ভারততীর্থকে স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস করার চেষ্টা ব্যর্থ করুন

বিজেপি-শাসিত রাজ্যে রাজ্যে তাণ্ডব চালাচ্ছে গেরুয়া দানবরা। নষ্ট স্বপ্ন হয়ে উঠছে আমাদের ভারত তীর্থ। লিখছেন অনির্বাণ সাহা

Must read

পৌত্তলিক ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের যিশু কোলে মাদার মেরির মূর্তির মধ্যে কবি ঈশ্বর গুপ্ত দেখতে পেয়েছিলেন যশোদাদুলাল শ্রীকৃষ্ণকে। মেরি এবং যশোদার মহিমাকে তিনি যথাক্রমে বিদেশ ও স্বদেশের ব্রহ্ম বলে ঠাওরানোর পাশাপাশি লিখেছিলেন, ‘দিশী কৃষ্ণ রিষি কৃষ্ণ এ দেশ ও দেশ।/উভয়ের কার্য আছে বিশেষ বিশেষ।।’
পর্তুগালের ফিরিঙ্গি কবি এন্টনির কণ্ঠে—‘খৃস্টে আর কৃস্টে কিছু তফাত নাই রে ভাই।’

আরও পড়ুন-বড়দিনে লাখো মানুষ দিঘায়

সকল তফাৎকে অনায়াসে তফাতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারতেন যিনি, সেই ‘চির-বিদ্রোহী’ কবি নজরুল মানবপ্রেমিক খ্রিস্টকে সরাসরি প্রশ্ন করেছেন— ‘পচে মরে হায় মানুষ, হায় রে পঁচিশে ডিসেম্বর!/কত সম্মান দিতেছে প্রেমিক খ্রিস্টে ধরার নর!/ধরেছিলে কোলে ভীরু মানুষের প্রতীক কি মেষশিশু?/আজ মানুষের দুর্গতি দেখে কোথায় কাঁদিছ জিশু!’
আবার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পথশিশুর মধ্যে সাক্ষাৎ যিশুকে খুঁজে পেয়েছেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে, সাহিত্যিক রামরাম বসু যা লিখেছিলেন সেটা, সেই যিশুমহিমা বাংলার বিবিধের মাঝে এক মহাসম্মিলনকেই উন্মোচিত করে— ‘হেদে খ্রীস্ট য়িশু মুকতিদ/য়িশু খ্রীস্ট মুক্তিদাতা হে।’
এটাই বাংলা। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল ভারত তীর্থেরও।

আরও পড়ুন-জমজমাট অযোধ্যা পাহাড়

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।’ তাঁর কাছে ‘ভারততীর্থ’ এমন এক ভূমি যা বহুকিছুর মহামিলনক্ষেত্র। জীবনের ধর্ম হল প্রবহমানতা। যে-নদী স্রোতোধারা হারিয়ে ফেলে সে আসলে মরুপথ বা মৃত্যুপথ যাত্রী। অমৃতসুধায় সিক্ত জীবন সবসময়ই বহুত্বের সাধক। ভারত সেই বিরল সৌন্দর্যের অধিকারী— যে-দেশ বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও নানা সংস্কৃতির এক ঐক্যকেন্দ্র। ভারতের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি প্রদেশ, প্রতিটি ধর্ম এবং প্রতিটি সংস্কৃতি অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ। তাদের মধ্যে কোনও একটি বা দুটিকে ছোট বা বড় বিচার করতে চাওয়া মূর্খামি। বরং প্রত্যেকের সেরাটির আদান-প্রদানই কাম্য। সেটাই ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’র মহান চেতনা। এই মুক্তচিন্তা অন্যের খাদ্যগ্রহণ, পোশাক, সাজসজ্জা, শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতিচর্চার উপর হস্তক্ষেপ করার কথা ভাবে না। প্রত্যেকে তার পছন্দ অনুযায়ী চলবে, অন্যরাও তার আনন্দের শরিক হতে পারে স্বচ্ছন্দে। এক প্রতিবেশীর আনন্দে আর এক প্রতিবেশীর অংশগ্রহণ, যেকোনও উৎসবের আনন্দকে বর্ধিত করে। সেই উৎসব সংকীর্ণ গলি পেরিয়ে সর্বজনীন রূপ নিতে পারে অনায়াসে।

আরও পড়ুন-সাহিত্য অ্যাকাডেমিতে ক্ষমতা কায়েমের চেষ্টা বিজেপির, কড়া নিন্দায় শিক্ষামন্ত্রী

ভারতের সংবিধানও এই চিন্তাকে স্বাগত জানিয়েছে। বহুত্বের সাধনায় সামান্যতম বাধাকে কোনওরকম অনুমোদন করে না আমাদের দেশের সংবিধান, আইন ও আদালত। তবুও কোনও কোনও রাজনৈতিক দল এসবের তোয়াক্কা করে না। তারা কোন সংকীর্ণ এবং বস্তাপচা চিন্তার দ্বারা চালিত, তা তাদের আচরণে স্পষ্ট হয়ে যায়। এই সংকীর্ণ রাজনীতির চর্চায় গোবলয় বা উত্তর ভারতের কোনও কোনও অঞ্চল একসময় চ্যাম্পিয়ন ছিল। এজন্য অহিন্দু জনগোষ্ঠীকে নানাসময়ে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। রাজ্য পর্যায়ে এমনই সংকীর্ণ রাজনীতিতে হাত পাকিয়ে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ জাতীয় রাজনীতির অঙ্গনে পা রেখেছেন। মোদিই এখন ‘ভারতেশ্বর’। তিনি দেশের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে সংকীর্ণ রাজনীতি, বিভেদ-বিদ্বেষের রাজনীতিতে যে বিশেষ গতিসঞ্চার হয়েছে তা গোপন কিছু নয়। মোদিযুগে অহিন্দুদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, উপাসনার পন্থা প্রভৃতি বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যেমন এবার গীতা পাঠের ব্রিগেডে হিন্দুত্ববাদীরা কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিরাট ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে আমিষ প্যাটিস বিক্রির ‘অপরাধে’ পদ্ম শিবিরের সমর্থকদের হাতে মার খেতে হয়েছিল এক ব্যক্তিকে। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুঙ্গে উঠেছিল রাজনৈতিক তরজা। এবার প্রায় একইরকম ঘটনার সাক্ষী থাকল বিজেপি-শাসতি ওড়িশা। ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ সান্তা ক্লজের টুপি বিক্রি করা চলবে না। এমনই ফতোয়া জারি করা হয় গরিব হকারদের উদ্দেশে। এমনকি, স্বঘোষিত হিন্দুত্ববাদীরা তাদের হেনস্থাও করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনার ভিডিয়ো ভাইরালও হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বড়দিন উপলক্ষ্যে রাস্তার ধারে সান্তা ক্লজের টুপি বেচছিলেন কয়েকজন হকার। আচমকা দুই যুবক গাড়ি চেপে হাজির হয় সেখানে। হকারদের দেখামাত্র হুমকির সুরে তারা বলে ওঠে, ‘এরাজ্য এখন হিন্দুরাষ্ট্র। এখানে খ্রিস্টানদের জিনিসপত্র বিক্রি করা যাবে না।’ এরপরই ওই দুই যুবক যাচাই করে টুপি বিক্রেতারা হিন্দু কি না এবং তাঁরা কোথাকার লোক। উত্তরে হকাররা জানান, তাঁরাও হিন্দু। পেটের দায়ে বড়দিন উপলক্ষ্যে সান্তা ক্লজের টুপি বেচছেন। তখনই ওই হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদের মধ্যে থেকে একজন বলে, ‘এখানে শুধুমাত্র প্রভু জগন্নাথের শাসন চলে। হিন্দু হয়ে তোমরা এই কাজ করছ কীভাবে? এখনই পাততাড়ি গোটাও। নিতান্ত বেচতেই হলে প্রভু জগন্নাথের সামগ্রী বিক্রি কর।’ রাজস্থানি হকারদের সাফ বলে দেওয়া হয়, খ্রিস্টান সংস্কৃতির কোনও সামগ্রী এখানে বেচাকেনা বরদাস্ত করা হবে না।
এখানেই শেষ নয়। ওড়িশার গঞ্জাম জেলায় শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্য মুর্শিদাবাদের ডোমকলের সাগরপাড়া থানার হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের চার পরিযায়ী শ্রমিককে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। তাঁদের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করা হয়। চার জনকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত বলে অপবাদ দিয়ে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নিগ্রহ করা হয়। আতঙ্কিত এবং গুরুতর আহত অবস্থায় ওই চার শ্রমিকই বাড়ি ফিরে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ২২ বছরের রুহুল শেখ নামে এক শ্রমিকের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে খবর। আক্রান্ত নাহিদের কথায়, ‘‘শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার জন্যই নয়, আমরা মুসলিম হওয়ায় বজরং দলের সদস্যেরা আমাদের বেদম মারধর করেছে। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ‘জয় শ্রীরাম’ বলার পরেও মার থামেনি।’’

আরও পড়ুন-তৃণমূল পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটি ঘোষণা করা হল

এ কী সাংঘাতিক কাণ্ড? ধর্মের দোহাই পেড়ে গরিব মানুষের জীবন-জীবিকাতেও হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে! তারা ভুলে যাচ্ছে, এই দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারত্ব। প্রধানমন্ত্রী বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও বেকারদের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ। গবির মানুষজন যখন নিজ উদ্যোগে নিজের মতো করে একটা সামান্য জীবিকা খুঁজে নিয়েছে, তখন তাঁরই ভক্তকুল বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সংস্কৃতি গোল্লায় দিচ্ছেই, ওইসঙ্গে কি দেশের অর্থনীতিকেও ধ্বংস করে দিতে তারা বদ্ধপরিকর? বিভেদ-বিদ্বেষে মোদির ভারত কাদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে? নতুন সহস্রাব্দের সিকি শতক পার করার মুখে আমরা। এই যুগসন্ধিক্ষণে শেষমেশ মহম্মদ ইউনুসের বাংলাদেশ এবং আসিম মুনিরের পাকিস্তান কি আদর্শ হল ভারতের?

Latest article