ফোনে মাত্র ১৫ মিনিটের ভাষণ। তাতেই অন্তরে লালিত প্রত্যাশা পরিণত হল হতাশায়! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এলেই পূরণ হবে যাবতীয় প্রত্যাশা, মিলবে ভারতীয় নাগরিকত্ব, নাম উঠবে ভোটার তালিকায়—গত কয়েকমাস ধরে যে ঢাক বাজাচ্ছিল বঙ্গ বিজেপি, তা ফেটে গেল! আশাভঙ্গ হল মতুয়াদেরও। কলকাতা বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ থেকে যে ভাষণ তাহেরপুরের জমায়েতকে শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, তাতে এসআইআর পর্বে মতুয়াদের আতঙ্ক কমানোর কোনও নিদান ছিল না। শনিবার ভোর থেকে প্রত্যাশার ঝাঁপি নিয়ে বসে থাকা মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ কেবল শুনলেন প্রধানমন্ত্রী উচ্চারিত—‘জয় নিতাই’, ‘জয় হরিচাঁদ ঠাকুর’, ‘জয় গুরুচাঁদ ঠাকুর’ এবং ‘জয় বড়মা’! নাগরিকত্ব নিয়ে একটি শব্দও সেই ভাষণে ছিল না।
২ লক্ষ কোটি টাকা বকেয়ার বিষয়ে মুখে কুলুপ আঁটলেও তিনি জানান, তাঁরা ক্ষমতায় এলে বাংলার জন্য অর্থ ও প্রকল্পের কোনও অভাব হবে না। সব শুনে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে বাড়ি ফিরে যান মোদি-ভক্তরা। তবে মতুয়ারা ফিরেছেন থমথমে মুখে, শূন্য হাতে।
আর এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, ‘জয় নিতাই’ উচ্চারণে কার জয়ধ্বনি করা হচ্ছে, সেটা ঋষি বঙ্কিম চন্দ্রকে ‘বঙ্কিমদা’ সম্বোধন করা প্রধানমন্ত্রী জানেন কি? জানলে কি নিতাইয়ের নামে তিনি জয়ধ্বনি দিতে পারতেন? ‘জয় নিতাই’ উচ্চারণ কি তাঁর গলায় শোভা পায়?
নদিয়ার পবিত্র মাটি স্মরণ করে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মোদি যাঁর নামে জয়ধ্বনি দিলেন তিনি গৌরাঙ্গ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নন, তিনি নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। এটা কি নরেন্দ্র মোদি জানেন?
উনি কি জানেন, ওঁকে কি ওঁর বঙ্গীয় সহচররা কদাচ বলেছেন, এই হলেন সেই নিত্যানন্দ মহাপ্রভু, যিনি গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যকে সুস্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন, “সকলি কর তুমি। তুমি যন্ত্রী হও, যন্ত্রতুল্য হই আমি।”গৌরাঙ্গের আজ্ঞায় তিনি আপন জীবনের গতিপথ স্থির করতে ইতস্তত করেননি। সম্ভবত নরেন্দ্র মোদি এতসব জানেন না। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে যিনি নিত্যানন্দ মহাপ্রভুকে গুলিয়ে ফেলেন, তিনি কীভাবে জানবেন, ধর্মীয় গণ্ডিতে দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের যেমন বলরাম, কলিযুগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর তেমনই নিত্যানন্দ। মহাপ্রভুর নির্দেশ মেনে তিনি বাংলার বুকে কৃষ্ণনাম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে গৌরনাম কীর্তন, গৌরবিগ্রহ পূজন এবং গৌরচরিত গ্রন্থ প্রণয়নে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। বাংলার নিম্নবর্গীয় মানুষের মধ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের যে বিস্তার, তার বীজ চৈতন্য রেনেসাঁসে নিহিত ছিল, সত্যি। কিন্তু নিত্যানন্দ প্রভুই এই ভাবান্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন। চৈতন্যের বীজতলায় তিনিই মূল কৃষক।
আরও পড়ুন-অবাক কাণ্ড! ৩ দিনেই অনুমোদন পেয়ে গেল বিতর্কিত রামজি বিল
টোটাল পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক যে প্রধানমন্ত্রী, তাঁর কাছ থেকে তো এত জ্ঞান প্রত্যাশা করা যায় না!
ভিড় পাতলা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় যিনি শেষ পর্যন্ত তাহেরপুরে পৌঁছাতে চাননি, তিনি কি জানেন, ১৪৪৩ শকাব্দ বা ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দের রথযাত্রার পর মহাপ্রভুর নির্দেশ মেনেই নিত্যানন্দ প্রভু আর নীলাচলমুখো হননি?
গৌড়বঙ্গে এসে নিত্যানন্দ প্রথমে এলেন পানিহাটিতে। ‘পণ্যহট্ট’ বা জিনিসপত্রের হাট, তার থেকে পানিহাটি। বর্ধমানের কাটোয়া, দাঁইহাট, কালনা, ওদিকে হুগলির চুঁচুড়া, ফরাসডাঙা, সপ্তগ্রাম, ওপাশে মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত—বঙ্গদেশের তাবৎ বাণিজ্যস্থল থেকে বড় বড় মহাজনি নৌকা এসে ভিড়ত পানিহাটির ঘাটে। যশোহরের বিখ্যাত পেনেটি ধান যেত দেশের নানা প্রান্তে, এখান থেকেই। এহেন পণ্যহট্টকে পুণ্যহট্টে পরিণত করতে পানিহাটিতে ঘাঁটি গেড়েছিলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভু। পানিহাটিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের দুর্গ তখন রাঘব পণ্ডিতের বাড়ি। সেখানে নিত্যানন্দের কণ্ঠে কীর্তন শোনার আকর্ষণে দলে দলে লোকে ভিড় করতে আরম্ভ করল। এমনকী হুগলির ত্রিবেণী থেকেও লোকে আসত পানিহাটিতে, রাঘব পণ্ডিতের বাড়িতে, স্রেফ নিত্যানন্দের সংকীর্তনের আসরে যোগ দেবে বলে। মানুষজন অবাক হয়ে দেখত, ঘরে ঘরে যাচ্ছেন নিত্যানন্দ। দাঁতে ধরে আছেন ঘাস। আর সকাতরে জানাচ্ছেন মিনতি, “আমারে কিনিয়া লও ভজ গৌরহরি”। বলছেন আর পরক্ষণেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। দেখে মনে হয় ‘রজত-পর্বত যেন ধূলায় লোটায়’।
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি জাতপাতের রাজনীতি করে। দলিত পেটানোর রাজনীতি করে। আর ‘জয় নিতাই’ স্লোগানের নিতাই সপ্তগ্রামের জাতিচ্যুত সোনার বেনে দিবাকর দত্তকে সামনে রেখে সুবর্ণ বণিকদের হিন্দু সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বল্লাল সেন সুবর্ণ বণিকদের শূদ্রত্বে পতিত করেন। আর সেই সুবর্ণ বণিক সম্প্রদায়ের সন্তান, ‘ভক্তোত্তম’ উদ্ধারণের হাতে ছাড়া অন্য কারও হাতে রান্না করা খাবার নিত্যানন্দ মুখে তুলতেন না।
নরেন্দ্র মোদি জানেন বাংলার সেই সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাস? না জানলে, কোন মুখে তিনি নাটক করতে ‘জয় নিতাই’ ধ্বনি দিচ্ছেন?
স্ত্রী পরিত্যাগকারী নরেন্দ্র মোদি কি জানেন, অবধূত নিত্যানন্দকে বিয়ে করতে বলেছিলেন স্বয়ং শ্রীচৈতন্য? বুঝিয়ে ছিলেন নিত্যানন্দও যদি গৃহস্থ ধর্মের বদলে মুনিধর্ম আঁকড়ে থাকেন, তাহলে নীচ, পতিত, অশিক্ষিত, সংস্কার গ্রস্ত, মূর্খ মানুষেরাও ভাববে মুনিধর্ম অবলম্বন না করলে উদ্ধার লাভ অসম্ভব। প্রকৃত বৈষ্ণব হতে গেলে মুনিধর্ম, সন্ন্যাস জীবন বাছতেই হবে। এই ধারণা যদি একবার দৃঢ়মূল হয়ে গেঁথে যায় আমজনতার মধ্যে, তাহলে তো জগৎ সংসারে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার প্রচার দুরূহ হয়ে উঠবে। সেজন্যই প্রভু নিত্যানন্দের উদ্দেশ্যে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের সুস্পষ্ট নির্দেশ,
তুমিও থাকিলা যদি মুনিধর্ম করি।
আপন উদ্দামভাব সব পরিহরি।।
তবে মূর্খ-নীচ যত পতিত সংসার।
বোল দেখি আর কেবা করিবে উদ্ধার।।
তাই, তাই-ই, নিত্যানন্দকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে প্রকারান্তরে বাধ্য করেছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু স্বয়ং।
মোদির বিজেপি আমিষ ভক্ষণকারীদের পেটানো পছন্দ করেন। তাঁদের অনুপ্রবেশকারী তকমা দেন। অথচ, নিত্যানন্দ মাছ-মাংস খেতেন। এবং পেটপুরে খেতেন। আর এই নিত্যানন্দ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ড. ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘বৈষ্ণব সাহিত্যে সমাজতত্ত্ব’ বিষয়ক বইতে লিখেছেন, “নিত্যানন্দ সর্ব বিষয়ে সংস্কারক ছিলেন”।
গৌর-নিতাইয়ের নিতাই জাহ্নবা দেবীকে দ্বিতীয় পত্নী রূপে বিবাহ করার সূত্রে পথ পরিষ্কার হয়েছিল পরবর্তী সমাজ বিপ্লবের। যে বিপ্লবের ভাবনা হয়তো শ্রী চৈতন্যের কল্পনাতেও ছিল না। জাহ্নবা দেবীর সূত্রেই বাংলায় বৈষ্ণবদের মধ্যে নারীশিক্ষা বিস্তারলাভ করেছিল। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের বাতাস এসেছিল নিত্যানন্দজায়া জাহ্নবার সূত্রেই।
এসব যিনি জানেন না, ‘জয় নিতাই’ উচ্চারণের গৌরব তাঁকে ছোঁবে কোন আক্কেলে!

