বাদ পড়লেন গান্ধীজি

জাতির জনকের নাম ভুলে যাচ্ছে ওরা। তাই, যে রাজ্য নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুসারে, ৪০ শতাংশ বেকারত্ব কমিয়েছে, ২ কোটির ওপরে কর্মসংস্থান করতে সমর্থ হয়েছে, সেই রাজ্যের মা-মাটি-মানুষের সরকারই না হয় বেকারত্ব দূরীকরণ প্রকল্পে মহাত্মাজির নাম জুড়ে তাঁকে সম্মান জ্ঞাপনের কর্তব্য পালন করল। লিখছেন আকসা আসিফ

Must read

এসআইআর-এ যেমন নির্বাচন কমিশনের অপদার্থতায় হাজার হাজার বৈধ ভোটারের নাম কাটা পড়ছে, তেমনই কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতায় কেন্দ্রীয় জনকল্যাণ প্রকল্পে বাদ গিয়েছে মহাত্মা গান্ধীর নাম। স্বচ্ছ ভারত অভিযানের লোগোতে শুধু গান্ধীজির (Mahatma Gandhi) স্মারক হিসেবে চশমাটুকু ছিল, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে তাঁর নাম-নিশান কিছুই রইল না!

থাকবেই বা কেন? এ তো গান্ধীর (Mahatma Gandhi) ভারত নয়, এ হল মোদির ভারত, অমিত শাহের ভারত, বিজেপির ভারত।
১০০ দিনের কাজের মেয়াদবৃদ্ধি এবং প্রকল্পের নামবদল সংক্রান্ত-বিল পেশ করা হল লোকসভায়। মঙ্গলবার বিলটি পেশ করেন কেন্দ্রের কৃষি এবং গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান। এত দিন ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের নাম ছিল মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপাওয়ারমেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট, ২০০৫ (সংক্ষেপে মনরেগা)। বিলে এই প্রকল্পের নতুন নাম হয়েছে ‘বিকশিত ভারত— গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ)’। সংক্ষেপে ‘জিরামজি’। গ্রামীণ রোজগার প্রকল্প থেকে গান্ধীর নাম সরানো হল।
এটা পরিষ্কার, গান্ধীর নাম বাদ দেওয়ায় প্রকল্পের নৈতিক উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। কারণ, এটা কেবল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটা একই সঙ্গে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের দর্শনগত বনিয়াদের উপর আঘাত। গান্ধীজি মনে করতেন, গ্রাম জাগলেই দেশ জাগবে। এজন্য একদা ভারত সরকার দেশ জুড়ে চালু করেছিল ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি প্রকল্প। সংগত কারণেই প্রকল্পটি ছিল মহাত্মা গান্ধীর নামাঙ্কিত (মনরেগা)। গত দুই দশকে ভারতে দারিদ্র্য যে কিছুটা কমেছে তার পিছনে বিরাট অবদান রয়েছে এই মনরেগার। আর সেই মনরেগায় এবার মহাত্মা গান্ধীরই নাম বাদ পড়ল।

আরও পড়ুন-প্রসবের পরই সোনালির সঙ্গে দেখা করবেন জানিয়ে দিলেন অভিষেক

মোদি সরকার মহাত্মা গান্ধীর (Mahatma Gandhi) আদর্শে বিশ্বাস করে, একথা কেউ বললে ঘোড়াতেও হাসবে। এই সরকার গ্রামীণ উন্নয়নে অনেক বেশি কাজ করেছে, এমন দাবি করলে সেটা হবে শতাব্দীর সেরা ঠাট্টা। এর মধ্যে কোন রাজ্যে কত অর্থ বরাদ্দ হবে, তা ঠিক করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকার পুরোপুরি নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। রাজ্যের প্রস্তাবের বদলে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের মাপকাঠি অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ করবে। ফলে আইনে রোজগারের নিশ্চয়তা আর থাকবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, এত দিন আইনে কাজ চাইলে কাজ দেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। গ্রামে কাজের চাহিদা অনুমান করে রাজ্য কেন্দ্রের কাছে টাকা চাইত। এখন দিল্লি থেকে অর্থ বরাদ্দ করে দেওয়া হচ্ছে। অন্য দিকে, মোদি সরকার কাজের গ্যারান্টির দিন বাড়ানোর কৃতিত্ব নিলেও রাজ্য সরকারের ঘাড়ে মজুরির খরচের শতকরা ৪০ ভাগের দায় চাপিয়ে দিচ্ছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন, প্রকল্পের নাম থেকে মহাত্মা গান্ধীর নাম মুছে ফেলা ‘লজ্জার’। তিনি বলেন, ‘আমি লজ্জিত। আমরা জাতির জনকের নামই ভুলে যাচ্ছি।’

সরকার তৈরির আগে নরেন্দ্র মোদি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন দেশকে বদলে দেবেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, মহান ভারতবর্ষের সাড়ে সর্বনাশ করেছেন জওহরলাল নেহরু থেকে মনমোহন সিং পর্যন্ত দেশের সকল প্রধানমন্ত্রী। কথা দিয়েছিলেন, তাঁর নেতৃত্বে ভারতের সমস্ত দুর্দশার অবসান হবে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর নীতি রূপায়ণের মাধ্যমে ‘অমৃতকাল’ আসবে দেশে। ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির একযুগ শাসনকাল শেষে দেখা যাচ্ছে, মোদি এবং তাঁর দোহারগণ মিলে এযাবৎ যত গাইলেন আর বাজালেন তার কিছুই পাওয়া গেল না। বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়ার এর চেয়ে চমৎকার দৃষ্টান্ত আর কেউ উপহার দিতে পারেননি।

তাই জোড়াতাপ্পি দিয়ে এখন ব্যাপারটা ম্যানেজ করার কৌশল নিয়েছে মোদি সরকার। এর একটা উত্তম পন্থা হল কিছু জনপ্রিয় পুরোনো জিনিসের নাম পালটে দেওয়া। যেমন সরকার গড়েই পূর্ববর্তী জমানার একাধিক সরকারি প্রকল্প ও কর্মসূচির নাম বদলে দিয়েছিলেন মোদি। বিশেষ করে যেসব জনমুখী প্রকল্পের গায়ে নেহরু, ইন্দিরা, রাজীব প্রমুখের নামগন্ধ ছিল, সেগুলিকে টার্গেট করা হয়েছিল সবার আগে। তারপর বদলে দেওয়া হয়েছে কিছু প্রাচীন শহর, ঐতিহাসিক স্থাপত্য, রেলস্টেশন, বন্দর, বিমানবন্দর, সংগ্রহশালা প্রভৃতিরও নাম। এ জন্য বিশেষভাবে বেছে নেওয়া হয়েছে যেখানে ইসলামি কিংবা বিদেশি পরিচয় আছে। এতদিন মহাত্মা গান্ধীর গায়ে হাত দেয়নি। গেরুয়া বাহিনীর কাছে গান্ধীজির হত্যাকারী ‘পূজনীয়’ হলেও এটুকু লোকলজ্জা সরকার ধরে রেখেছিল। কিন্তু মোদি সরকার এই পর্দাটিও সরিয়ে ফেলতে মরিয়া এবার।
মোদি সরকার গোড়া থেকেই এই প্রকল্পটির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত ছিল। বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাপে পড়ে প্রকল্পটি মোদিবাবুরা তুলে দিতে পারেননি। তবে প্রকল্পটির গুরুত্ব নানাভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার শুরু হয়েছে প্রকল্পটির নাম ‘সংস্কার’ উদ্যোগ।
কেমন সেই সংস্কার?
১) প্রকল্পটির নাম থেকে মহাত্মা গান্ধীর সংস্রব মুছে ফেলা।
২) প্রকল্পটির আর্থিক দায়িত্বও অংশত ঝেড়ে ফেলা এবং তার মাধ্যমে বিপুল বোঝা বহন করার ভার রাজ্যর কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া।
এহেন দ্বিবিধ সংস্কারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতেও বড় আঘাত হানল এই গেরুয়া মতলব। সেই সঙ্গে দেশ-বিদেশে মহাত্মার মূর্তি পুজো করলেও সরকারি কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প এবং সংশ্লিষ্ট আইন থেকে গান্ধীজির নামই মুছে দেওয়ার মতলব হাসিল হল।
এরকমভাবে নাম বদল করলে দুটি উদ্দেশ্য সাধিত হয়। এক, অন্যের জিনিসকে নিজের সৃষ্টি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। একে টুকলি বা নকল করার নয়া তরিকা বললে অত্যুক্তি হয় না। আর দুই, নতুন রূপ দেওয়ার অছিলায় নিজের আর্থিক দায়িত্ব অন্যের দায় বলে এড়িয়ে যাওয়া যায়। এই দুটো ব্যাপারে মোদি সরকারের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
গরিবের স্বার্থে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে দেশ জুড়ে এখনই এই ইস্যুতে জোরদার প্রতিরোধ-আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।
এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আন্দোলন তাৎপর্যপূর্ণ কার্যকারিতা অর্জন করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণায়। রাজ্য সরকারের তরফে কর্মশ্রী প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটার ‘কর্মশ্রী’ নাম বদলে হতে চলেছে মহাত্মাজি প্রকল্প।
বিজেপি যদি জাতির জনককে সম্মান দিতে না পারে, তাহলে সেই দায়িত্বও নাহয় স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধেই তুলে নেবেন।
জয় বাংলা।

Latest article