একি তাজ্জব ঘটনা। সংসদে ‘বন্দে মাতরম্’ ও ‘জয়হিন্দ’ স্লোগান দেওয়া যাবে না! কোনও বিদেশি সরকার এই ধরনের নির্দেশ দিলে সেটা স্বাভাবিক ঘটনা মনে করার কারণ ছিল। কিন্তু আমাদের স্বাধীন ভারতের নির্বাচিত সরকার এই ধরনের নির্দেশ জাহির করতে পারে? এর কারণ কী? যুক্তি কী? সাধারণ দৃষ্টিতে বোধগম্য নয়।
১৮৮২ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে ‘বন্দে মাতরম্’ স্ত্রোত্র বা গীত হিসাবে ছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় ১৯০৫ সালের ৭ অগাস্ট ‘বন্দে মাতরম্’ প্রথম রাজনৈতিক স্লোগান হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং মানুষের রক্ত গরম করে দেয়। তখন থেকে হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী এই মন্ত্রের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। অনেকে এই মন্ত্র সজোরে উচ্চারণ করতে করতে হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গিয়ে বীরের মৃত্যু বরণ করেছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে বন্দে মাতরম্ গান গাওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন-খসড়ায় একজন ভোটারের নামও বাদ গেলে যে আন্দোলন হবে তা দেখেনি দেশ: অরূপ
স্বাধীনতার প্রাক্-মুহূর্তে স্বাধীনতার প্রাক্-মুহূর্তে স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য গঠিত গণপরিষদ (Constituent Assembly) সর্বসম্মতিক্রমে বন্দে মাতরম্কে ‘জাতীয় গীত’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। কেন্দ্রীয় সরকার আড়ম্বরের সঙ্গে ৭ নভেম্বর (১৯২৫) ‘বন্দে মাতরম্’-এর সার্ধশতবর্ষ পালন করল। এর মধ্যে কী হল? ‘বন্দে মাতরম্’-এর মতো ‘জয় হিন্দ’ নিছক রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এটিও একটি মন্ত্র, যে মন্ত্রের দ্বারা দীক্ষিত হয়ে নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সহস্র সহস্র সেনা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। ‘জয় হিন্দ’ মন্ত্রটি ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণায় আসমুদ্র হিমালয় কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ভারতের সমস্ত জাতীয়তাবাদী দলগুলি এই স্লোগান শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে। তাহলে কোন যুক্তিতে ‘জয় হিন্দ’ নিষিদ্ধ হল। সংসদ হল ভারতীয় গণতন্ত্রের মন্দির। সেখানে যদি এই দুটি মন্ত্র উচ্চারিত হতে নিষিদ্ধ হয়, তাহলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সমগ্র দেশের উপর পড়তে বাধ্য।
মূল কারণ হল বাংলা ও বাঙালি বিদ্বেষ। বাঙালি বিরোধিতার মনোভাব স্বাধীনতার পর থেকেই ছিল। ভারত ভাগের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলা ও পঞ্জাব। দুটি প্রদেশই বিভক্ত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু সব হারিয়ে ভারতবর্ষে এসেছেন। কিন্তু পাঞ্জাবের উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকার যতটা বেশি মনোযোগী ছিল, বাংলার ক্ষেত্রে ততটা ছিল না। ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় এবং ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় যুগ্মভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে সচেষ্ট না হলে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের অবস্থা আরও করুণ হতে পারত। অবশ্য এই দুই প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ ছিল। তবুও তাঁরা এক হয়েছিলেন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে, যেটা এখন কমই দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গ ন্যায্য আর্থিক পাওনা থেকে বারংবার বঞ্চিত হয়েছে সেই পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিক থেকে। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। বর্তমানে অবশ্য বাঙালি বিরোধিরা বাঙালি বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে। ভাষা সন্ত্রাস চলছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাংলাভাষায় কথা বললে পেটানো হচ্ছে, নানাভাবে লাঞ্ছনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি পুরীতে গিয়েছিলাম। স্বর্গদ্বারের কাছে একটি চায়ের দোকানে চা খেতে বসলাম। দোকানির চেহারা দেখে মনে হল, তিনি বাঙালি। জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি ইতিবাচক উত্তর দিলেন। যখন আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কোন জেলায় বাড়ি, তিনি গম্ভীরভাবে সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি কোনও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী নই! একজন পর্যটকমাত্র ও পেশায় শিক্ষক। তখন তিনি তাঁর মনের কথা খুলে বললেন। পুরীতে বাঙালিরা একরকম ভয়ের মধ্যে আছেন। শুধু পরিযায়ী শ্রমিক বা কর্মচারী নন, যে-সমস্ত বাঙালি বংশ-পরম্পরায় পুরীতে বসবাস করছেন, তাঁদেরও কম-বেশি একই অবস্থা। তাঁরা ঘরের বাইরে গেলে নিজেদের মধ্যে বাংলা ভাষায় কথা না বলে ওড়িশা ভাষায় কথা বলেন, যাতে প্রকাশ্যে অপমানিত ও প্রহৃত না হন। দোকানিভাই আরও বললেন, বাঙালিরা ভাল নেই। পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার। ওড়িশাতে কেন্দ্রীয় শাসক দল ক্ষমতায়। বিহার এবং উত্তরপ্রদেশেও বাঙালিদের মোটামুটি একই অবস্থা। এই রাজ্য দুটিতেও কেন্দ্রীয় শাসকদল ক্ষমতায় রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ ধারাবাহিকভাবে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের পাওনা নূন্যতম ১ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা। কেন্দ্র নানা বাহানায় আটকে রেখেছে। অথচ আর্থিক বছর শেষ হতে চলেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পর্যন্ত অপমান করা হয়েছে। অসমে ‘আমার সোনার বাংলা’ এই রবীন্দ্রসংগীতটি গাইবার জন্য কয়েকজনকে গ্রেফতরা করা হয়েছে। তাঁরা এখন সংশোধনাগারে আছেন। অসম সরকার গানটিকে নিষিদ্ধ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রীয় শাসকদল অসমেও ক্ষমতাসীন।
আরও পড়ুন-বঞ্চনা : সংসদে লড়াই আরও জোরদার
কবিগুরুর প্রতি এর থেকে বড় অসম্মান কী আছে? অথচ এই কেন্দ্রীয় শাসকদলের আদি প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ ছিলেন ‘বাংলার বাঘের’ ছানা সুপণ্ডিত পুরোদস্তুর আপাদমস্তক বাঙালি ভদ্রলোক। তাঁকেও ভুলতে বসেছে এই দল। একমাত্র ৬ জুলাই তাঁর জন্মদিনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মালা দেওয়া ও কয়েকটি রাস্তা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা ছাড়া আর কোনও কর্তব্য নেই। এই ব্যক্তিত্বের অকালমৃত্যু সম্পর্কেও বিতর্ক আছে, বিশেষ করে বাঙালি মনে— মৃত্যু কি স্বাভাবিক ছিল? অথবা কোনও রহস্য আছে? অটলবিহারী বাজপেয়ীজি তাঁর পাঁচ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রিত্বকালে অথবা নরেন্দ্র মোদীজি এখন পর্যন্ত তাঁর এগারো বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে এই স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনও তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কি? তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে কি? এই বাঙালি ভদ্রলোক অবিসংবাদী সাংসদ ছিলেন। তাঁকে বলা হত ‘সংসদের সিংহ’ (Lion of Parliament)। যিনি সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর চোখে চোখে রেখে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, বাংলার সমস্যা জাতীয় সমস্যা। বাংলার সমস্যা অবহেলা করে জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে অনেকের বক্তৃতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য তাঁরা নিশ্চয়ই মান্যবর ব্যক্তি ছিলেন। দলের আদি প্রতিষ্ঠাতার সংসদে ভাষণ, অখণ্ড বাংলার আইনসভায় ভাষণ, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণ ইত্যািদ পুস্তক আকারে প্রকাশ করতে কেন্দ্রীয় সরকার কোনও উদ্যোগ নিয়েছেন কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে আমাদের রাজ্যে জনসভায় দুই-একবার তাঁর নাম বলেন। ব্যস, ওইটুকুই। এত উদাসীনতা, অবহেলা। কেন? কারণ তিনি বাঙালি। আরও বলি, মান্যবর প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় স্বামী বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। অথচ শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের উদার হিন্দুত্ববাদকে বিকৃত করা হচ্ছে। প্রবন্ধকার নিশ্চিত, কিছুদিনের মধ্যে বিবেকানন্দ বর্জিত হবেন।
জাত-পাতভিত্তিক, বুর্জোয়া শক্তিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি সরকার বাঙালি বিদ্বেষী হবেই। তাই বঙ্কিমচন্দ্র, নেতাজিকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো হবেই, কারণ এঁরা যে বাঙালি।
কিন্তু বাংলা, বাঙালিকে রুখতে পারা সহজ নয়। বাঙালি গর্জে উঠলে বাঙালির অমোঘ শক্তি যে কোনও প্রতিরোধকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে। স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলি তার প্রমাণ।

