ভাল খাবার দেখলেই কি মনের ভিতর সুড়সুড়ি দেয়? শুরুতে মনে হয় আজ খুব অল্প খাব বিরিয়ানিটা কিন্তু খাওয়ার সময় সেইসব ভাবনা কোথায় যেন চলে যায়। দু প্লেট বিরিয়ানি, আট-দশ পিস মাংস শেষ করে ফেলেন! তারপরেই মনে এক ভীষণ অপরাধ বোধ শুরু হয় কেন খেলাম! ব্যাস তখন মনে হয় সবটা বমি করে বের করলেই বুঝি সেই অপরাধবোধটা কমবে, ওজনটা কমাতেই হবে। এটাই কি নিত্যদিনের ঘটনা? এমনটা হলে বুঝতে হবে ঘোরতর বিপদ। তখন একেবারে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ হতে পারে আপনি ‘বুলিমিয়া’য় আক্রান্ত।
আরও পড়ুন-ভেস্তে গেল বিজেপির সংসদ অচল করার চক্রান্ত, এসআইআর আলোচনার দাবি আদায় করেই ছাড়ল তৃণমূল
এই মুহূর্তের বলিউডের চর্চিত অভিনেত্রী ফতিমা সানা শেখ। কয়েক বছর আগেই জানা গিয়েছিল তিনি নাকি মৃগী রোগে আক্রান্ত। ‘দঙ্গল’ ছবি-খ্যাত ফতিমা এখন আবার চর্চায় কারণ সম্প্রতি মুক্তি পাচ্ছে তাঁর নতুন ছবি ‘গুস্তাক ইশক’। সম্প্রতি জানা গেছে তাঁর নাকি রয়েছে বিরল একটি রোগ যার নাম ‘বুলিমিয়া’। ‘দঙ্গল’ ছবিটা করতে গিয়ে ফতিমাকে হাই ক্যালরি ডায়েট নিতে হত চরিত্রেরই প্রয়োজনে। ছবিটা শেষ হবার পর ওই অভ্যেসটা তিনি আর ছাড়তে পারেননি! অতিরিক্ত খেতেন এবং খাওয়ার পর ভীষণ রকম অপরাধবোধে ভুগতেন। আবার সেটা লুকনোর চেষ্টা করতেন। নিজেকে দোষারোপ করতেন। অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন মানসিকভাবে। তখন ফতিমা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় এখন তিনি সমস্যা-মুক্ত।
বুলিমিয়া কী
বুলিমিয়া নার্ভোসা, যা বুলিমিয়া নামেও পরিচিত, গ্রিক শব্দ ‘boulimia’ থেকে এসেছে। এটা একধরনের ইটিং ডিজ়অর্ডার। এই ইটিং ডিজ়অর্ডার মূলত দু’ধরনের হয়— অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা আর বুলিমিয়া নার্ভোসা। প্রিন্সেস অফ ওয়েলস ডায়ানারও নাকি এই বুলিমিয়া রোগটি ছিল। আগে এই রোগ পশ্চিমি দেশেই দেখা যেত বেশি।
আরও পড়ুন-৩ দিনে মৃত্যু ২ শিক্ষক সহ ৩ জনের
এখন আমাদের দেশেও ভালই মিলছে বুলিমিয়া রোগী। বুলিমিয়ার রোগী একটা নির্দিষ্ট সময়ে অনেকটা খাবার খেয়ে ফেলে। একসঙ্গে বড় দু-তিন বড় প্যাকেট বিস্কিট বা বড় দু-তিনটে আইসক্রিমের বার বা বড় এক বা দু পাউন্ডের একটা কেক, বড় চকোলেটের দু তিনটে প্যাকেট খেয়ে ফেলে। এখানেই শেষ নয় সেই খাবারটা বেশি খেয়ে ফেলার কারণেই আবার অপরাধবোধে ভোগে এবং বিভিন্ন উপায়ে সেই অতিরিক্ত খাবারটা শরীর থেকে বের করে ফেলার প্রবল চেষ্টা করে। এই চেষ্টা করতে গিয়ে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করার প্রচেষ্টা, কখনও ল্যাক্সেটিভ জাতীয় ওষুধ খেয়ে ফেলে যাতে মলের সঙ্গে বাড়তি খাবার বেরিয়ে যায় শরীর থেকে। আবার কখনও ডায়ুরেটিক ওষুধ খেয়ে ইউরিনের মাধ্যমে খাবারটা বের করে দেবার চেষ্টা করে। কখনও অনেকটা খাবার একদিনে খেয়ে নেবার পর দু’দিন খাওয়া বন্ধ করে দেয়। একে বলা হয়, ‘কমপেনসেটরি বিহেভিয়ার’। এমন তো, অনেকেই করেন! তাহলেও বুলিমিয়ার সঙ্গে তফাতটা বুঝতে হবে। কেউ যদি মাসে একবার অনেকটা খেয়ে নানা ভাবে সেটার কমপেনসেট করার চেষ্টা করেন, তাকে কিন্তু বুলিমিয়া বলা চলে না। একটানা সপ্তাহে দু-তিনবার করে এমন ঘটতে থাকলে এবং তিন-চারমাস বিষয়টা চললে সেটাই বুলিমিয়া। এই বুলিমিয়া ধীরে ধীরে কম থেকে বেশির দিকে যায়। অর্থাৎ মডারেট থেকে সিভিয়র। সিভিয়র হলে দিনে দু-তিনবার এমনটা ঘটতেই পারে।
উপসর্গ
পুরুষের চেয়ে কমবয়সি মেয়েদের মধ্যে এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি দেখা দেয়। বুলিমিয়া অল্পবয়সি শিশুদের মধ্যে খুব দেখা যায়।
বমি হয় বারংবার এর ফলে পাকস্থলীতে অ্যাসিড ক্ষরণ হয় এর ফলে দাঁতের এনামেলের তীব্র ক্ষয় হয়, দাঁত নষ্ট হয়ে যায়।
ক্রনিক ডিহাইড্রেশন হয়, শরীরে ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স হতে শুরু করে।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল জটিলতা শুরু হয় যেমন অ্যাসিড রিফ্লাক্স, কোষ্ঠকাঠিন্য, স্টমাক পেন ইত্যাদি।
আত্মবিশ্বাসের অভাববোধ হয়। সারাক্ষণ নিজের ওজন এবং আকৃতি নিয়ে মানসিক ব্যস্ততা থাকে।
বুলিমিয়ার জন্য, যেমন অবসাদ আসে আবার তেমনই মানসিক অবসাদ থেকে বুলিমিয়া হতে পারে। ফলে কেউ কেউ নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন আবার কেউ খুব ধার-দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন।
মেজাজের পরিবর্তন হয় ঘন ঘন। বিষণ্ণতা আসে, উদ্বেগ, ক্লান্তি তৈরি হয়। কখনও কখনও বুলিমিয়ার রোগী নিজেরও ক্ষতি করে বসেন। কারণ এঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দেয়।
এঁরা ইমপালসিভ আচরণ করে ফেলেন। রোগ বাড়তে থাকলে রোগের উপসর্গ বাড়তে থাকে। স্বাভাবিক কাজকর্ম রোগী করতে পারেন না।
অ্যানোরেক্সিয়া ও
বুলিমিয়ার তফাত
অ্যানোরেক্সিয়া আক্রান্তের সহজ সংজ্ঞা হল ওজন কমানোর বাতিক। এটাও ইটিং-ডিজর্ডার। খাওয়াদাওয়া সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া। নিজের চেহারা ও ওজন নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা। এই মানসিক সমস্যায় কিছু খেলেই ব্যক্তি ভাবেন যে ওজন বাড়বে। সেটাই একটা সময় আতঙ্কে পরিণত হয়। মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ বাড়তে থাকে। অ্যানোরেক্সিয়ায় ওজন ভয়ঙ্কর কমে যায়। তাই এই রোগীদের দেখে রোগ সম্বন্ধে অনেকটা আন্দাজ করা যায়। কিন্তু বুলিমিয়া দেখে চট করে বোঝা যায় না। ফলে বুলিমিয়া চট করে ডায়গনোসিস হয় না।
চিকিৎসা
বুলিমিয়ার চিকিৎসায় ওষুধপত্রের পাশাপাশি কাউন্সিলিং খুব জরুরি। রোগের মাত্রা অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। কারণ বুলিমিয়ার লক্ষণ বাড়তে থাকলে শারীরিক নানা অসুবিধেও শুরু হয়। কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি— অর্থাৎ রোগীর চিন্তাভাবনার পরিবর্তন করা। কথা বলে জেনে নিয়ে সেইমতো চিকিৎসা করা হয়। তবে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি কার্যকর হতে সময় লাগে। তাই রোগের মাত্রা দ্রুত কমানোর জন্য অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট জাতীয় ওষুধ দিলে দ্রুত কাজ হয়। শুধু ডোজ়টা একটু বেশি দেওয়ার দরকার। সাধারণত ওষুধের প্রয়োজন তখনই হয়, যখন সাধারণ থেরাপি কাজ করে না।

