ঘটনা এক : অতনু আর রঞ্জনার সম্বন্ধ করে বিয়ের এক বছর পেরোতেই সমস্যার শুরু। রঞ্জনা বিয়ের আগেই একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করত, আর সেই কাজই ছিল তার আত্মসম্মানের জায়গা। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে ঢোকার পরই শুনতে হয়— বউয়ের বেসরকারি চাকরি নাকি মানায় না। এই ধরনের কথাবার্তা রঞ্জনা একেবারেই মেনে নিতে পারে না। অতনু কিছু না বললেও বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়ায় না, আর তাতেই রঞ্জনা আরও একা হয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রঞ্জনা বুঝে যায়, নিজের স্বপ্ন থামিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্পষ্টভাবে কথা বলেই নিজের জীবনকে নতুন করে, নিজের মতো করে গড়ে তুলবে।
ঘটনা দুই : পরিবারের চাপেই অলোককে বিয়ে করতে বাধ্য হয় তৃণা। বিয়ের আগে তার একটি গভীর পুরনো সম্পর্ক ছিল, আর সেই সম্পর্ক ভেঙে কিছুটা জোর করেই অলোকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু মন তো হঠাৎ বদলায় না। তাই অলোককে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে তৃণার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তার হৃদয় বারবার ফিরে যাচ্ছিল সেই মানুষটার কাছে, যাকে সে সত্যিই ভালবাসত। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে প্রাক্তনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রেখেছিল সে। একদিন সত্যিটা ধরা পড়তেই বাড়িতে অশান্তি তুঙ্গে ওঠে। বিশ্বাস ভেঙে যায়, কথার আঘাত আরও গভীর হয়। এখন ওদের সম্পর্ক এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে ডিভোর্সের কথাও আর অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
ঘটনা তিন : সুমন আর রেখার বিয়ে হয়েছিল সম্বন্ধ করে, কোষ্ঠী মিলিয়ে, সমস্ত নিয়ম মেনে। সবাই ভেবেছিল ওদের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত নিরাপদ। কিন্তু ওদের মেয়ের জন্মের পর জানা গেল যে সে থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। হাসপাতালের দরজা, রক্ত বদলের চিন্তা, সব মিলিয়ে তখন সবাই বুঝল, কোষ্ঠীর পাতায় নয়, সত্য লুকিয়ে ছিল রক্তের ভেতরেই। বিয়ের আগে মাত্র একটা রক্ত পরীক্ষা করলেই ধরা পড়ত দু’জনেই রোগটির বাহক কি না। আর রক্ত পরীক্ষা করে তার পরে বিয়ে করলে আজ তাদের এই সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হত না।
যুগ বদলে গেলেও দেখাশোনা করে বিয়ে বা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ এখনও আমাদের সমাজে সর্বজনগৃহীত। সম্বন্ধের বিয়ের জন্য ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট ছিলই যেটা এখন আরও আকর্ষণীয়। সেই সব সাইটে শুধুমাত্র পাত্র-পাত্রীর ছবিই নেই রয়েছে পুরোদস্তুর প্রোফাইল। এক কথায় বলা যায় তাঁদের বায়োডেটা। সেখানে পাত্র বা পাত্রী কী খাবার খেতে পছন্দ করেন বা কী তার ভাল লাগার গান, কোন পোশাক পছন্দ— সবটা দেওয়া থাকে। যাঁদের মিলে যাবে ক্রাইটেরিয়া শুভস্য শীঘ্রম। এমন করেই সফল হচ্ছে অনেক বিয়ে কিন্তু তা সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছে বেশ কিছু ফাঁকও। পছন্দ মিলে যাওয়াটাই তো সব নয়। তাই বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদও। আসলে একটা বিয়েকে সফল করতে চাই অনেকগুলো এক্স ফ্যাক্টর। দু’জন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের একসঙ্গে পথচলার অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া ফোনালাপ বা দু-চারটে ডিনার ডেটে গিয়েই কি পরস্পরকে চিনতে পারেন! সম্বন্ধের বিয়ে কি সবসময় সফল হয়? এমন ক্ষেত্রে কোন কোন দিকগুলোয় নজর দেবেন, কী কী দেখবেন—
প্রথম পরিচয়
সম্বন্ধ করে বিয়ের ক্ষেত্রে বর-কনের প্রথম দেখা বা পরিচয় পর্বটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেকের জন্য এই ধাপটা আনন্দের, আবার কারও কাছে একটু অস্বস্তিকরও লাগে। পরিচয় যত এগোয়, দু’পক্ষই একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করে। এই পর্বে সামনের মানুষটা অচেনা বলে নিজের ভিতরে কোনও সংকোচ রাখবেন না। একবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলে ফেরা উপায় নেই তাই কিছু কথা স্পষ্টভাবে আলোচনা হয়ে গেলে পরের ঝামেলা অনেকটাই কমবে।
ছোট ছোট দিকে নজর দিন
সাধারণত সম্বন্ধ করে বিয়ের ক্ষেত্রে পরিবার, পেশা, আর্থিক অবস্থা—এই কয়েকটা বিষয়ই গুরুত্ব পায়। কিন্তু সম্পর্কের ভিত শক্ত রাখতে আরও কিছু ছোট কিন্তু জরুরি দিক আছে, যেগুলো নিয়ে আলোচনা জরুরি। যেমন ধরে নেওয়া যাক পাত্রের সারাবছর এসি লাগেই, ভরা শীতেও কিন্তু পাত্রী শীতকাতুরে! খুব সামান্য অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় পরবর্তীতে বড় সমস্যা তৈরি পারে। হবু বর হয়তো মোটেই বেড়ানো পছন্দ করেন না অথচ প্রোফাইলে পছন্দের জায়গায় পাহাড় লিখে রেখেছেন! পাহাড় আর সমুদ্রের চক্করে দেখা গেল হবু বর যে আসলেই ঘরকুনো বা বছরে চারবার বেড়াতে যান বন্ধুদের সঙ্গে বা ওয়র্কোহলিক, কাজ ছাড়া কিছুই বোঝেন না এটাই জানা হয়নি। তার ব্যক্তিগত রুচিটা হয়তো ভুল নয় কিন্তু আপনি হয়তো তার পছন্দে নিজেকে মেলাতে পারবেন না। তাই দরকার খোলামেলা কথা বলে নেওয়া।
অতীত কিন্তু অতীত নয়
আগের সম্পর্ক অতীত হলেও সেনসিটিভ তাই পরে যখন একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে চলেছেন তাকে লুকোবেন না কিছুই। এমনকী লিভিং টুগেদার করলেও জানিয়ে দিন। আজকের যুগের উদার মানসিকতার প্রগতিশীল মানুষ হলে নিশ্চই তার সমস্যা হবে না আবার সমস্যা থাকলেও সেটা তার কোনও দোষ নয়। পরিবারের চাপে বিয়ে হয়ে যাওয়া নতুন ঘটনা নয়। সেই চাপের কাজে নতিস্বীকার করে পরে অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন এমন দম্পতির উদাহরণ এখন ভূরি-ভূরি। জোর করে সম্পর্কের বোঝা নিজের ঘাড়ে চাপাবেন না। সম্পর্ক ভেঙেছে নিজেকে এবার সময় দিন আবার নতুন করে। বাড়ির লোকের তাড়াহুড়োয় সায় দেবেন না।
নিজের কেরিয়ারে আপস নয়
পড়াশোনা, নিজের কেরিয়ার নিয়ে মেয়েরা এখন আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন। তাই যিনি চান না তাঁর স্ত্রী কেরিয়ার গড়ুক অযথা জোর করে সেই সম্পর্ককে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যাবেন না। ভাবছেন পরে বুঝিয়ে নেবেন কিন্তু জানবেন মানুষের বেসিক চরিত্রের বদল হয় না। একটা সময় যেটা বিয়ে নামক আবেগ পরবর্তী সময় সেটাই কঠিন বাস্তব হয়ে সামনে আসবে। আজ থেকে দশ বছর পর নিজেরা নিজেকে কোথায় দেখতে চান, সেটা স্পষ্টভাবে বলাই ভাল। কেউ চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত হতে চান, কেউ আবার ব্যবসা শুরু করার স্বপ্ন দেখেন। তাই হবু বর-কনে যেন পরস্পরের ভবিষ্যৎ-ভাবনা বুঝতে পারেন।
সেই সঙ্গে বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার এবং ভবিষ্যতে বিদেশেই সেটল করার স্বপ্ন ওখন অনেকেরই থাকে।
আবার কারও ইচ্ছে নিজের দেশেই থাকা। এক্ষেত্রে পরবর্তীতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ যাতে না থাকে তাই দু’পক্ষের ইচ্ছে বুঝে নেওয়াটা
খুব জরুরি।
পরিবারের দায়িত্ব
কোনও মেয়ে যদি বিয়ের পরেও তার বাবা-মায়ের খরচ বহন করতে চায় তা হলে হবু সঙ্গীকে আগে থেকেই বিষয়টা জানানো ভাল। এ ছাড়াও মেয়েটি যদি কাজ না করে তবুও বিয়ের পর আর্থিক দিক থেকে কতটা স্বাধীনতা চায় বা কীভাবে দায়িত্ব ভাগ হবে, এটা নিয়ে হবু সঙ্গীর সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া জরুরি। এই বিষয়গুলো স্পষ্ট থাকলে বিয়ের পর অনেক অপ্রয়োজনীয় চাপ ও ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যায়। এর পরেও মনের মিল সহজ নয় তাই জরুরি কিছু আগাম প্রস্তুতি।
যৌথ না সিঙ্গল পরিবার
এখন অনেকেই যৌথ পরিবারে মানিয়ে নিতে পারে না। তাই আগেভাগে দেখে নিন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হলেও অনেক সমস্যা। তাঁরা অনেক সময়ই সেই দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারেন না বা সেকেন্ড প্রায়োরিটি হয়ে যায়। সেটা ভীষণ ভুল বোঝাবুঝির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাই এই বিষয়ে আগে থেকেই নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট করুন।
কোষ্ঠী বিচার নয়, রক্ত পরীক্ষা
বিয়ের আগে কোষ্ঠী মেলানো নিয়ে অনেক পরিবারই খুব সচেতন, ১৬ গুণ মিললেই নাকি সব ভাল। কিন্তু যে পরীক্ষাটি সত্যিই ভবিষ্যতের দাম্পত্যকে নিরাপদ ও সুস্থ রাখতে পারে, তা নিয়ে অনীহা রয়েছে বেশির ভাগেরই। বিয়ের আগেই কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া জরুরি, যাতে পরবর্তী জীবনে বড় কোনও সমস্যায় না পড়তে হয় এবং ভবিষ্যৎ সন্তানের ঝুঁকি কমে।
বিয়ের আগে উভয়ের রক্তের গ্রুপ জানা অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট, থাইরয়েড, ডায়াবেটিস— ইত্যাদি পরীক্ষা করালে শরীরে কোনও অস্বাভাবিকতা আছে কি না, তা আগেই বোঝা যায়।
এছাড়াও অনেক রোগের বীজ থাকে আমাদের জিনে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, থ্যালাসেমিয়া, কিছু ধরনের ক্যানসার বা কিডনির সমস্যা আগে থেকেই জিনগতভাবে জানা থাকলে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয়। তাই জেনেটিক স্ক্রিনিং আজকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি আজীবন ভোগায় এবং চিকিৎসা দেরি হলে দাম্পত্যেও বড়সড় সমস্যা তৈরি হতে পারে। এছাড়া গনোরিয়া, সিফিলিস, ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিসের মতো সংক্রমণ আগে থেকে জানা গেলে চিকিৎসা করে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
আজকাল স্ট্রেস, কাজের চাপ আর অনিয়মিত জীবনযাপনের কারণে ইনফার্টিলিটি দ্রুত বাড়ছে। এই বিষয়টি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক চাপও বাড়ায়। তাই বিয়ের আগে উভয়েরই ফার্টিলিটি পরীক্ষা করিয়ে সেটা জেনে নেওয়া খুবই দরকার।
সব মিলিয়ে, কোষ্ঠী মিলের থেকে অনেক বেশি জরুরি এই পরীক্ষাগুলো। এগুলো আগে করিয়ে নিলে বিবাহিত জীবন অনেকটাই নিরাপদ, নির্ভার ও সুস্থ হয়ে ওঠে।
বিয়ে মানে দু’জন মানুষের একসঙ্গে পথচলা, তাই পরিবারের মত যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি দু’জনের নিজেদের ইচ্ছে আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বিয়ের আগে খোলাখুলি কথা হলে বোঝাপড়াও বাড়ে, আর পরে সম্পর্ক চলে আরও সহজভাবে, কম ভুল বোঝাবুঝিতে।
প্রাক্ বিবাহ কাউন্সেলিং
বিয়ের কয়েক মাস পেরোতেই অনেক সময় সম্পর্কের আসল ছবি সামনে আসে। রোজগার, খরচ, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ— এসব নিয়ে মতভেদ থেকেই অশান্তির শুরু। মনোবিদরা বলছেন, এমনই ছোট ছোট বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি জমতে জমতেই দাম্পত্যে দূরত্ব তৈরি হয়, আর অনেক দম্পতিই শেষমেশ সম্পর্ক ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান। আর এই কারণেই প্রাক্-বিবাহ কাউন্সেলিং একান্ত প্রয়োজন। তাই এখন অনেক তরুণ-তরুণীই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মনোবিদের সঙ্গে বসে নিজেদের মানসিকতা ও প্রত্যাশা মিলিয়ে নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা খোলামেলা আলোচনায় এমন সব প্রশ্ন সামনে আনছেন, যেগুলো পরে হঠাৎ সামনে এলে সম্পর্কের ভাঙন ডেকে আনতে পারে। তাঁদের মতে, এই আলোচনা যত তাড়াতাড়ি হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়াও তত সহজ। একসঙ্গে পথ চলবেন, নাকি পিছিয়ে আসবেন? মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা বিয়ে-ভাঙার প্রক্রিয়া নয় বরং বিয়েকে আরও নিশ্চিত ও প্রস্তুত করে তোলার উপায়। তাঁর মতে, সঙ্গীর চরিত্রের আসল দিকগুলো বিয়ের আগেই জানা গেলে পরের জীবন অনেকটাই সহজ হয়। আসলে প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু নেতিবাচক দিক থাকে আর সেইগুলো যদি আগে থেকে জানা যায় তাহলে সেটা মেনে নেওয়া খুবই সহজ হয়। আর নতুন সম্পর্কটাও বাস্তবভিত্তিক হয়।

