মোবাইলের স্ক্রিনে শিশুর ভবিষ্যৎ

নোমোফোবিয়া, এ এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থা, যখন মানুষ ফোন ছাড়া অস্থির ও উদ্বিগ্নতা অনুভব করে। প্রযুক্তির যুগে এই অদৃশ্য আসক্তি নীরবে বদলে দিচ্ছে আমাদের সামাজিক ও মানসিক ভবিষ্যতের মানচিত্র। লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

আচ্ছা আপনিও কি আমার মতো একই দুশ্চিন্তায় ভুগছেন! দেখুন তো, কী মুশকিলটাই না হয়েছে আজকাল— আমার বাচ্চা দুটোও একেবারে মোবাইলের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। কোনও দিকে হুঁশ নেই, আজ ওদের অ্যানুয়াল স্পোর্টস, জোর করে ফ্রগ রেসে নাম দিয়েছিলাম, ওরা তো কোনওভাবেই রাজি ছিল না। তবুও যাইহোক কোনওরকমে কোয়ালিফাই করল, তা আজকে ফাইনাল, একটু তো নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে, না মোবাইলে মাথা গুঁজে গেম খেলছে! আমরা স্বামী-স্ত্রী পড়েছি মহা ঝামেলায়; ওদের ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই রাতের ঘুম উড়ে যায়। আপনারা কী বলছেন, পৃথিবীর প্রায় সব অভিভাবকই আজ চিন্তিত তাঁদের সন্তানদের ডিজিটাল স্ক্রিনের আসক্তির কথা ভেবে।

আরও পড়ুন-পিঠেপুলি উৎসবে গানে মাতালেন পুলিশকর্তারা

একটা সময় ছিল, যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই, মিঠে রোদ গায়ে মেখে পাড়ার মাঠে ছুটত বাচ্চারা— কারও হাতে বল, কারও হাতে ব্যাট, তো কারও পায়ে ফুটবল, কারও হাতে স্কিপিং, আবার কারও চোখে ঘুড়ির লাটাই। আজ সেই একই বিকেল যেন বন্দি হয়ে আছে আয়তাকার এক রঙিন স্ক্রিনের ভিতর। মাঠের বদলে তারা এখন মোবাইলে খেলছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়, বন্ধুদের সঙ্গে হাসির বদলে ইমোজিতে পাঠাচ্ছে আনন্দের প্রতীক— সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, মনখারাপ, প্রেম, বিরহ— সবকিছুই আজকাল যেন ওই ইমোজি আর ইমোটিকনের সরল সংস্করণ। আধুনিকতার এই মোহে শৈশব যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে তার স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস, কল্পনাশক্তি আর প্রাণের ছন্দ। প্রশ্ন উঠছে— এই ডিজিটাল বন্দিত্ব কি তাদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করছে, নাকি নিঃশব্দে কেড়ে নিচ্ছে এই প্রজন্মের শৈশব?
তখনকার দিনে ভোরের আজান, কিংবা পাখির ডাক শুনে মানুষজনের ঘুম ভাঙত; আর এখন মোবাইলের অ্যালার্ম কিংবা নোটিফিকেশনের টুংটাং শব্দ! সবসময় মানুষ যেন ওই যন্ত্র টির ছোট্ট ‘পিং’ আওয়াজ শুনলেই সচেতন হয়ে উঠছে; তাঁর মন ও মনন যেন বশীভূত ওই স্মার্টফোন নামক যন্ত্রটির ইশারায়! কোনও অংশে কম যায় না বাচ্চারাও— তাদের শৈশবের উঠোনেও স্ক্রিনের ছায়া।

আরও পড়ুন-উন্নয়নমূলক প্রকল্প বার্ষিক রিপোর্ট কার্ড দেখবেন মুখ্যমন্ত্রী

নোমোফোবিয়া কী
আজকের শিশুরা জন্ম নিচ্ছে এক ডিজিটাল পৃথিবীতে। লাট্টু, কাঞ্চি কিংবা গুলতির জায়গা নিয়েছে মোবাইলের স্ক্রিন। পাড়ায় পাড়ায় এখন খেলাধুলোর কলরবের জায়গায় সেখানে ভেসে আসে ভিডিও গেমের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। আজকাল আর পুতুল-বিয়ে হয় না— হয় স্যোশাল মিডিয়ায় চিটচ্যাট। দুঃখের বিষয়, অভিভাবকেরা নিজেরাই অনেক সময় ব্যস্ত জীবনের স্বস্তির জন্য অজান্তেই সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিনোদনের নামে এই যন্ত্র— যা শেষমেশ হয়ে উঠছে শিশুদের আসক্তি, মানসিক নির্ভরতার কারণ।
শিশুরা এখন টিফিনের ফাঁকে, পড়ার আগে-পরে, খাওয়ার সময় ও এমনকী বাথরুমেও মোবাইলের পর্দায় ডুবে থাকে। ইউটিউবের রঙিন ভিডিও, অনলাইন গেম, সোশ্যাল মিডিয়ার অজস্র উদ্দীপনা তাদের মস্তিষ্কে একধরনের তাৎক্ষণিক আনন্দ সৃষ্টি করে, যা ধীরে ধীরে পরিণত হয় আসক্তিতে। এর ফলে মনোযোগে ভাঙন আসে, সৃজনশীলতা ও সামাজিক যোগাযোগ কমে যায়, এমনকী ঘুম ও আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেয়।
মোবাইল আজ শিশুদের বন্ধু হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেই বন্ধুত্বের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক নীরব বিপদ— মনোযোগহীন প্রজন্মের সম্ভাবনা। ছোট-বড় সকলেই যেন আজ মোবাইল ছাড়া এক সেকেন্ডও চলতে অক্ষম। রীতিমতো তারা মোবাইল ছাড়া অবসাদে ভুগতে শুরু করে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতিকে ‘নোমোফোবিয়া’ বলা হয়েছে। নোমোফোবিয়া অর্থাৎ ‘নো মোবাইল ফোন ফোবিয়া’। তাই অবিলম্বে প্রয়োজন সচেতনতা ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, যেন শিশুরা স্ক্রিন নয়, বাস্তব পৃথিবীর আলোয় বড় হতে পারে।
আজকের দিনে আমাদের এই মোবাইল নির্ভরতারই নতুন নাম নোমোফোবিয়া— অর্থাৎ মোবাইল ফোন ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে না পারার অদৃশ্য আতঙ্ক। ২০০৮ সালে ব্রিটেনের এক গবেষণায় শব্দটির জন্ম। সমীক্ষায় দেখা গেছে, অর্ধেকেরও বেশি মানুষ ফোন হারিয়ে গেলে বা নেটওয়ার্ক না পেলে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। সেই গবেষণার এত বছর পর, আজ এ-ভয় আরও গভীর, আরও সূক্ষ্ম, আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, বিশেষ করে শিশুদের কথা ভেবে!
এর প্রভাব
কবে যে অভ্যাসের আড়ালে আসক্তি তৈরি হয়ে গেছে তার টের পাওয়ায় যায়নি। সুবিধার প্রতীক থেকে মোবাইল এখন হয়ে উঠেছে জীবনের নিয়ন্ত্রক। কেউ ব্যাটারি শেষ হলে অস্থির হয়ে ওঠেন, কেউ বারবার ফোন চেক করেন, কেউ-বা অকারণে নোটিফিকেশন দেখেন। এই আচরণ কেবল অভ্যাস নয়, মানসিক নির্ভরতার লক্ষণ। আমরা তথ্যের স্রোতে এতটাই অভ্যস্ত যে এক মুহূর্ত মোবাইল কাছে না থাকলে মনে হয়, পৃথিবীটা যেন থেমে গেছে। ফোন যেন ক্রমশ আমাদের অন্তর্গত স্নায়ুতন্ত্রেরই একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
নোমোফোবিয়ার প্রভাব শুধু যে মনস্তাত্ত্বিক তা নয়, সামাজিকও। অনবরত মোবাইল ঘাঁটলে স্ক্রিনের আলো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়, মনোযোগ দুর্বল হয় নোটিফিকেশনের টানে। সরাসরি আলাপ কমে যায়, সম্পর্কগুলোতে জমে যায় ডিজিটাল ছত্রাক! মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটি এক ধরনের আচরণগত উদ্বেগ, কিন্তু সাহিত্যের দৃষ্টিতে এটি আধুনিক নিঃসঙ্গতার প্রতীক। আমরা যত মোবাইলে মগ্ন হচ্ছি, ততই নিজেদের ভেতরের সত্তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।

আরও পড়ুন-ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত কর্মীদের বিশ্রাম নেই : মানস

আসক্তি মুক্তি
তবে এই আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব নয়, জরুরি কেবল সচেতনতা আর সংযম। দৈনিক অন্তত এক ঘণ্টা রাখুন ‘নো ফোন টাইম’— নিজের সঙ্গে থাকার সময়। ঘুমানোর আগে মোবাইল বন্ধ করে বইয়ের আলোয় ডুব দিন। বন্ধুদের সঙ্গে মেসেজ না করে দেখা করুন সরাসরি। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বা ডিজিটাল ডিটক্স প্রয়োগ করতে পারেন। প্রযুক্তি আমাদের দাসত্বে ফেলছে না— আমরাই তাকে সে অধিকার দিচ্ছি।
অল্প অল্প করে আত্মনিয়ন্ত্রণই পারে এই শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তি দিতে।
নোমোফোবিয়া কোনও রোগের নাম নয়, এটি সময়ের প্রতিফলন। মানুষ প্রযুক্তি তৈরি করেছে নিজের জীবন সহজ করতে, কিন্তু সেই প্রযুক্তিই যখন মন ও মস্তিষ্ককে বন্দি করে ফেলে, তখন থামতে হয়— একটু নিঃশ্বাস নিতে হয়। ফোন আমাদের হাতের যন্ত্র, হৃদয়ের মালিক নয়। এই সত্যটা মনে রাখলেই আমরা আবার প্রকৃতির, সম্পর্কের, জীবনের সঙ্গে একাত্ম হতে পারি। কারণ, জীবনের আলো কখনও স্ক্রিনে নয়— থাকে মানুষের চোখে, মনে, ও নীরবতায়। তাই সচেতন অভিভাবক হিসেবে আমাদের উচিত বাচ্চাদের হাতে মোবাইলের পরিবর্তে এমন কিছু তুলে দেওয়া যা তাদের পূর্ণ মানসিক, শারীরিক ও বৌদ্ধিক বিকাশের সহায়ক হবে।

Latest article