নীরবে নিঃশব্দে সংবিধান দিবস অতিক্রান্ত হল। তার অব্যবহিত পরেই সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে নেতাজির আগুন ঝরানো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জয় হিন্দ ও সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠের বন্দে মাতরম্ স্লোগান নিষিদ্ধ করার ঘোর গেরুয়া ফতোয়া নেমে এল। এই ভূমিকায় আরও বেআব্রু হল দিল্লির দৈত্যদের ব্রিটিশ চাটুরিকতার নগ্ন ইতিহাস।
বলাবাহুল্য, এমন এক অস্থির-বিপন্ন সময়ে যখন কার্যত তিলে তিলে স্লো-পয়জনের মাধ্যমে সংবিধান হত্যা করতে উদ্যত আরএসএস-বিজেপির জমিদাররা। নিজস্ব অ্যাজেন্ডা ও পেয়ারের পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার্থে সংবিধান ও দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বলিকাঠে চড়াতে এদের বুকে বাধছে না। দেশের এক বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বিভেদ-বিদ্বেষের মাধ্যমে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাতে চরম তোড়জোড় চলছে দেশের নির্বাচন কমিশনের বকলমে।
এসআইআর হল সেই জাঁতাকল যাতে খাঁচাবন্দি করার অপচেষ্টা চলছে ভারতের ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্রকে। এতদিন মানুষ তাঁদের সরকার বেছে নিত। জাতীয় নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের অঙ্গুলিহেলনে শুরু হয়েছে ভোটার বেছে নেওয়ার অগণতান্ত্রিক, সংবিধান ধ্বংসকারী পদক্ষেপ।
এক দেশ, এক ভোটের মাধ্যমে কার্যত স্বৈরাচারী শাসনের ব্লু প্রিন্ট অনেক আগেই তৈরি ছিল। বাধ সাধল গত লোকসভা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার স্বপ্নের সলিল সমাধি। ৪০০ পারের স্বপ্ন পগারপার হতে গিয়েও কোনওক্রমে ঠেকল ২৪০-এ।
চন্দ্রবাবু নাইডু এবং নীতীশ কুমার নামক দুটি ক্রাচে ভর করে উঠে দাঁড়িয়ে ফের শুরু হল দখলনামার দামামা বাজানো। যার অঙ্গ হিসেবে এসআইআর-য়ের হঠকারী ভাইরাস চাপিয়ে দিয়ে দেশবাসীকে গিনিপিগের মতো ‘ফেক-হিন্দুত্ব’র পরীক্ষাগারে নিক্ষেপ করতে চাইছে সংবিধান হত্যাকারী দিল্লির দানবরা। এমতাবস্থায় পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে বলে যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন তবে নিমেষে ফ্যাসিবাদের লেলিহান অগ্নিশিখায় জ্বলে পুড়ে ছাই যেতে হবে।
জাতির জনক গান্ধীজি স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণের উৎপাত-উপদ্রবহীন এক সুন্দর উদার আধুনিকমনস্ক সমাজের। সংখ্যালঘু এবং প্রান্তিক পিছিয়ে পড়া মানুষকে যে ভারতে আগলে রাখা হবে পরম মায়ামমতা, স্নেহযত্নে। গান্ধীজির ভাষায় সেই রামরাজ্যের স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনাশ করেছিল আরএসএস-য়ের ঘাতক তথা আজকের ভারতে রাবণরাজ কায়েম করা বিজেপির পূর্বপুরুষ নাথুরাম গডসে। এখনও যে খুনি নাথুরামকে পুজো চড়ায় এই নরাধমরা। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে শয়তান বলে পোস্ট করতে হাত কাঁপে না বকতপস্বী তথা এ রাজ্যের বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের। সেই পোস্টের সমর্থনে হিন্দুত্বের মুখোশধারীদের কুৎসিত আস্ফালন প্রমাণ করে ব্রিটিশের পদলেহনকারী মুচলেকা-ম্যানদের মতো ‘পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা’দের হাতে কার্যত আইসিইউ-তে পৌঁছে গিয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্র।
আরও পড়ুন-আতঙ্কিত হবেন না, দল আছে : প্রসূন
গান্ধীজির অধরা স্বপ্ন সাকার করতে স্বাধীন ভারতে অগ্রণী ভূমিকা নেন দেশের সংবিধানের জনক বি আর আম্বেদকর। বস্তুত, তাঁর তুলে ধরা সংবিধান সেই বিশাল অংশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছিল যাঁরা সভ্যতার অতিরঞ্জনে অবহেলিত, নিপীড়িত, সংখ্যালঘু। এই সংখ্যালঘু কিন্তু শুধু ধর্মীয় ভিত্তিতে নয়, আর্থিক-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা নমঃশূদ্র-সহ দেশের বৃহত্তর অংশ।
বস্তুত, জাতির জনক এবং সংবিধানের জনক সেই ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন যা যুগপুরুষদের বহু আকাঙ্ক্ষিত।
জীবে প্রেম করে যে জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। বীর তপস্বী বিবেকানন্দ তাঁর পরম আরাধ্য গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের দর্শনের মজবুত ভিতের ওপর এই সারসত্য তুলে ধরেছেন।
তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে মুচি মেথরকে বুকে টেনে নেওয়ার কথাও বলেছেন স্বামীজি। রবিঠাকুর, নজরুল থেকে শরৎচন্দ্র, লালন— সবার লেখা-গানেই উঠে এসেছে সেই পিছিয়ে পড়া, নিপীড়িত প্রান্তিক মানুষের সহজিয়া যাপন ও তাঁদের দুর্দশার নির্মম চিত্র। হজরত মহম্মদ থেকে চৈতন্যদেব যে সমানাধিকার, সাম্যের বাণীর ধারকবাহক।
বস্তুত, ভারতবর্ষে যুগ যুগ ধরে লাঞ্চিত বঞ্চিত শ্রেণির শত্রু কিন্তু কোনও ভিনদেশি নয়। ঘরের শত্রুর হাতে দিনের পর দিন শোষিত হয়েছেন তাঁরা।
মনুসংহিতার নামে যে জাতিদ্বেষ যুগ যুগ ধরে চলেছে তাতে চাপা পড়ে গিয়েছে সমাজের এই অগণিত মানুষের স্বাধিকার, আত্মমর্যাদা। তাঁদের মানুষ বলেই গণ্য করত না তথাকথিত উচ্চবর্ণের মসিহারা। ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহার লাঠিয়ালদের আধিপত্যে কুঁকড়ে থাকতে হত এই নিম্নবিত্ত মানুষকে। সতীদাহের মতো নারকীয় প্রথাকে খুল্লামখুল্লা সমর্থন করে এসেছে হিন্দুদের প্রতিভূর ভেক ধরা এই নরপিশাচরা। রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগররা যখন ধর্মীয় ঢক্কানিনাদের স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তখন কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন উইলিয়াম বেন্টিঙ্করা। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও কিংবা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির মতো উদারচেতা বিদেশি এদেশের সমাজ সংস্কারের শরিক হয়েছেন। এমতাবস্থাতেও দেশের মানুষের ওপর বিষ ছড়ানোর রাজনীতিতে লাগাম পড়েনি।
অথচ এই মুহূর্তে দিল্লির দখলদার বিজেপি-আরএসএস সেই সংবিধানের সম বিধানে চূড়ান্ত অসাম্য ডেকে এনেছে। এদের এক এবং একমাত্র অ্যাজেন্ডা দেশের বড় অংশের মানুষকে তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে দেশ তুলে দেওয়া। জল-স্থল-জমি-জঙ্গল সবের দখল চাই এই হাঙরদের। ফ্যাসিবাদ ও মাফিয়াদের হাতে লুণ্ঠিত দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র তথা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। হিন্দু, মুসলমান নির্বিশেষে এদের টার্গেটে সেইসব আত্মসম্মান সম্পন্ন মানুষ যাঁরা গোবলয়ের গোয়েবলসদের কাছে নিজেদের ধরা দেয়নি। মতুয়া থেকে রাজবংশী, পিছিয়ে পড়া জনজাতির সার্বিক অংশকে অজগরের মতো গিলে নিতে এনআরসি, সিএএ-য়ের মতো কালা কানুনকে ঢাল করেছে মানবতার শত্রু বিজেপি-আরএসএস।

