অমিত শাহের চাল দাবার বোড়ে এখন জ্ঞানেশ কুমার

যে-সব রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেখানেই কেন ভোটের আগে এসআইআর হবে? অসম, ত্রিপুরায় বাংলাদেশের সীমান্ত নেই? সেখানে কেন এসআইআর হবে না? নির্বাচন কমিশনের এমন ভূমিকার পিছনে বিজেপির চালটা কী, বুঝিয়ে দিচ্ছেন পার্থসারথি গুহ

Must read

জাতীয় নির্বাচন কমিশন কি নিদ্রা গিয়েছে? যে সে নিদ্রা নয়। এ যেন কুম্ভকর্ণের ঘুম। কিংবা রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো কুড়ি বছরের নিদ্রাযাপন।
কখনও আবার জাতীয় নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে (gyanesh kumar) আরও এক মহাকাব্যের চরিত্র অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র বলে ভ্রম হচ্ছে। এসআইআর-আতঙ্কে একের পর এক মৃত্যুমিছিল দেখছে এই রাজ্য। মো-শা’র গুজরাত বাম শাসনের কেরল থেকে দেশের নানা প্রান্তে অসম্ভব কাজের চাপ সহ্য করতে না পেরে অসংখ্য বিএলও মারা গিয়েছেন নয় আত্মহত্যা করেছেন। এ রাজ্যের বহু মানুষ এসআইআরের হঠকারী পদক্ষেপে আতঙ্কে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। মহিলা থেকে বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারংবার প্রতিবাদ করছেন। চিঠিও লিখেছেন জাতীয় নির্বাচন কমিশনারকে। তাও নির্বিকার জাতীয় নির্বাচন কমিশন। মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পেরে পাশ কাটানো জবাব দিচ্ছেন তাঁরা। কখনও আবার জ্ঞানেশবাবুর ব্যাটন ধরতে দেখা যাচ্ছে কিরণ রিজিজু বা বিজেপির অন্য নেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের। আর বাংলার মাটিতে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদাররা ক্ষণে ক্ষণে সাধারণ মানুষকে সীমান্ত পার করানোর ভয় দেখাচ্ছেন, আতঙ্কের কালগর্ভে ঠেলে দিচ্ছেন। তাও জ্ঞানেশ কুমারের নিদ্রাভঙ্গ হচ্ছে না। নতুবা বুঝতে হবে জেগে ঘুমোচ্ছেন তিনি। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বকলমে চলে গিয়েছে বিজেপির হাতে। মুখে মারিতং জগতং-য়ের মতো চলছে স্বশাসিত সংস্থার ভুজুংভাজুং।

সম্প্রতি দেশের চিফ ইলেকশন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারের  (gyanesh kumar) সঙ্গে মিটিং শেষে তৃণমূল প্রতিনিধি দল বেরিয়ে আসার পর সাংসদ মহুয়া মৈত্র বিস্ময় প্রকাশ করেন, যে রাজ্যে এত বিএলও-দের মৃত্যু হয়েছে অতিরিক্ত কাজের চাপে তা সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন জ্ঞানেশ কুমার! এরপর সত্যি কথা বলতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এতজন বিএলও এই রাজ্যে মারা গিয়েছেন,আত্মহত্যা করেছেন, সুইসাইড নোটে উল্লেখ করে গিয়েছেন যে অতিরিক্ত কাজের চাপে তাঁরা বিপন্ন। তাও জ্ঞানেশবাবুর মতো দায়িত্বসম্পন্ন আইএএস সেই ব্যাপারে অবহিত নন। পাশাপাশি এই প্রশ্ন উঠতেও বাধ্য, তাহলে জ্ঞানেশ কুমার কি জ্ঞানপাপী? মানে জেনেও না জানার ভান করছেন! আমরা সাধারণ মানুষ কিন্তু একে অপরকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করি। মানবিকতার অন্যতম শর্ত হল বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের দফারফা হয়ে যাচ্ছে ইসিআইয়ের এহেন ভূমিকায়। বস্তুত, তাঁদের নিরপেক্ষতার কঙ্কাল ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তাও আমরা অপেক্ষায় বিশ্বাসী। সহিষ্ণুতার পুজারী গান্ধীজির দেশের মানুষ বলে গর্ববোধ করি। সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরাচ্ছে গডসের ঘাতক মানসিকতা। নাথুরাম গডসে শুধু জাতির জনক গান্ধীজিকে হত্যা করেনি, ভারতীয় গণতন্ত্রের সহিষ্ণুতার ভিত ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

আরও পড়ুন-‘কমপ্লেক্স’! হরিয়ানার পুনমের হাতে বলি পরিবারের চার শিশু

দিল্লিতে বিজেপি সরকার আসার পর থেকে সেই গডসে ভাইরাস ছেয়ে গিয়েছে সমগ্র দেশ জুড়ে। যার অন্যতম শিকার জাতীয় নির্বাচন কমিশন। এই জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বাংলার আন্তরিক যোগ বহুকালের। স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় নির্বাচন কমিশনার বঙ্গসন্তান সুকুমার সেন কিন্তু পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মতো দাপুটে প্রধানমন্ত্রীকেও কমিশনের কাজে নাক গলাতে দেননি। পক্ষান্তরে এও সত্য, পণ্ডিত নেহরুর মতো সহনশীল, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রীও জোর খাটান নি নির্বাচন কমিশনের ওপর। ভোটাধিকার সংশোধন প্রক্রিয়া চলেছে কপিবুক মেনে। পরবর্তী দীর্ঘ সময় জুড়েও নির্বাচন কমিশনের সদর্থক ভূমিকা ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে তামাম দেশবাসী। নব্বইয়ের দশকে আরও এক দুঁদে আইএএস মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষণ নিজের দক্ষতার ছাপ রেখে গিয়েছেন ভারতীয় গণতন্ত্রের পরতে পরতে। সংবিধান যেমন ধর্ম ও আর্থিক মাপকাঠিতে তামাম সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য দায়বদ্ধ ঠিক তেমনই নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার পরিধি থেকে শাসকের চোখ রাঙানির বিরুদ্ধে কীভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মর্যাদা দিতে হয় তা দেখিয়েছিলেন টিএন শেষণ সাহেব।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নো আইডেন্টিটি কার্ড, নো ভোট-এ তখন সারা দেশ উত্তাল। সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের সায়েন্টিফিক রিগিং ও ছাপ্পা ভোটের জারিজুরি ফাঁস করে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা দেশের পাদপ্রদীপে চলে এসেছেন। শেষণের আমলের সেই পদক্ষেপ ছিল প্রকৃত ভোটাধিকার রক্ষার কবচ। আর জ্ঞানেশ কুমারের আমলের এসআইআর হল ভোটারদের বন্দি বানানোর কর্মসূচি। আগে মানুষের ভোটাধিকারে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যে সরকার নির্বাচিত হত। সে কেন্দ্র হোক বা রাজ্য সরকার। অভিযোগ উঠছে এসআইআরের বাহানায় এখন কেন্দ্রীয় সরকার বেছে নিতে চাইছে ভোটারদের।
মনপসন্দ না হলেই ঘ্যাচাং ফুঁ করে দেওয়ার বন্দোবস্তও পাকা। গত লোকসভা ভোটের আগে চারশো পারের প্রোপাগান্ডা ফেটে ২৪০-এ নেমে আসার পর যেনতেন প্রকারে নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগিয়ে দেশ জুড়ে সুপার ইমার্জেন্সি চালু করেছে বিজেপি। এক দেশ এক ভোটের মোড়কে কার্যত স্বৈরশাসনের দিকে এগোচ্ছে বিজেপি-আরএসএস।

নোটবন্দির মতো ভোটবন্দির শিকার হচ্ছেন নিরীহ মানুষ। কিংবা বিএলও-রা। তার জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয় জাতীয় নির্বাচন কমিশন। এখানেই প্রশ্ন উঠছে (ওঠাটাই স্বাভাবিক) কীসের এত আগ্রহ কমিশনের! তাহলে কি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অজ্ঞাবাহী ক্রীতদাস হয়ে উঠেছে নির্বাচন কমিশন?
২০১৪-পর থেকে যেভাবে একের পর এক কেন্দ্রীয় এজেন্সি সে সিবিআই, ইডি বা ইনকাম ট্যাক্স যাই হোক না কেন, বিজেপির নিয়ন্ত্রাধীন হয়ে উঠে খেলো হয়ে পড়েছে, ঠিক সেভাবেই এবার জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ওপর শ্যেনদৃষ্টি হেনেছে তারা। এমতাবস্থায় চাটুকারিতার যাবতীয় সীমা-পরিসীমা পেরিয়ে যাচ্ছেন টিম জ্ঞানেশ কুমার (gyanesh kumar)। এই প্রসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই একটা অপ্রিয় প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। তাহলে কি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দফতরের প্রাক্তন আমলা হিসেবেই কাজ করছেন জ্ঞানেশবাবু? তাঁর কন্যা এবং জামাইয়ের কিছু পদপ্রাপ্তি সেই দিকেই কিন্তু ইঙ্গিত করছে।

Latest article