বাবা এবং মেয়ে। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে দেখা যায় গভীর স্নেহ, সুরক্ষা, সম্মান এবং আদর্শের শক্তিশালী মিশ্রণ। শৈশবে মেয়ে হাঁটতে শেখে বাবার হাত ধরে। বাবার চোখ দিয়ে দেখে পৃথিবীকে। সময় গড়িয়ে গেলে বদলে যায় পরিস্থিতি। তখন মেয়ের হাত ধরে হাঁটেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা। নির্ভরতা পান। মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেন বিশ্বচরাচর।
এ এক চিরন্তন ছবি। মর্মস্পর্শী এই বিষয়কে সামনে রেখেই নির্মিত হয়েছে অর্ণব মিদ্যা পরিচালিত ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ (hati hati pa pa)। ২৮ নভেম্বর, কলকাতার সাউথ সিটির আইনক্স-এ হয়েছে প্রিমিয়ার। ওইদিনই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে।
হাতেগোনা চরিত্রের উপস্থিতি। মূল চরিত্র দুটি। বাবা এবং মেয়ে। বাবার ভূমিকায় চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। চরিত্রের নাম দীপক চক্রবর্তী। মেয়ের ভূমিকায় রুক্মিণী মৈত্র। চরিত্রের নাম মধুরা। ডাকনাম মৌ।
পরিচ্ছন্ন বাংলা ছবি। বোনা হয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের আটপৌরে দিনযাপনের গল্প। বাবাকে ঘিরেই আবর্তিত মা-হারা মৌয়ের জীবন। আপাতভাবে অবুঝ, অবাধ্য মনে হয় বাবাকে। তিনি চলেন নিজের মর্জিতে। আপন খেয়ালে। কখন কী করেন, বোঝা মুশকিল। সামান্য ঘটনায় মেজাজ হারান। রেগে যান। জড়িয়ে পড়েন বিবাদে।
তাঁকে নিয়ে নাজেহাল মৌ। একদিকে অফিস, অন্যদিকে অবুঝ, অবাধ্য বাবা-দু’দিক সামলাতে হিমশিম। বাবার ছেলেমানুষি, অদ্ভুত আচরণে মৌ মাঝেমধ্যেই হতাশ হন। কী করবেন, ভেবে পান না। তুমুল ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান হয় বাবা-মেয়ের। রাগ কমলে আবার আলো ফোটে। হাসি ছোটে। চলতে থাকে এইভাবেই।
এরমধ্যে মৌ সম্পর্কে জড়িয়েছেন প্রবাসী যুবক পলাশের সঙ্গে। তাঁর সামনে মৌ উজাড় করেন অসহায়তার কথা। পরিস্থিতি বোঝেন পলাশ। সম্পর্কের নতুন নাম দিতে চান। বিয়ের কথা তোলেন। পিছিয়ে আসেন মৌ। বাবাকে একা ফেলে কোথাও যেতে চান না। দায়িত্বশীল এবং কর্তব্যনিষ্ঠ তিনি। কড়া অনুশাসনে বাবাকে আগলে রেখেছেন।
আরও পড়ুন-পরীক্ষা ফি নিয়ে গদ্দারের মিথ্যাচার, সিবিএসই-র নথি দেখিয়ে যোগ্য জবাব শিক্ষামন্ত্রীর
পরিস্থিতি অনুধাবন করেন বাবা। উপলব্ধি করেন, তিনিই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন মৌয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের পথে। আত্ম-ধিক্কারে বিদ্ধ করেন নিজেকে। বুদ্ধি খাটিয়ে বের করেন বিশেষ উপায়। একাকীত্ব দূর করার জন্য বৃদ্ধ বয়সে নতুন সম্পর্কে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। সেটা জানতে পারেন মৌ। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। যে-ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে মায়ের স্মৃতি, সেই ঘরে কীভাবে অন্য নারীকে স্থান দেবেন বাবা, ভেবে পান না। বাবার সম্পর্কে বদলে যায় ধারণা। রচিত হয় দূরত্ব। আসলে বাবার উদ্দেশ্য বুঝতেই পারেন না মেয়ে। গল্পের মূল নির্যাস এই। বাকিটা জানার জন্য রয়েছে প্রেক্ষাগৃহে।
অনবদ্য অভিনয় করেছেন চিরঞ্জিত চক্রবর্তী। বহুদিন পর একটি মনে রাখার মতো চরিত্রে তিনি। সময় বিশেষে বদলেছে তাঁর অভিনয়ের রং। কিছু সংলাপে পুরোনো গন্ধ। কখনও হাসিয়েছেন, কখনও কাঁদিয়েছেন। মেধা ও মননের সংযোগ ঘটিয়ে চরিত্রটিকে করে তুলেছেন বিশ্বাসযোগ্য।
এই ছবিতেই (hati hati pa pa) সম্ভবত নিজের সেরা কাজ এঁকে গেলেন রুক্মিণী মৈত্র। সহজাত, সাবলীল অভিনয় কাকে বলে, দেখিয়ে দিলেন। আগাগোড়া অত্যন্ত পরিশীলিত। উচ্চৈঃস্বরে ঝগড়ার দৃশ্যেও মাত্রা ছাড়াননি। আশ্রয় নেননি নাটকীয়তার। তীব্র দোলাচল নিখুঁত দক্ষতায় ফুটিয়েছেন। ভাঙনের দৃশ্যেও অসাধারণ। সবমিলিয়ে তাঁর অভিনয়-গভীরতা মুগ্ধ করেছে। বাবা-মেয়ের বন্ডিংও ফাটাফাটি।
পলাশের চরিত্রে মার্জিত অভিনয় বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাবা-মেয়ের টানাপড়েনের মাঝে যতটা সুযোগ পেয়েছেন, কাজে লাগিয়েছেন। মুখের ভাষার পাশাপাশি সহজেই পড়ে নেওয়া যায় তাঁর চোখের ভাষা।
তুলিকা বসুকে দেখা গেছে সুতপা মিস-এর চরিত্রে। সূক্ষ্ম কৌশলে চরিত্রের অনুভূতি ও উদ্দেশ্যকে তিনি প্রকাশ করেছেন দারুণভাবে। কিছু কিছু সময় ন্যূনতম সংলাপ বা অভিব্যক্তির মাধ্যমেও মেলে ধরেছেন মনের ভাব। ডাঃ অনুপম ঘোষালের চরিত্রে সন্দীপ ভট্টাচার্য রেখাপাত করেছেন। এছাড়াও আছেন ঈশিকা দে, স্বাগতা বসু, সায়ন ঘোষ, মোনালিসা চট্টোপাধ্যায়। বনলতা সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঞ্জনা বসু।
সেলুলয়েড ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত ছবিটির প্রযোজক অরুণাভ মিদ্যা। চিত্রগ্রহণে (hati hati pa pa) ইন্দ্রনাথ মারিক, সম্পাদনায় প্রণয় দাশগুপ্ত, শব্দ পরিকল্পনায় অমিতকুমার দত্ত, চিত্রনাট্যে প্রিয়াঙ্কা পোদ্দার, শিল্প নির্দেশনায় আনন্দ আঢ্য যথাযথ। গানগুলো চমৎকার। সুরের রঙে রাঙিয়েছেন রণজয় ভট্টাচার্য, অনির্বাণ অজয় দাস।
যে-সময় বহু পরিচালক হিন্দি এবং দক্ষিণ ভারতের মশালা ছবির দ্বারা তুমুল প্রভাবিত, সেই সময় দাঁড়িয়ে একটি নির্ভেজাল বাংলা ছবি উপহার দিলেন অর্ণব মিদ্যা। সাধুবাদ তাঁর প্রাপ্য। এই পরিচালক চেনালেন নিজের জাত। বুঝিয়ে দিলেন, তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। আধুনিক মনস্ক, তবে ভোলেননি শেকড়। সহজ-সরল গল্পকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন মুনশিয়ানার সঙ্গে। মাঝেমধ্যেই বাঁকবদল ঘটেছে গল্পের। তবে কোথাও টাল খায়নি। এতটাই নির্মেদ, টানটান। দেওয়া হয়েছে বিশেষ বার্তা। একা বাঁচা যায় না। জীবনে বন্ধু লাগে।
সবমিলিয়ে ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ দেখার মতো একটি ছবি। এই ছবির জন্য আগামী দিনে অকল্পনীয় সাফল্য অপেক্ষা করছে।

