‘বিনোদিনী একটি নটীর উপাখ্যান’-এর সাফল্যের পর সদ্য মুক্তি পেল পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ছবি ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল’ (Lokkhikantopur Local)। একটা সময় মুম্বইয়ে চুটিয়ে সাংবাদিকতা করতেন পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়। নামী ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব সামলেছেন, লিখেছেন একাধিক বই। ছবি পরিচালনাতেও রেখেছেন কৃতিত্বের স্বাক্ষর, পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও। যদিও সবটাই এতদিন ছিল বলিউড ঘিরে। এরপর টলিউডেও প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করলেন। ছবির নাম ‘বিনোদিনী এক নটির উপাখ্যান’। রুক্মিণী মৈত্র অভিনীত বহুচর্চিত নটী বিনোদিনীর জীবনগাথা অবলম্বনে তৈরি এই ছবি মুক্তির পরেই কাঁপিয়েছে এবং কাঁদিয়েছে গোটা বাংলাকে। দর্শক, সমালোচক মহলে ছবিটি পেয়েছে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। পরিচালক হিসেবে টলিউডে প্রথম ছবিতেই একশোয় একশো পেয়েছেন রামকমল।
সেই রেশ কাটতে না কাটতে আবার হইচই শুরু। মুক্তি পেল রামকমল মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় ছবি ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল’ (Lokkhikantopur Local)।
লক্ষ্মীকান্তপুর, ক্যানিং, বজবজ, বনগাঁ লোকালে চড়ে ভিড়ের চাপে ঝাঁঝরা হয়ে দলবেঁধে নামা নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষদের শহুরে জটিলতায় নিরন্তর অভিযোজন করে চলার গল্প হল ‘লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল’। আসলে লক্ষ্মীকান্তপুর লোকাল ট্রেনটি যেমন এক কঠিন বাস্তব, এই ছবিটাও তাই।
গল্পের শুরু শহর কলকাতার তিনটে পরিবারকে নিয়ে। ব্যাঙ্ককর্মী উৎপল এবং তার স্ত্রী লাবণ্য, ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপর্ণা এবং তার লেখক স্বামী অণির্বাণ, নতুন প্রজন্মের স্ট্রাগল করা গায়ক দীপ এবং তার বান্ধবী তিয়াসা। এই তিনটে পরিবারেই হঠাৎ গৃহসহায়িকার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কারও নিতান্ত সাংসারিক প্রয়োজনে, তো কারও অসুস্থ স্বামীর দেখভাল করতে, আবার কারও বৃদ্ধ বাবাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। কারণগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও আজকের যুগে বহু গৃহস্থবাড়িতে এগুলোই এক একটা বড় সমস্যা। ফলে গৃহকর্মী ছাড়া গতি নেই। এমতাবস্থায় লক্ষ্মীকান্তপুর (Lokkhikantopur Local) থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে আসা তিন গৃহকর্মী সরস্বতী, কল্যাণী এবং মালতীর প্রবেশ সেই তিনটি পরিবারে। তারা পরস্পরের বন্ধু, সহমর্মী এবং কঠিন জীবনযুদ্ধে শামিল। মমতাময়ী আয়া সেন্টার থেকে নিযুক্ত হওয়া অচেনা-অজানা এই তিন নারী কাজ করতে করতে কখন যেন সেই পরিবারগুলোর ভালয়-মন্দয়ে, সঙ্কটে, সমস্যায় একটু একটু করে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ঢুকে পড়লেও তারা কি একাত্ম হয়ে উঠতে পারে শহুরে মানসিকতার সঙ্গে? সমাজ কি তাঁদের গ্রহণ করে? এই ছবির প্রশ্ন এটাই।
আরও পড়ুন-তৈরি শূন্যতা বাকি জীবন জুড়ে থাকবে, ধর্মেন্দ্রর প্রয়াণে শোকাহত হেমা
সরস্বতী, কল্যাণী এবং মালতীর সঙ্গে ওই তিনটি পরিবারের, সম্পর্কের, ভালবাসার, টানাপোড়েনের এক সুন্দর অথচ বাস্তবচিত্র এঁকেছেন পরিচালক রামকমল মুখোপাধ্যায়।
এ-যুগে ‘আয়া সেন্টারের বা সেন্টারের আয়া’ শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা খুব ফ্যামিলিয়র হয়ে গেছি। দিনে দিনে এরা হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু এই গৃহকর্মীরাই যে-কোনওদিন কোনও ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠতে পারে তা এই ছবি না দেখলে বোঝা যেত না! এমন মৌলিক ভাবনা বুঝি রামকমলই ভাবতে পারেন। দলবেঁধে শহরে আসা গ্রামের সহজ, সরল মানুষদের শহুরে জটিলতার মাঝে খাপ খাওয়ানোর গল্প এই ছবি। যা দেখতে বসলে প্রায় সব মানুষই নিজের পরিবারের সঙ্গে রিলেট করতে পারবে।
অনেকদিন পরে কোনও বাংলা ছবিতে একসঙ্গে এত তারকা সমাগম দেখতে পাওয়া গেল। ছবিতে উৎপলের ভূমিকায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এবং স্ত্রী লাবণ্যের চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। ওঁদের দুর্দান্ত রসায়ন। বিয়ের ৩০ বছর পরেও তাঁদের মধ্যবিত্ত প্রেম অটুট। বাংলাদেশের প্রতি অদ্যম টান অনুভব করেন বাঙাল উৎপল। তার স্ত্রী লাবণ্য ঘটি। অবসরের ঠিক আগে ঘটে যায় এক বিপর্যয় সেই সূত্র ধরেই বাড়িতে আসে বাংলাদেশ থেকে ছিন্নমূল হওয়া কল্যাণী। এই চরিত্রে পাওলি দাম যেন জীবন্ত। দুর্দান্ত অভিনয়। বাঙাল-ঘটির যে সূক্ষ্ম তফাত সেটাও খুব সুন্দর তুলে ধরেছেন পরিচালক। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি দেখতে গেলে তিনি ভাল পরিচালক না দারুণ অভিনেতা— এটা নিয়ে সবসময় একটা প্রশ্ন থেকেই যায় মনে। আসলে দুটো ক্ষেত্রেই উনি অসাধারণ। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে নিয়ে আলাদা করে আর বলার কিছু নেই। অন্যদিকে আধুনিক যুগের অল্পবয়সি লিভ ইন কাপল দীপ আর তিয়াসা। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন জন ভট্টাচার্য এবং রাজনন্দিনী পাল। খুব সাবলীল, স্বচ্ছন্দ্য অভিনয় দুজনেরই। দীপ ও তিয়াসার বাড়ির আয়া সরস্বতীর চরিত্রে সায়নী ঘোষ দুর্দান্ত। ইংরেজির অ-টাও না-জানা অর্ধশিক্ষিত আয়া সরস্বতীর দুষ্টু-মিষ্টি সংলাপে, সিরিয়াস জীবনকে মজার ছলে কাটিয়ে দেবার, বাস্তবের মাঝে অবাস্তবের স্বপ্ন দেখার স্টাইল দেখে মনটা ভরে যায়। অন্যদিকে, অপর্ণা আর অনির্বাণের সংসার। অসুস্থ বাবার দেখভাল করতে আসা মালতী। মাতৃত্বের তৃষ্ণায় সে খুঁজে বেড়ায় ভালবাসার আশ্রয়। এই চরিত্রে রয়েছেন চান্দ্রেয়ী ঘোষ। মনে রাখার মতো তাঁর অভিনয়। একটি বিশেষ ভূমিকায় গরিব খেটে খাওয়া মানুষের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেখা যাবে মন্ত্রী মদন মিত্রকে। ছবির পরতে পরতে রয়েছে অনেক চমক আর শেষটায় কী হয় তা দেখতে যেতে হবে প্রেক্ষাগৃহে বসে। ছবির প্রযোজনায় অ্যাঞ্জেল ক্রিয়েশন এবং প্রমোদ ফিল্মস।

