সালটা ১৯৯০। বাংলার মসনদে সর্বহারার মহান নেতা জ্যোতি বসু।
সমগ্র ৮০-র দশক জুড়ে জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন-এর বদান্যতায় একের পর এক কল-কারখানা আর জুট মিল বন্ধ করে দেওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র বাঙালি মেধার আকর্ষণে কলকাতায় তাদের শাখা খুলতে অতি উৎসাহী ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা মাইক্রোসফট।
কিন্তু জ্যোতি ছিলেন জ্যোতিতে (মস্তিষ্কের লোডশেডিং-এ) এবং সিপিআইএম ছিল বর্তমান সিপিআইএম-এই (পড়ুন মস্তিষ্ক মহাশূন্যতায়)। প্রাথমিক থেকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার “ঐতিহাসিক ভুল” সিদ্ধান্তের পরেই বাংলার শিল্পায়নের কফিনের ওপর শেষ পেরেকটি পোতা হল মাইক্রোসফট প্রধান-এর ভারত সফরের দিনেই। সেদিন কলকাতার রাজপথে লাল ঝান্ডা হাতে কম্পিউটার ভেঙে মাইক্রোসফটকে কলকাতায় ব্যবসা করতে না দেওয়ার সুস্পষ্ট হুমকি বার্তা দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন-সেচমন্ত্রী : বোরো চাষে পাঁচ জেলার ৬৮ হাজার একর জমি পাবে দামোদরের জল
না, মাইক্রোসফট হাজার হাজার একর চার ফসলি জমিতে তাদের সংস্থা খুলতে চায়নি, মাইক্রোসফট কলকাতার বুকে দাম দিয়ে কয়েক বিঘে অকৃষি জমি কিনে ব্যবসা করতে চেয়েছিল, আর মাইক্রোসফট-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে কলকাতায় ব্যবসা করতে আসছিল শতাধিক গ্লোবাল আইটি ব্র্যান্ড। বিশ্বের নামীদামি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি হত হাজার হাজার বাঙালি যুবক-যুবতীর। কিন্তু সেটা হতে দেওয়া হল না, লাল ঝান্ডা আর লাল চোখের রাঙানিতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মাইক্রোসফট-সহ একাধিক সংস্থা পাড়ি দিল বেঙ্গালুরু-হায়দরাবাদে।
তারপর হুগলি নদী দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ-এর মতো অপেক্ষাকৃত ছোট শহরগুলি একের পর এক তথ্য প্রযুক্তি এবং টেলিকম সংস্থার হাত ধরে ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করল আর বাঙালি মেধার দক্ষিণমুখী যাত্রা শুরু হল।
৯০ দশকের মাঝামাঝি যখন বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, চেন্নাই, পুণে, দিল্লি, এনসিআর এমনকী পার্শ্ব রাজ্য ওড়িশার ভুবনেশ্বরে গজিয়ে উঠল একের পর এক তথ্য-প্রযুক্তি হাব, তখন কুয়োর ব্যাঙ সিপিএম-এর টনক নড়ল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
২০০০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত সল্টলেক-এর তথ্য-প্রযুক্তি হাব-এর বড় ব্র্যান্ড মাত্র চারটি— টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, আইবিএম, উইপ্রো এবং কগনিজেন্ট। এবং তার সঙ্গে গোটা ১০-১২টি ছোটখাটো বিপিও সংস্থা।
২০০০ সালের পরের তথ্য অনুযায়ী সেই সময় সল্টলেক-এর সেক্টর ফাইভ-এর তথ্য প্রযুক্তি এবং বিপিও সংস্থাগুলিতে কাজ করতেন ৮-৯ হাজার মানুষ।
২০২১-’২২-এ সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার এবং বড়-ছোট মিলিয়ে আজকের তারিখে কলকাতায় তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার সংখ্যা প্রায় ১৫০০ ছুঁইছুঁই।
শুধু ২০২১ থেকে ২০২৫-এর মধ্যেই কলকাতায় ব্যবসা করতে এসেছে ৪৩টি নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা— মাইন্ডট্রী, টেকমাহিন্দ্রা, জেনসার, ডেলয়েট, ডিএক্সসি টেকনোলজিস, ক্যাপজেমিনি, অ্যাকসেন্চার— কে নেই সেই তালিকায়।
টাটা কনসালটেন্সির গীতাঞ্জলি পার্ক হল পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ তথ্য প্রযুক্তি ক্যাম্পাস যেখানে কাজ করে ১৭০০০ ছেলেমেয়ে— এটাও তৈরি হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালেই। এই সময়কালে কলকাতায় তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার সংখ্যায় জোয়ার আসার ফলে সেক্টর ফাইভ ছাড়িয়ে রাজারহাট-নিউটাউন-এর আইটি পার্ক-এ একে-একে গজিয়ে উঠেছে বিশ্ববন্দিত সব আইটি ফার্ম।
আরও পড়ুন-সংবিধান অটুট রাখার দাবিতে শহরের রাজপথে প্রতিবাদে তৃণমূল মহিলা কংগ্রেস
সিপিএমের আমলের জমি জট কাটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কলকাতায় এসেছে বাঙালি প্রযুক্তিবিদ-দের “সাধের ইনফোসিস”! ঠিক ইনফোসিস ক্যাম্পাস-এর পাশেই গড়ে উঠেছে আইটিসি ইনফোটেক-এর সুবিশাল ক্যাম্পাস, কাছেই উইপ্রো শুরু করেছে কলকাতায় তাদের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস-এর কাজ। জল, আলো, রাস্তা-সহ ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সমস্ত রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুনতে হয় তিনি নাকি শিল্প-বিরোধী! এরপরেও ইচ্ছাকৃত এবং স্বভাবসুলভ কুৎসা হয় যে “কলকাতায় নাকি ভাল চাকরি নেই”, “সব কোম্পানি বাংলা ছেড়ে চলে গেছে” ইত্যাদি প্রভৃতি।
কুৎসাকারীদের জন্যই এই তথ্যগুলো পরিবেশন করা জরুরি ছিল, আর যারা এই কুৎসাকারীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হন, এই ইন্টারনেট-এআই-এর যুগে এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা তাদের কাছে খুব কঠিন কাজ নয়।
একটা ৩৪ বছরের সরকার একটা জাতির তিনটে প্রজন্মকে পঙ্গু করে দিয়ে বিদায় নিয়েছিল, সেখান থেকে বাংলাকে টেনে তোলার যে প্রাণপণ লড়াই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লড়ছেন সেই লড়াইকে কুর্নিশ!
কুৎসাকারীদের মুখে ঝামা ঘষে এভাবেই এগিয়ে চলুক বাংলা ও বাঙালি, আর ভাল থাকুন মমতা!

