সোডিয়াম ও পটাশিয়াম হল দুটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থ বা ইলেক্ট্রোলাইট, এরা যেমন শরীরে কোষের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে, তেমনই মস্তিষ্কের কোষের কার্যক্ষমতাও নির্ভর করে এই সোডিয়াম-পটাশিয়ামের উপর। শরীরের তরল ভারসাম্য, স্নায়ু ও পেশির সঠিক কার্যকারিতা, এবং অন্যান্য মৌলিক জৈবিক প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য এরা। পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম মিলেই তৈরি হয় মানবদেহের ইলেকট্রোলাইটস পরিবার। এ সব উপাদানের পরিমাণ কমবেশি হলেই সৃষ্টি হয় ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা। দু’টির অসামঞ্জস্যতায় হতে পারে জটিল রোগ এবং কিছু ক্ষেত্রে জীবনহানির মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন-রাজধর্ম পালন মুখ্যমন্ত্রীর
পরিমাপ
রক্তে স্বাভাবিক সোডিয়াম সিরামের মাত্রা প্রতি লিটারে ১৩৫ থেকে ১৪৫ মিলিকুইভ্যালেন্ট। এই সীমার বেশি হলে হয় হাইপারনেট্রেমিয়া। আবার ১৩৫ মিলিকুইভ্যালেন্টের নিচে হলে তাকে হাইপোন্যাট্রেমিয়া বলে। দুই ক্ষেত্রেই শারীরিক জটিলতা আসতে পারে।
WHO এর মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন ২০০০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম খাওয়া উচিত। প্রায় ৫ গ্রাম লবণে এই পরিমাণ সোডিয়াম থাকে। সহজ ভাষায়, মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম অর্থাৎ ১ চা চামচ লবণ খাওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ প্রয়োজনের দ্বিগুণ নুন খায় রোজ। বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন ১০.৭৮ গ্রাম নুন খায়, যা দুই চা চামচের সমান। তাতে ৪৩১০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম থাকে। যা দৈনিক প্রয়োজনের প্রায় দ্বিগুণ। নুন শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিজ্ঞানের ভাষায় একে সোডিয়াম ক্লোরাইড বলে। কিন্তু অতিরিক্ত লবণ খাওয়া উচ্চ রক্তচাপ-সহ অনেক গুরুতর রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
আবার ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কের রক্তের সিরামে পটাশিয়ামের মাত্রা প্রতি লিটারে ৩.৫ থেকে ৫.০-৫.২ মিলিমোল হয়। শরীরে পটাশিয়াম এই সীমা পেরলেই দেখা দিতে পারে হাইপারক্যালেমিয়া। আবার হাইপোক্যালেমিয়া হল এমন একটি অবস্থা যখন রক্তে পটাশিয়ামের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। দুটোর ক্ষেত্রেই আসতে পারে নানা জটিল উপসর্গ।
সোডিয়াম কোষের মেমব্রেম ঠিকঠাক ভাবে তৈরি হতে সাহায্য করে। যদি মেমব্রেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে কোষের ক্ষতি হয় মারাত্মক। তেমনই আমাদের বেঁচে থাকতে যে উপযুক্ত মিনারেল প্রয়োজন তা মেটায় পটাশিয়াম। সোডিয়াম রক্তে মেশে বেশিমাত্রায়। কোষের মধ্যে প্রবেশ করে খুব অল্প। পটাশিয়াম রক্তে মেশে কম মাত্রায়। বেশি কোষের ভিতরে থাকে।
হাইপোন্যাট্রেমিয়া
সোডিয়াম কমলে পেশির দুর্বলতা, ক্লান্তি, শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সমস্যা।
মানসিক বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, মনোযোগের অভাব, স্মৃতিশক্তি হ্রাস ইত্যাদি।
পেশিতে ক্র্যাম্প, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, খিঁচুনি, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা।
গুরুতর ক্ষেত্রে কোমা বা মৃত্যুর মতো বিপদও আসতে পারে।
হাইপারন্যাট্রেমিয়া
শরীরের যদি সোডিয়াম বেড়ে যায় তাহলে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। শরীরে জল জমে এবং কিডনির ওপর চাপ তৈরি করে।
শরীরে সোডিয়াম বাড়লে তৃষ্ণা প্রচণ্ড বেড়ে যায়।
মানসিক বিভ্রান্তি আসে, মনোযোগের,অভাব, অস্থিরতা এবং মাংসপেশির টান অর্থাৎ খিঁচুনি দেখা দিতে পারে।
শরীরে অতিরিক্ত সোডিয়াম নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে জল ধরে রাখে ফলে ব্লাড ভলিউম বা মোট রক্তের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং রক্তনালির ওপর চাপ সৃষ্টি করে যা উচ্চরক্তচাপ ঘটায়।ফলে সোডিয়াম বাড়লে অতিরিক্ত রক্তচাপ হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির ওপর চাপ ফেলে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
অতিরিক্ত সোডিয়াম বের করতে কিডনির উপর চাপ পড়ে। এর ফলে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পায়।
আরও পড়ুন-মোটা অঙ্কের বিনিময়ে চলত নারী-পাচার, স্পা সেন্টারের পর্দা ফাঁস
হাইপোক্যালেমিয়া
শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি হলে পেশির দুর্বলতা, ক্র্যাম্প বা খিঁচুনি হয়। সেই সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত হার্ট বিট বা অ্যারিথমিয়া দেখা দিতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য এবং ডায়েরিয়া দুই দেখা দিতে পারে। পেটে কম বা বেশি ব্যথা হতে পারে। ভীষণ দুর্বলতা হয় শরীরে।
কিছু ক্ষেত্রে পটাশিয়ামের অভাবে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নষ্ট হয়, মনের ওপর প্রভাব ফেলে, মানসিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
হাইপারক্যালেমিয়া
পটাশিয়াম বাড়লে খুব ক্রাম্প ধরে হাত এবং পায় অসাড়তা আসে, ঝিঝি ধরে।
পেটে প্রচণ্ড অস্বস্তি, বমি বমি ভাব হয়। বমিও হতে পারে।
শ্বাসকষ্ট হতে পারে, সঙ্গে খুব শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
রক্তচাপ কমতে পারে। হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং স্নায়ুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে।
কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে শরীর অতিরিক্ত পটাশিয়াম বের করতে পারে না ফলে বেড়ে যায়।
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস কিডনির ক্ষতি করে অতিরিক্ত পটাশিয়াম বের করতে বাধা দেয়, ফলে রক্তে পটাশিয়াম বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিস এই গুরুতর অবস্থায় শরীর থেকে পটাশিয়াম বেরিয়ে যেতে পারে।
কী করণীয়
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমনিতেই কমে আসে। কমতে থাকে শ্বেত রক্তকণিকাও। ফলে শরীর নতুন প্যাথোজেনের সঙ্গে লড়াই করতে পারে না সাবলীলভাবে। তাই অল্পেই নানা রোগ ধরে যায় বয়স্কদের। অধিকাংশ বয়স্ক মানুষই উচ্চ রক্তচাপের কারণে নুন কম খান। এর পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছু ওষুধ আছে যেগুলো খেলে শরীর থেকে নুন বেরিয়ে যায়। ফলে শরীরে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়।
তাই বয়স্কদের সবচেয়ে আগে সোডিয়াম-পটাশিয়াম টেস্ট করিয়ে রাখা জরুরি।
কিডনির অসুখ, মেনিনজাইটিস, মস্তিষ্কের টিউমার জাতীয় অসুখেও শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়াম অনিয়ন্ত্রিত হয়।
প্রক্রিয়াজাত খাবার কমিয়ে ফল ও শাকসবজি যেমন কলা, পালং শাক, মিষ্টি আলু, টমেটো বেশি খান।

