নতুন বইয়ের গন্ধ

আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা শুরু হতে আর মাত্র একমাস বাকি। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে বেশকিছু নতুন বই। ভিন্ন স্বাদের তিনটি বইয়ের উপর আলোকপাত করলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

প্রাপ্তবয়স্ক ২টি ভয়ঙ্কর অপার্থিব উপন্যাস এবং ৬টি বিচিত্রস্বাদের গল্প নিয়ে পত্রভারতী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নতুন বই ‘ছায়া কায়া মুখোমুখি’। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে রোমাঞ্চ, ভয়। প্রথম লেখা ‘ছায়া কায়া মুখোমুখি’। নির্মেদ, টানটান উপন্যাস। জ্যোৎস্নালোকিত সন্ধের বর্ণনা দিয়ে শুরু। বোনা হয়েছে অবিশ্বাস্য ঘটনার ইঙ্গিত। রহস্যের বেড়াজাল ভেদ করে কাহিনি এগিয়েছে ধীরে ধীরে। বাঁকে বাঁকে জেগেছে শিহরন। রক্ত জল হয়ে যায় বুড়ির বর্ণনায়— ‘মুখটায় রক্তমাংস নেই, করোটির উপর শুধু চামড়া। কোদালের মতো দাঁতের সারি। চোখের মণি নেই। কোটরে লাল আলো দপদপ করছে।’ ভয়ের পাশাপাশি রয়েছে প্রেতাত্মার দয়ামায়ার উল্লেখ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সুতোয় বাঁধা পড়েছে বুলু, কুন্তী, হারু প্রভৃতি চরিত্রগুলো। ছায়া কায়া মুখোমুখি হওয়ামাত্র বিপরীত স্রোতে বয়ে গেছে হাওয়া। ছড়িয়েছে মনকেমনিয়া সুর। অশরীরী-কাহিনি কোনও এক মন্ত্রবলে হয়ে উঠেছে তুমুল শরীরী-কাহিনি।

আরও পড়ুন-তৃণমূলের জয় ছিনিয়ে আনবেন কৃষক-মজদুর ভাইয়েরা: দোলা

অণু-উপন্যাস ‘জ্যোৎস্নারাতে আসে…’। কে আসে? জানার জন্য এগোতে হয় কাহিনির আঁকাবাঁকা পথ ধরে। শুরুতেই ডুয়ার্সের চমৎকার বর্ণনা—‘গহন জঙ্গল, রাস্তার উপর ডালপালা মেলেছে গাছেরা। জিপসি ছুটছে। জনপ্রাণী কম। আকাশের গায়ে ফুটে উঠেছে নীল পাহাড়ের সারি।’ বেশকিছু চরিত্রের উপস্থিতি। আলো পড়েছে অহর্ষি-নন্দিনীর উপর। অতীত জীবনে সামনে দাঁড়িয়েছে তাঁদের। তবে সামনে চলার পথ মসৃণ নয়। ঝড়ের মতো হাওয়া ওঠে। বিকট গর্জন। এখানে বর্ণিত হয়েছে এক কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তির অমানবিক হয়ে ওঠার অলৌকিক কাহিনি। পড়তে পড়তে হাড় হিম হয়ে যায়।
‘নাকের ডগার উপর লম্বা দাগ’, ‘পায় না ঠিকানা’, ‘নিয়ান্ডারথাল’, ‘একসেস ব্যাগেজ’, ‘কথার খেলাপ করি না’, ‘ভাঙা পথের রাঙা ধূলায়’ গল্পগুলোও রোমাঞ্চকর। সবমিলিয়ে দারুণ বই। প্রচ্ছদশিল্পী অস্মিক বিশ্বাস। দাম ৩০০ টাকা।

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবাশিস পাঠকের বই ‘জগন্নাথ রহস্য’। কাহিনিতে তিনটি স্তর বর্তমান। প্রথমত, কাহিনিটি মৃত্যুতে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করতে দিচ্ছে না। নবকলেবর গড়ে আবার মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চারের কথা বলেছে। দ্বিতীয়ত, মূর্তিতে অন্য কিছু নয়, বৃক্ষপ্রাণ সঞ্চারিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, বিশ্বকর্মার তৈরি তথাকথিত ‘অসমাপ্ত’ ত্রিমূর্তিতে আদিম দেবতাসুলভ রূপটি প্রকট। ‘টোটেম পোল’-এর মতো হস্তপদহীন একখণ্ড কাঠের মধ্যে মুখচোখ আঁকা। এই ত্রিস্তরীয় আখ্যান থেকেই জগন্নাথকেন্দ্রিক তাবৎ রহস্যের শুরু।
শ্রীক্ষেত্র পুরীধাম। তিন বিনে গতি নেই। এখানে নিরন্তর চলছে তিনের জাদু। একদা আশ্রম ছিল তিন মুণির। ভৃগু, অত্রি, মার্কণ্ডেয়র। কালান্তরে সেখানে এলেন শঙ্করাচার্য। একদিন তিনি ‘সমুদ্রস্নান সেরে মন্দিরের দিকে মুখ করে হাতের তালু দুটো জুড়লেন প্রণামের ভঙ্গিতে। তাঁর কণ্ঠ থেকে উদগত হল প্রণাম মন্ত্র স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। স্নানসিদ্ধ শরীর-মনকে দিল অর্চনার অভিজ্ঞান।’ এগিয়ে চললেন শঙ্করাচার্য। মন্দিরের দিকে। দেখলেন গর্ভগৃহে রত্নবেদি শূন্য। সেখানে দেবমূর্তি নেই। কোথায় গেল? ঘনীভূত হল রহস্য। ব্যসদেব বলেছিলেন জগন্নাথকে কলুষমুক্ত করার কথা। সেই কাজে ব্রতী হয়েছেন শঙ্করাচার্য। খুঁজতে থাকেন। খুঁজতেই থাকেন। কাহিনি এগোয় আগামীর দিকে। মাঝেমধ্যেই উঁকি দেয় অতীত। মুছতে থাকে অন্ধকার। ধীরে ধীরে ফোটে আলো।

আরও পড়ুন-বাংলাকে নিয়ে বিজেপির কুৎসা খতিয়ান তুলে পর্দাফাঁস তৃণমূলের

এটা কোনও রহস্য উপন্যাস নয়, অথচ এর পাতায় পাতায় রয়েছে রোমাঞ্চকর তথ্য। মিথ-মিথ্যের কল্পিত কাহিনি নয়, পুরাণ-ইতিহাস-আধ্যাত্মবিজ্ঞানের আলোয় সবকিছুর বিশ্লেষণ। স্বচ্ছতা বজায় রেখে বুনে দেওয়া হয়েছে অজানা, অনালোকিত ঘটনা। তবে কাহিনি তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত হয় না। স্বাভাবিকভাবেই এসেছে মহাপ্রভুর উপস্থিতি। বিস্ময় জাগিয়ে এসেছেন গুরুনানক, গৌতম বুদ্ধও। গদ্যের গতি অত্যন্ত সাবলীল। সুন্দর। নদীর মতো। হোঁচট খেতে হয় না কোথাও। ১১ অধ্যায়ের এই কাহিনি বদ্ধমূল ধারণার বদল ঘটায়। প্রচ্ছদশিল্পী ধীমান বন্দ্যোপাধ্যায়। দাম ৩০০ টাকা।

উল্লাসকর দত্ত ছিলেন বিপ্লবী। বারীন্দ্র ঘোষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। অনুশীলন সমিতি এবং বাংলার যুগান্তরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হেমচন্দ্র কানুনগো প্যারিস থেকে রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং বিস্ফোরক রসায়ন শিখে ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি ছিলেন যুগান্তর দলের প্রধান বোমা প্রস্তুতকারক। কেমিস্ট্রির কৃতী ছাত্র। শুধুমাত্র শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের লাইব্রেরি থেকে ডায়নামাইট বোমা সম্পর্কিত বই পড়ে বোমা বানাতে শিখেছিলেন। উল্লাসকর এবং হেমচন্দ্র দাসের তৈরি বোমা ব্যবহার করে কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। পুলিশ উল্লাসকর দত্ত, বারীন্দ্র ঘোষ এবং ক্ষুদিরাম-সহ যুগান্তর দলের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
উল্লাসকরের জীবন কেবল এক সশস্ত্র সংগ্রামী অধ্যায় নয়, এক গভীর মানবিক চমকপ্রদ উপাখ্যান। বিপ্লবীর অগ্নিময় সত্তার সমান্তরালে তিনি ছিলেন এক আপনভোলা শিল্পী। এক নরম অথচ দৃঢ়প্রাণ খাঁটি মানুষ। দেশপ্রেম তাঁর কাছে ছিল সাধনা, যা কোনও ব্যক্তিপ্রেম বা আত্মচিন্তার ঊর্ধ্বে।
তাঁকে নিয়ে দেবারতি মুখোপাধ্যায়ে লিখেছেন অনবদ্য একটি বই ‘উল্লাসকর: বোমা বিপ্লব প্রেম ও দেশভাগের মহাকাব্য ১’ । প্রকাশিত হয়েছে দীপ প্রকাশন থেকে।
বিপ্লবী উল্লাসকরের চরিত্রে ছিল বৈপরীত্য। কাঠিন্য এবং কোমলের অদ্ভুত সহাবস্থান। বিপ্লবী জীবনের পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বইয়ে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। প্রেক্ষাপট বাংলা এবং অসম। এসেছে বেশকিছু বাস্তব চরিত্র। বলা যায়, এই কাহিনি একটা বিশেষ সময়ের দলিল। অনুভব করা যায় উত্তাল ঢেউ। কিছু কিছু অংশ পড়তে পড়তে রোমাঞ্চ জাগে। গরম হয়ে ওঠে রক্ত। জন্ম নেয় দেশাত্মবোধ। সবমিলিয়ে অনবদ্য এক উপাখ্যান। প্রচ্ছদশিল্পী স্বর্ণাভ বেরা। দাম ৪৭৭ টাকা।

Latest article