বেশ কিছু শাখা সংগঠন, যাদের একত্রে ‘সঙ্ঘ পরিবার’ বলা হয়। সঙ্ঘ যখন কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তা কেবল সামনের দিকে তাকিয়ে নেয় না, বরং দীর্ঘমেয়াদি ভাবনার সাপেক্ষেই নেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির মধ্যবর্তী একটি স্তবক, যাতে ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণ-ধারিণী/ কমলা কমলদলবিহারিণী/ বাণী বিদ্যাদায়িনী/ নমামি ত্বাং’ কথাগুলি রয়েছে, ১৯৩৭-এর কংগ্রেস অধিবেশনে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এর হিন্দু পৌত্তলিকতার ছাপ ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে অসন্তুষ্ট করতে পারে— এই ভাবনা থেকে। সেইসময় জাতীয় স্বাধীনতার লড়াইয়ের নেতৃত্বের কাছে সাম্প্রদায়িক ঐক্য রক্ষা করাই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বর্জনের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছিলেন। অথচ, ১৮৭৫ অথবা ১৮৭৪-এ রচিত ‘বন্দে মাতরম্’ গান যখন ‘আনন্দমঠ’-এ সংযুক্ত হয় সেইসময় থেকে শুরু করে ১৮৯৬-এর কংগ্রেসের সাধারণ অধিবেশন, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন হয়ে, যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির সশস্ত্র ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের পর্যায় পেরিয়ে এই গান গোটা দেশের জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। অরবিন্দ ঘোষ একে ‘রিলিজিয়ন অফ প্যাট্রিয়টিজম’ আখ্যা দিয়েছেন। ১৯০৬ সালে মৌলানা আক্রম খাঁ প্রমাণ করেছিলেন এই গানের সঙ্গে ইসলামের কোনও বিরোধ নেই। স্বদেশি আন্দোলনের সময় লিয়াকত হোসেন নামের এক বিপ্লবী যুবকের নামও জড়িয়ে যায় এই গানকে স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উন্নীত করার লড়াইয়ে পরিণত করার ক্ষেত্রে। এমনকী ১৯৩৯-এ ‘হরিজন’ পত্রিকায় মহাত্মা গান্ধিও লেখেন তাঁর কোনওদিন মনে হয়নি এই গান সাম্প্রদায়িক। আর, ‘জয় হিন্দ’ (Jai Hind-Vande Mataram) শ্লোগানটি তৈরির পিছনে রয়েছেন নেতাজির বিশ্বস্ত সঙ্গী হায়দরাবাদি মুসলিম যুবক আবিদ হাসান। নেতাজি এই স্লোগানটিকেই তাঁর দেশমুক্তির লড়াইয়ের হাতিয়ারে পরিণত করেন। কাজেই এই গান এবং স্লোগানকে কোনও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে দেখাই অনৈতিক। এদের সঙ্গে মিশে রয়েছে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের শতশত শহিদের রক্ত, অশ্রু, ঘাম।
আরও পড়ুন-মানুষ মারার চক্রান্ত এসআইআর, নিজেদের অস্ত্রেই এবার বধ হবে বিজেপি, তোপ মন্ত্রীর
কিন্তু যে সংঘ, হিন্দু মহাসভা গোটা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামেই ব্রিটিশের হয়ে দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া অন্য কিছু করেনি, যারা এই উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম মিলিত ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশমাতৃকার লড়াইকে কেবল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি হিসেবে ব্যবহারই করে গেছে কেবল, বিনিময়ে ব্রিটিশের সেবাদাস হিসেবে কাজ করার জন্য পারিতোষিক কুড়িয়েছে, সেই দেশদ্রোহী ব্রিটিশভজনাকারী শক্তি যে আজ এই দুটি স্বাধীনতার অনুষঙ্গে জড়িয়ে থাকা গান ও স্লোগান নিয়ে আপত্তি তুলবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর অন্যতম নেপথ্য কারণ হল এই দুটির সঙ্গেই জড়িত দুজন বাঙালি—বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ঐতিহাসিকভাবেই সংঘ পরিবার গোটা বাঙালি জাতিকে ঘৃণা করে। কারণ, বাংলার রেনেসাঁস বা নবজাগরণ যে মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক পশ্চাৎপদ চিন্তাধারাকে আক্রমণ করতে শিখিয়েছিল, সঙ্ঘের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গিয়েছে সেই বদ্ধমূল সামন্তবাদী ভাবধারা। ভারতের গোটা স্বাধীনতার লড়াইতে শ্রেষ্ঠ অবদান বাঙালির, যা মুচলেকারীর সাভারকারের মতো দেশদ্রোহী চতুর ব্রিটিশভজা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে অস্বস্তির। আন্দামানের সেলুলার জেলে ৫৯০ জন দ্বীপান্তরিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর মধ্যে সত্তর ভাগেরও বেশি বাঙালি। কোনও সাম্প্রদায়িক ইরেজার দিয়ে সেই ইতিহাস মোছা যাবে না। অতএব, জাতীয় সংগ্রামের পৃষ্ঠা থেকে বাঙালির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অবদান একটু একটু করে মুছে দাও। এবং সেই মুছে দেবার কাজটা করো সাংবিধানিক পরিসরেই, অত্যন্ত সুচারুভাবে। তাই আন্দামানের সেলুলার জেলের বন্দিতালিকা থেকে একদিকে ওরা ছেঁটে ফেলছে বাঙালি বিপ্লবীদের নাম। একইসঙ্গে যেসব সঙ্গীত, যেসব স্লোগান সেদিনের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধের অন্যতম চিহ্ন, সেগুলোকেও নিষিদ্ধ করছে একটু একটু করে।
আরও একটি কারণ রয়েছে এই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির তুঘলকি কাজকর্মের পিছনে। সেটি হল, স্বাধীনতার পূর্বলগ্ন থেকেই আরএসএস ভারতীয় সংবিধানকে মান্যতা দেয়নি। তারা স্বাধীন ভারতের সংবিধান মানে না। দেশের জাতীয় পতাকাকে মানে না। দেশের ফেডেরাল কাঠামোকে মানে না। সেকারণেই যে গান একদিন গোটা ভারতীয় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের পথ দেখিয়েছিল, যে স্লোগান গোটা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, এই বিভাজনের শক্তি তার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। ভারতীয় সংবিধানের জন্মলগ্ন থেকেই রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ গানটি ভারতের ‘ন্যাশনাল অ্যান্থেম’ আর ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি আমাদের ‘ন্যাশনাল সং’। একটি ব্যবহৃত হয় প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি প্রোটোকল হিসেবে, অন্যটি সাংস্কৃতিক ও দেশপ্রেমিক অনুষ্ঠানে। কাজেই, আসামের বিজেপি সরকার যখন ‘জনগণমন’-কে বিদেশি রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে চিহ্নিত করে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে আর যখন বিজ্ঞপ্তি জারি করে সংসদের ভিতরে-বাইরে এই গান আর স্লোগানকে নিষিদ্ধ করা হয়, তখন ভারতরাষ্ট্র যে এক চরম আধিপত্যবাদী শাসকের কবলে চলে গেছে, তা নিশ্চিত হয়।
স্বাধীনতার পর ৫২ বছর যে আরএসএস জাতীয় পতাকা তোলেনি, যাদের শাখায় আজও ‘জনগণমন’ নয়, ‘নমস্তে সদা বৎসলে’ গাওয়া হয়, তারা আধুনিক ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায় প্রাক্-ঔপনিবেশিক যুগে। তাদের রাজনৈতিক মুখ বিজেপি সরকারের কাছ থেকে এই সিদ্ধান্তই স্বাভাবিক।

