(১) নোটিশ পেলেন নাকি? (২) ইনিউমারেশন ফর্ম জমা করেছিলাম কিন্তু খসড়া তালিকায় নাম নেই কেন? (৩) নোটিশ এসেছে, এবার কোথায় যেতে হবে একটু বলে দিন না! আর কী কী কাগজ নিতে হবে? (৪) নাম বাদ চলে গেলে কি আবার নতুন করে অ্যাপ্লাই করতে হবে? নতুন ভোটার হিসেবে? (৫) কত লাখ বাদ গেল শেষ পর্যন্ত?
অতঃপর এসব প্রশ্নে মুখরিত হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ।
এবং এটাই প্রমাণিত সত্য, এসআইআর (SIR) আসলে ভোটার তালিকা নিবিড় সংশোধন নয়, এ এক হরর মুভি। ভোটার কার্ড নিয়ে এমন অবস্থা এর আগে কখনও হয়নি। এবারই হচ্ছে। কারণ, বিজেপির বি টিম নির্বাচন কমিশন। তাদের একমুখী অ্যাজেন্ডা— এসআইআর।
বাংলায় এত বছরেও যে বিজেপির সংগঠন মজবুত হয়নি, সে-ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। ৯৪ হাজার বুথে দলীয় স্বার্থে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কর্মী তাদের নেই। ঘরে ঘরে জনসংযোগ তাদের নেই। গ্রামাঞ্চলে কিংবা শহরের নাগরিকরা কতজন বিজেপি কর্মীকে চেনেন প্রশ্ন করা হলে, উত্তর হাতড়াতে হবে। তাহলে ওরা ভোট উতরাবে কীভাবে? ভরসা তাই, এসআইআর। এবং এসআইআর-এর এই অঙ্ক মোটেও মাঠেঘাটে হবে না। বোঝাই যাচ্ছে, সবটাই হবে ঠান্ডা ঘরে।
বিজেপি পার্টি অফিসে বানানো তালিকা ধরে নির্বাচন কমিশন কাজ করছে। গণতন্ত্রের পক্ষে ভয়ঙ্কর একটা অবস্থা।
এমনটা না হলে গেরুয়া শিবিরের নেতারা কীভাবে এসআইআর শুরুর এক মাস আগে বলতে পারেন যে, বাংলায় ১ কোটির উপর নাম বাদ যাবে? ইতিমধ্যেই কিন্তু প্রায় ৫৫ লক্ষ নাম বাদ যাওয়াটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। কমিশনের হিসেব বলছে, এরা হয় মৃত, না হলে স্থানান্তরিত। এছাড়া একটা অংশের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর খসড়া তালিকা প্রকাশের পর নোটিশ কতজন পেতে চলেছেন? অন্তত ৪০ লক্ষ।
এসআইআর নামক ‘বিষবৃক্ষ’ এখন বুথে বুথে ডালপালা বিস্তার করছে। ভোটার তালিকা বেরনোর পর ফল কুড়ানোর কাজটা শুধু বিজেপি করতে চায়।
সবটাই কিন্তু করবে ওরা নিয়ম মেনে। দেখে মনে হবে, খেলা আছে। কিন্তু প্রমাণ করা যাবে না। গেরুয়া শাসক একগাল হেসে বলবে, কাকতালীয়।
ঠিক যেভাবে মোদিজির এক পরম কর্পোরেট বন্ধু দেশের সবচেয়ে বড় পাইলট ট্রেনিং স্কুল ৮২০ কোটি টাকা দিয়ে অধিগ্রহণের তিনদিনের মধ্যে নির্দেশিকা জারি হল ডিজিসিএ’র। তাতে বলা হল, বিমানচালকদের ৩৬ ঘণ্টা নয়, ৪৮ ঘণ্টা বিশ্রাম দিতে হবে। আর এই নির্দেশিকা কার্যকর করতে হবে অবিলম্বে। ধসে পড়ল ভারতের অন্তর্দেশীয় বিমান পরিষেবা। কারণ, ওই নির্দেশিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিমান চালানোর মতো পাইলট কোনও সংস্থার কাছেই নেই। যারা দিনে বেশি বিমান চালায়, তাদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। নিঃসন্দেহে সংস্থাটির নাম ইন্ডিগো। মানুষ খেপে গেল তাদের উপর। ভাঙচুর হল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিমানবন্দরের কর্মীরা ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ বা ডিনারের বদলে শুধু গালি খেলেন। কিন্তু মোদ্দা হিসেবটা কী দাঁড়াল? পাইলট চাই। ‘কর্মখালি’র একটা সেক্টর বাড়ল। আর ঝাঁকে ঝাঁকে যুবক-যুবতীরা আগ্রহী হলেন পাইলট ট্রেনিংয়ে। কোথায় যাবেন তাঁরা? এফএসটিসি। দেশের সবচেয়ে নামজাদা পাইলট ট্রেনিং সংস্থা।
কাকতালীয়।
আরও পড়ুন-বাংলার বস্ত্রশিল্পের গৌরব পুনরুদ্ধারে মসলিনতীর্থ
এমন কাকতালীয়ভাবে এসআইআরের ইনিউমারেশন ফর্ম পূরণে পিছিয়ে রয়েছে অনেক রাজ্যই। তার উপর অতিরিক্ত কাজের চাপে একাধিক রাজ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বিএলও’রা। সেসব কথা মাথাতে রেখে দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে এসআইআরের সময়সীমা আরও এক সপ্তাহ বৃদ্ধি করল জাতীয় নির্বাচন কমিশন। এবং সেই তালিকায় রাখা হল না পশ্চিমবঙ্গকে। অর্থাৎ বাংলাতে এসআইআরের কাজের জন্য যে নির্দিষ্ট তারিখ রয়েছে তার মধ্যেই প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এসআইআরের (SIR) ইনিউমারেশন পর্ব তামিলনাড়ু এবং গুজরাতকে শেষ করতে হবে। ওই দুই রাজ্যে খসড়া তালিকা প্রকাশ করার তারিখ ১৯ ডিসেম্বর। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে একই কাজ শেষ করতে হবে ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে। সেখানে খসড়া তালিকা প্রকাশের দিন ২৩ ডিসেম্বর। উত্তরপ্রদেশের ক্ষেত্রে গোটা প্রক্রিয়া ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। যোগী রাজ্যে খসড়া তালিকা প্রকাশের দিন ৩১ ডিসেম্বর।
পক্ষান্তরে এসআইআরের কাজ করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বিএলও’রা। মৃত্যু হয়েছে কয়েকজনের। কাজের চাপে অসহায় বোধ করছিলেন বলে অভিযোগ জানিয়েছেন বহু বিএলও। অথচ নতুন করে বেশ কয়েকটি রাজ্যকে সময় দেওয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে নির্ধারিত দিন থাকছে ১১ ডিসেম্বরই।
কেন?
কারণ ওই একটাই। এ-রাজ্যে বিজেপি সংগঠনের কার্যকরী বিকল্প এসআইআর।
এবং তার সঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের নোংরা চেষ্টা।
উগ্র দেশপ্রেমের বিস্তারের নামে বিজেপি দেশটাকে ক্রমে দুর্বল এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেউলিয়া করে তুলছে। এসব করা হচ্ছে কখনও পোশাকের দোহাই পেড়ে, কখনও খাদ্যের নামে কিংবা উপাসনা পদ্ধতির বিশিষ্টতার কারণে। মোদিযুগে এই ব্যাধির কিছু দৃষ্টান্ত প্রথম রেখেছে উত্তর ভারতের একাধিক রাজ্য। মোদি-শাহের রাজ্য গুজরাত এবং দক্ষিণ ভারতেও বিজেপি প্রভাবিত কিছু স্থানে এই রোগসংক্রমণজ্বালা আমাদের পীড়া দিয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম এবং ত্রিপুরায় বিজেপি সরকার তৈরি হওয়ার পর ধর্মীয় ঘৃণার রাজনীতি সেখানকার পবিত্র জনসমাজকে কলুষিত করেছে। একাধিক তুচ্ছ অজুহাতে হিন্দিবলয়ে প্রাণহানির মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটে গিয়েছে ইতিমধ্যে। তবে এই ব্যাপারে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে ধারাবাহিকভাবে স্বস্তিতেই ছিল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। অন্তত এখানে কেউ কারও উপর ফতোয়া জারি করার দুঃসাহস দেখায়নি। গীতাপাঠের ব্রিগেড বুঝিয়ে দিল, ‘বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি’ বলে আমাদের যে অহংকার, অদূর ভবিষ্যতে তা ধূলিসাৎ হতে পারে এই দুর্বৃত্তদের আজ রেয়াত করা হলে।
সুতরাং, এসআইআর নিয়ে সতর্ক থাকুন।
হাতে হাত মিলিয়ে বিজেপি-মুক্ত বাংলা গড়ুন।

