বড়দিনের বড় কেক

শীতকাতুরে কলকাতায় যিশুর জন্মদিনের উৎসব। তাই গরম কেকের সুবাসে ম-ম নিউ মার্কেট থেকে, হাতিবাগান, বেহালা— সর্বত্র। আমবাঙালির কাছে যিশু সন্ত নন একেবারে ঘরের প্রিয় মানুষটি। তাঁর জন্মদিনে একটুকরো কেক চাই-ই। তাই কলকাতার ঐতিহ্যবাহী, নামী কেকের ঠেকগুলোর ব্যস্ততা এখন চরমে। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ব্যস আর মাত্র ক’দিন কেকপ্রেমী বাঙালির বাঙালিয়ানায় মোড়া বড়দিন। নিউমার্কেট থেকে হাতিবাগান, গড়িয়াহাট থেকে বেহালা— কেক উৎসবে মুখর। কলকাতার নামী বড় বড় মার্কেটগুলোয় ঝিলমিলে সন্ধে, শীতকাতুরেদের নরম সোয়েটারের ফাঁকফোকরে ইতিউতি উইন্ডো শপিং। গরম ধোঁয়া-ওঠা কফি, চা, সঙ্গে নানারকম মুচমুচে তেলেভাজা, রাস্তা জুড়ে ভর্তি শীত-পোশাকের পশরা স্টোল, চাদর, শাল, জ্যাকেট, হুডি, সোয়েটার, মাফলার, গ্লাভস আর ক্রিসমাসের নানান অনুষঙ্গ। ছোট-বড়, মোটা, রোগা সান্টাবুড়োরা এসে হাজির লালটুপি, লালজামা পরে, কাঁধে লাল ঝুলি নিয়ে। সান্টার টুপি, মোজা, ইয়াব্বড়া থেকে একদম মিনি সাইজের ক্রিসমাস ট্রি, বেলস, স্টারস, রংবেরঙের রিবন, স্টিকস, গিফট বক্স, মিনিয়েচার পুতুল, স্টিকার, নানারকম আলো আর গরমাগরম কেকের সুঘ্রাণ। আলোয় আলোয় সেজে ওঠা নিউ মার্কেট, পার্ক স্ট্রিট, বো-ব্যারাক চত্বরে জোরকদমে যিশুর জন্মদিনের প্রস্তুতি। একটু একটু করে পুরনো বছরের জরাজীর্ণতা সরিয়ে, আড়মোড়া ভেঙে সেজে উঠছে তিলোত্তমা কলকাতা। পুরনো কলকাতার ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেটগুলো বয়সে যতই বুড়ো হোক না কেন এই সময় তারা একেবারে একুশের চনমনে তরতাজা যুবক! যেদিকে চোখ যায় শুধুই সেলিব্রেশনের আবহ। বাঙালির কাছে যিশু দেবতা বা সেন্ট-এর চেয়ে অনেক বেশি ঘরের লোক যাঁর জন্মদিনে দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেও কেকটা খেতেই হবে। আট থেকে আশি, মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, খাঁটি বঙ্গসন্তানেরাও এই সময় এক টুকরো কেকের জন্য চাতক পাখি। অলি, গলি পাড়ার দোকানে দোকানে রংবেরঙের কেকের বাক্স। নতুন নতুন বেকারি ভিড় জমালেও এ শহরে পুরনো কেক-পেস্ট্রির ঐতিহ্য কিছু কম নয়। পুরনো কলকাতা কেকেরই স্বর্গরাজ্য। ম-ম করা কেকের সুবাসে আমোদিত বেকারিগুলোয় অফিসফেরতা বাঙালির লম্বা লাইন আর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একেবারে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, রাত যেন খুব চেনা ছবি। এখানকার সব পুরাতনি কেকের ঠেকগুলো পুরনো চাল ভাতে বাড়ার মতো করেই বাড়ছে। তাই বড়দিন এলেই সব বাঙালির মনে হয় একবার উঁকি দিয়ে আসি। হেড অফিসের বড়বাবুরা কাজের চাপে বেরতে না পারলে অফিসের বেয়ারাকে পাঠিয়ে হলেও এই চত্বর থেকে কেক আনিয়ে নেন। দরকারে টিফিন ব্রেকে টুক করে ঢুকে পড়েন দোকানে, একটু টুকরো কেক মুখে দিয়ে বাড়ির জন্যেও ব্যাগে পুরে নেন। সমুদ্দুরের স্রোতের মতোই আপাতত বেকারিমুখী থুড়ি কেকমুখী থাকবে আমজনতা।

আরও পড়ুন-তৃণমূলের জয় ছিনিয়ে আনবেন কৃষক-মজদুর ভাইয়েরা: দোলা

গোয়ান আবেগ
কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বেকারিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল সালদানা বেকারি। এই গোয়ানিজ বেকারিটি কলকাতার কেকের গর্ব। সালদানার ইতিহাস খুঁজে নেওয়ার দরকার পড়ে না। রিপন স্ট্রিট থেকে আবদুর রহমান স্ট্রিট ধরে হেঁটে গেলেই ১৯ নম্বর বাড়িটির সামনে বড় বড় করে লেখা ‘সালদানা’। সেখানে যে না পা রেখেছে বোঝেনি কেকের আসল মাহাত্ম্য। কলকাতার একমাত্র গোয়ান বেকারি। এই বেকারি পরিবার প্রায় ৯৫ বছরের বেশি সময় ধরে ট্রাডিশনাল বেকিং-এর সাক্ষী। ঢুকলেই দেখতে পাবেন পাহাড়সমান ময়দা নিয়ে কেক-করিয়েরা কত্ত ব্যস্ত, ছিটেফোঁটা সময় নেই। অর্ডার আসছে মুহুর্মুহু আর বেকিং হয়েই চলেছে। বড়দিনের ব্যস্ততা কয়েকশো গুণ। ১৯৩০ সালে উবেলিনা সালদানা এবং তাঁর স্বামী ইগনাশিয়াস দু’জনে মিলে শুরু করেন ‘সালদানা বেকারি’।
স্বাধীনতার আগে কলকাতার রফি আহমেদ কিদোয়াই স্ট্রিটে তৈরি হয় এই কেকের কারখানা। উবেলিনার ছেলে ডেনজিল পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, চাকরি ছেড়ে পরে পারিবারিক ব্যবসাতেই জুড়ে যান। এরপর ডেনজিল আর তাঁর স্ত্রী মোনা কেক তৈরির কাজেই হাত লাগান। একটা সময় ২০-৩০ জন ফেরিওয়ালা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে এই বেকারির কেক বিক্রি করতে বেরতেন। সেই ঝুড়িতে থাকত সানলাইট বিস্কুট, লেমন টার্ট আরও কত কী! এখন আর সেসব নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কেক ব্যবসার মালিকানা গেছে পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে। ডেনজিলের মেয়ে ডেব্রা এবং তার মেয়ে আলিশা এইভাবে পরপর প্রজন্ম ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। প্রতিবছর বড়দিনের ভোরে এই সালদানা বেকারির সামনে মানুষের লম্বা লাইন পড়ে কেক নিতে। সালদানার সিগনেচার হল রিচ ফ্রুট কেক। এছাড়াও এখানকার ওয়ালনাট কেক, চকোলেট কেক, ব্রিটিশ টি টাইম কেকেরও খুব চাহিদা বিশেষ করে ক্রিসমাসের। এছাড়া আপেল টার্ট, লেমন ড্রপ, জ্যাম কুকি, কাপকেক, হার্ট কেক, ফ্রেঞ্চ ম্যাকরুন, অপেরা কেক , চকোলেট বোট, মেরিংগুজ, চিজ কেক, চিজ পাফ, চিকেন প্যাটিস, চকোলেট পেস্ট্রি, কোকোনাট মাকরুন, ফ্রেঞ্চ ম্যাকরুন, ক্রিম রোল, চিকেন এনভেলপ, স্যান্ডুইচ, গার্লিক ব্রেড— রয়েছে অনেক কিছু। সালদানার কেক ছাড়া বড়দিনের আনন্দ অনেকটাই মাটি।

আরও পড়ুন-সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে বরাদ্দ ৮.৮২ কোটি

কেকের কৌলিন্যে
নিউ মার্কেট চত্বরেই রয়েছে আরও একটি বিখ্যাত বেকারি নাহুম’স। নাহুম’সের সুগন্ধ নিয়েই বড়দিন পেরিয়ে নতুন বছরে পা রাখেন বাঙালিরা। নাহুম’স বাঙালির বড়দিনের এক বড় নস্টালজিয়া। শতাব্দীপ্রাচীন ইহুদি পরিবার পরিচালিত এই বেকারি তারকা, নেতা মন্ত্রী থেকে সাধারণ সবার পছন্দের। মালিক থাকেন সুদূর ইজরায়েলে তা সত্ত্বেও বড়দিনে এসে হাজির হন কলকাতায়। নিজে তদারক করেন এবং সামলান ভিড়, ব্যস্ততা। ১৯০২ সালে এই বেকারির যাত্রা শুরু হয়েছিল। নাহুম ইজরায়েল মরদেকাই তখন কেক তৈরি করে বাড়ি বাড়ি ফেরি করতেন। ১৯১৬ সালে হগ মার্কেটে ‘নাহুম’স অ্যান্ড সন্স’ নামে দোকান চালু করলেন। শতাব্দীপ্রাচীন এই দোকান হগ মার্কেট অর্থাৎ পুরনো নিউ মার্কেটের অনেক সুখ-দুঃখ, ওঠানামার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। বংশপরম্পরায় নাহুম’স পরিবার এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। নাগরিক কলকাতার স্বাদ-সংস্কৃতি আর ইহুদি ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার হয়েছে এখানে। এখানকার কাচের বারকোশে রাখা রিচ ফ্রুট কেক, প্লাম কেক, লাইট ফ্রুট কেক, প্লেন কেক, হানি লাইট প্লাম কেক, মার্জিপন, মার্জিপন ফাজ, ব্রাউনি, ম্যাকরুন, চিজ কেক, চিজ পাফ, কুকিজ, প্লাম পুডিং, আপেল পাই, টার্ট, পেস্ট্রির সুঘ্রাণে বুঁদ হয়ে থাকে বাঙালি। কলকাতায় নাহুম’স না থাকলে বাঙালির কেক নিয়ে নাক উঁচুপনা থাকত কি? এই প্রশ্নটা বাঙালিই বলতে পারবেন।
ফাইনেস্ট বেকারি
নাহুম’স, সালদানা বেকারির পাশাপাশি আরও একটি বেকারির প্রতি বাঙালির খুব টান সেটা হল নিউ মার্কেটের দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্নের ‘দ্য বেকারি’। কলকাতার ‘ফাইনেস্ট বেকারি’ও বলা হয় একে। দেড়শো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে বেকারিটির আজও বয়ে নিয়ে চলেছে কলকাতার ঐতিহ্য। ১৮৪০-৪১ সালে ডেভিড উইলসনের হাত ধরে পথচলা শুরু হয়েছিল আজকের দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলটির। শুরুতে নাম ছিল উইলসন হোটেল। লোকের মুখে হয়েছিল অকশন হোটেল। পরে এই হোটেল পরিচিতি পায় গ্রেট ইস্টার্ন নামে। বড়দিনে লম্বা লাইন তো পড়েই, বছরভরও কেকপ্রেমী ক্রেতার অভাব হয় না। এখানকার ফ্রুট কেক, প্লাম কেক, ডান্ডি কেক সবার খুব পছন্দের। সবধরনের মানুষদের কথা ভেবে এখানে ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা এবং ৮০০ টাকা পর্যন্ত দামের কেক পাওয়া যায়।
গরম ধোঁয়া-ওঠা কেক
নিউ মার্কেটে খুব পরিচিত পথচলতি দুটো বেকারি হল ইম্পিরিয়াল এবং মল্লিক বেকারি। ফ্রুট কেক, প্লেন কেক, বাটার প্লেন কেক, চিজ পাফ, রোজ কুকিজ, কোকোনাট কুকিজ, ভেজ আর চিকেনের গরম প্যাটিস এখানে বিখ্যাত। সবচেয়ে আকর্ষণের হল গরম কেক। চাইলে আপনি পেয়ে যাবেন সদ্য তৈরি হয়ে আসা গরমাগরম ফ্রুট কেক, প্লেন কেক যা দামে সস্তা এবং খেতেও দাম অনুযায়ী পারফেক্ট।
মনপসন্দ কেক
১৯৯২ সাল। দেশ জুড়ে এক অস্থির পরিস্থিতি। ঠিক সেই সময় দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুরপুকুর অঞ্চলে একটি বেকারি খুললেন শেখ আব্দুল হান্নান। নাম দিলেন ‘কারকো বেকারি’। বাকি বেকারিগুলোর থেকে এই বেকারিটা একটু আলাদা। কারকোর ওভেন চালু হয় মাত্র ৭-৮ দিনের জন্য। ডিসেম্বরের ১৫, ১৬ তারিখ থেকে বড়দিনের আগের দিন অর্থাৎ ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আগে সারা বছর চলত বেকারিটি কিন্তু এখন তা হয় না। সারাবছর বন্ধই থাকে। শুধু বড়দিনের আগে থেকে ২০ জন শ্রমিক নিয়ে আব্দুল হান্নান ও সালাউদ্দিন মল্লিক এই বেকারির দরজা খোলেন। এই কয়েকদিনেই যেন গোটা এলাকার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজনের জন্য উৎসবের আবহ তৈরি হয়। এলাকায় মানুষ প্রতি বছর বড়দিনের সময় আসেন এই বেকারিতে। নিজের পছন্দের রেসিপি অনুযায়ী সরঞ্জাম এনে মনের মতো করে মনপসন্দ কেক বেক করে নিয়ে যান। ফলে উৎকৃষ্টমানের কেক তৈরি হয়।

আরও পড়ুন-৩ কোটি ৯৩ লক্ষে গড়ে উঠবে দমকল কেন্দ্র

অ্যাংলো পাড়ায় কেকের ঠেকে
কেক উৎসবে কেক কিনতে ধস্তাধস্তি, মারামারি, ঘোরাঘুরি আর কেক কেনাকিনি পর্ব যেখানে গিয়ে শেষ হয় সেই বো ব্যারাকের বড়দিন উৎসব আর কেকের ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা না করলে কেকের গল্প বলাই বৃথা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলে আমেরিকান সেনাদের বসবাস ছিল লাল সুরকির বাড়িগুলোয়, ছিলেন ব্রিটিশ সেনারাও। শতাব্দী-প্রাচীন লাল ইটের তৈরি সেই বাড়িই হল ব্যারাক। ব্রিটিশ এবং মার্কিন সেনারা কবেই চলে গেছে কিন্তু রয়ে গেছে তাঁদের অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্বের ধারক হয়ে উঠেছেন সেখানকার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বাসিন্দারা। সেই বো ব্যারাকে আপাতত ১৪০টি অ্যাংলো পরিবার থাকেন। আগে এখানে সকলেই ক্রিসমাসের ট্রাডিশনাল ওয়াইন বানাতেন এখন কমতে কমতে মাত্র আটটা পরিবার ওয়াইন বানান। সেই হ্যান্ডমেড ওয়াইন কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন ক্রেতারা। বাড়িতে বানানো সেই লাল আঙুরের ওয়াইন আর ছানার কেক-এর বো ব্যারাকের সবচেয়ে কাটতি। পুরনো কলকাতাকে ভালবেসে সান্টা ক্লজ আজও এখানে আসেন টানা রিকশায় চড়ে। অ্যাংলো পরিবারগুলো নিজের হাতে তৈরি করেন ওয়াইন কেক, রাম কেক, ফ্রুট কেক— সব। ২৫ ডিসেম্বরের কয়েকদিন আগে গেলেই দেখা মিলবে সেই পুরনো ছবিই। বড়দিনের ব্যস্ততা তুঙ্গে। কারও কথা বলার ফুরসত নেই। এখানকার বিখ্যাত বেকারি হল জে এন বড়ুয়া। ব্রিটিশ আমলের এই বেকারি ঔপনিবেশিক কলকাতার শিকড়। স্থানীয়দের কাছে বড়ুয়া’র বেকারি মন্টু দা’স কেক শপ নামে পরিচিত। প্রায় আশি বছরের বেশি সময় ধরে মন্টু, তাঁর স্ত্রী, ছেলে এবং ভাই রতন বড়ুয়া মিলে এই বেকারি ব্যবসা চালিয়ে এসছেন। বর্তমানে রতন বড়ুয়াই এটা চালান। মন্টু এবং রতন বড়ুয়ার বাবা যতীন্দ্রনাথ বড়ুয়া প্রথম এই বেকারি ব্যবসা শুরু করেন। ফ্লাইং কাস্টমার তো আছেনই কিন্তু বড়ুয়ার কেকের একটা নিজস্ব ক্লাইন্টেলও আছে যাঁরা ঝড়-জল পেরিয়ে হলেও কেকের গন্ধে ডিসেম্বরে ঠিক হাজির হন এখানে। ফ্রুট কেক, প্লাম কেক সবই থাকে তবে বড়ুয়ার ছানাপোড়া কেক নস্টালজিয়া।

Latest article