অনুপর্ণা রায়
ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের এক প্রতিশ্রুতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক অনুপর্ণা রায়। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় জন্ম অনুপর্ণার নামকরণ করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। স্নাতক পড়ার সময় থেকে তাঁর মনে ছবি বানানোর আকাঙ্ক্ষা জন্মালেও এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য তিনি দিল্লিতে মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়তে যান। সেখান থেকে কাজের সূত্রে যান মুম্বই। ২০২৩ সালে ‘রান টু দ্য রিভার’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর। ২০২৪ সালে তিনি নির্মাণ করেন প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি, ‘দ্য সংস অফ ফরগটেন ট্রিজ’, যেখানে উঠে এসেছে মুম্বইয়ে বসবাসকারী দুই প্রবাসী নারীর জীবনের গল্প। ৮২তম ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবি প্রদর্শিত হয় এবং ওরিজন্তি বিভাগে তিনি সেরা পরিচালকের সম্মান পান। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই সম্মান অর্জন করেন অনুপর্ণা। ব্যক্তিগত সাফল্যের পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চে ভারতের বিজয় কেতন উড়িয়ে তিনি দেশকেও গৌরবান্বিত করেছেন। প্রমাণ করে দিয়েছেন স্বপ্ন দেখার সাহস, জেদ, লড়াই আর নিষ্ঠা থাকলে সাফল্য অনিবার্য।
দিব্যা দেশমুখ
ভারতীয় দাবার নবপ্রজন্মের মধ্যে দিব্যা দেশমুখ এক উজ্জ্বল নাম। মহারাষ্ট্রের নাগপুরে জন্ম দিব্যার বাবা-মা উভয়েই চিকিৎসক। দিদির ব্যাডমিন্টন খেলা দেখে খেলার প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। পাঁচ বছর বয়সে দাবা খেলা শুরু করে মাত্র সাত বছর বয়সে জাতীয় স্তরে সাফল্য পান তিনি। পনেরো বছর বয়সে তিনি ভারতের ২১তম গ্র্যান্ডমাস্টার হন এবং সতেরো বছর বয়সে আন্তর্জাতিক গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। অল্প বয়সেই তাঁর মাথায় যুক্ত হয় অনেক সাফল্যের মুকুট। যার মধ্যে রয়েছে ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১০ বিশ্বখেতাব, ২০১৭-এ অনূর্ধ্ব-১২ বিশ্ব চ্যম্পিয়ানশিপ খেতাব, ২০২৪ সালে শারজা চ্যালেঞ্জার্সে বিজয় ও ফিডে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্ব বালিকা দাবা চ্যাম্পিয়ান খেতাব। আগ্রাসী মনোভাব, হিসেব কষে ঝুঁকি নেওয়া, নিখুঁত কৌশল আর ঠান্ডা মাথা হল তাঁর অন্যতম শক্তি। প্রতিপক্ষের ভুলের জন্য অপেক্ষা না করে তিনি চেষ্টা করেন খেলাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ২০২৪ সালে ৪৫তম দাবা অলিম্পিয়াডে দলীয় স্বর্ণপদকের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত স্বর্ণপদক জেতেন। ২০২৫ সালে ফিডে দাবা বিশ্বকাপের ফাইনালে স্বদেশীয় কেনেরু হাম্পিকে হারিয়ে তিনি চ্যাম্পিয়ন হন। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে এমন অসামান্য সাফল্য প্রমাণ করে যে দাবার জগতে তাঁর ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল।
বানু মুস্তাক
বর্তমান সময়ে ভারতীয় সাহিত্যের এক উল্লেখযোগ্য নাম বানু মুস্তাক। পেশায় আইনজীবী বানু মুস্তাক একজন সমাজসেবী এবং কন্নড় সাহিত্যের খ্যাতনামা লেখিকা। ১৯৪৮ সালে কর্নাটকের হাসানে মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া বানুর জীবনের চলার পথ অনেক সংগ্রাম ও ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ছিল লেখার প্রতি আগ্রহ। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। আইনজীবী হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন নারীদের সুরক্ষা ও অধিকার-সংক্রান্ত অনেক মামলা লড়েছেন। তার ফলে বিশেষ করে মুসলিম নারীদের সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থান কাছ থেকে দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতাই তাঁর লেখার মূল ভিত্তি। তাঁর লেখা গল্প ও প্রবন্ধে বারেবারে উঠে এসেছে নারীদের বঞ্চনা, রক্ষণশীলতা, ধর্মীয় সংস্কার, লিঙ্গবৈষম্য এবং আত্মসম্মানের লড়াইয়ের কথা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে নারীর অন্তর্গত দ্বন্দ্ব, নারীর লড়াই আর আত্মসম্মানের ব্যাপারকে তিনি মানবিক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেন। তাঁর ছ’টি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। বহু ভাষায় তাঁর লেখা অনুদিত হয়েছে। তাঁর লেখা ‘হার্ট ল্যাম্প’ ছোটগল্প সংকলন ইংরেজিতে অনুবাদ করেন দীপা ভাস্তি। এই বইটির জন্য ২০২৫ সালে তিনি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার লাভ করেন। কন্নড় ভাষায় তিনিই প্রথম এই কৃতিত্বের অধিকারী। বানু মুস্তাক নিছক কথাসাহিত্যিক নন, তিনি সমাজ পরিবর্তনের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর।
স্মৃতি মান্ধানা
বর্তমান সময়ে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র স্মৃতি মান্ধানা। মহারাষ্ট্রে জন্ম স্মৃতির। ক্রিকেটপ্রেমী পরিবারে বড় হন। তাঁর বাবা ও ভাই উভয়েই জেলা পর্যায়ের ক্রিকেট খেলেছেন। ভাইয়ের খেলা দেখে তিনিও ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং অল্প বয়স থেকেই দক্ষতার পরিচয় রাখেন। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি মহারাষ্ট্রের অনূর্ধ্ব-১৫ দলে এবং এগারো বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একদিনের ম্যাচে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তাঁর। মার্জিত ব্যাটিং, নিখুঁত টাইমিং আর আক্রমণাত্মক মানসিকতার স্মৃতি অল্প সময়ে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের স্তম্ভ হয়ে ওঠেন। চাপের মুখে সাবলীল ব্যাটিং করার ক্ষমতা তাঁর অন্যতম শক্তি। এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটে শতরান, দিন-রাতের টেস্টে শতরানকরী প্রথম মহিলা ভারতীয় এবং অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টেস্টে শতরানকারী প্রথম ভারতীয় মহিলা,
এ-সবই তাঁর অনন্য কৃতিত্ব। ২০২৫ মহিলা বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় দলের তিনি ছিলেন সহ-অধিনায়ক। বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে শতরান করার মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার মেগ ল্যানিং-এর সঙ্গে যুগ্মভাবে সর্বাধিক
শতরানের অধিকারী হন। স্মৃতির সাফল্য আগামীর তরুণী ক্রিকেটারদের কাছে অনুপ্রেরণা।
ড. সোনালি ঘোষ
ভারতবর্ষের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আন্দোলনের এক উজ্জ্বল নাম ড. সোনালি ঘোষ। পুণেতে জন্ম সোনালির ছোটবেলা কেটেছে বাবার সেনাবাহিনীর কাজের সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে। যার মধ্যেই তাঁর মনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন ও বন্যপ্রাণীর প্রতি ভালবাসা। ২০০০-২০০৩ ব্যাচের আইএফএস টপার সোনালি বন ও বন্যপ্রাণী বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করেন। ২০২৩ সালে কাজিরাঙার ফিল্ড ডাইরেক্টর হয়ে ইতিহাস রচনা করেন তিনি। ২০২৪ সালে বিধ্বংসী বন্যায় কাজিরাঙার বন্যপ্রাণের অস্তিত্ব ভয়ংকর সংকটের সম্মুখীন হয়। সেই সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি অ্যান্টি-পোচিং শিবিরগুলিকে আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তর, অস্থায়ী করিডর নির্মাণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর জীবন রক্ষা করেন। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে কাজিরাঙার শিকার প্রায় শূন্যে নেমে আসে এবং এর পরিসর প্রায় ১৩০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। কর্মীদের উন্নত প্রশিক্ষণ, র্যাপিড রেসপন্স টিম গঠন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তিনি বন্যপ্রাণ সংরক্ষণে গড়ে তুলেছেন আধুনিক মডেল। সুরক্ষার পাশাপাশি তিনি এখানে ইকো-ট্যুরিজম চালু করেছেন। তাঁর এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি আবু ধাবিতে অনুষ্ঠিত IUCN WCPA–Kenton Miller Award লাভ করেন প্রথম ভারতীয় হিসেবে। নিজের সুদক্ষ নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সচেতনতা ও মানুষের অংশগ্রহণ হল সংরক্ষণের আদর্শ ভবিষ্যৎ।
পায়েল কাপাডিয়া
সমকালীন চলচ্চিত্র জগতের একটি উল্লেখযোগ্য নাম পায়েল কাপাডিয়া। মহারাষ্ট্রের পুণেতে জন্ম পায়েল কৈশোর থেকেই ছিলেন চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহী। অন্ধ্রপ্রদেশের ঋষি ভ্যালি স্কুলে পড়াকালীন তিনি ফিল্ম ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন। চলচ্চিত্র পরিচালনা করবেন না সম্পাদনা করবেন, এই বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। স্নাতকোত্তর পাশ করার পর সম্পাদনা শেখার জন্য তিনি ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াতে আবেদন করে ব্যর্থ হওয়ার কযেক বছর পর সেখানেই পরিচালনা বিভাগে সুযোগ পান। ২০১৭ সালে তাঁর স্বল্পদৈর্ঘের ছবি ‘আফটারনুন ক্লাউডস’ একমাত্র ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য নির্বাচিত হয়। ২০২১ সালে ‘এ নাইট অব নোয়িং নাথিং’ ছবির জন্য তিনি কান-এ ‘গোল্ডেন আই’ পুরস্কার লাভ করেন। ২০২৪ সালে তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘গ্র্যান্ড পিক্স’ জিতে ইতিহাস রচনা করে। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে তিনি এই সম্মান লাভ করেন। এই বছর পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া চলচ্চিত্রে তাঁর অবদানের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ফরাসি বেসামরিক সম্মান, অফিসার ড্যান্স ল’অরড্রে দেস আর্টস এট ডেস লেটারে সম্মানিত হয়েছেন। পায়েল কাপাডিয়ার চলচ্চিত্র এমন এক নির্মাণ যা দর্শককে ভাবতে শেখায়। সংবেদনশীল নির্মাণভঙ্গির মাধ্যমে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে তিনি এক নতুন ভাষার সূচনা করেছেন।
বর্ষা দেশপাণ্ডে
বর্ষা দেশপাণ্ডে হলেন একজন প্রগতিশীল নারী অধিকারকর্মী ও সমাজ সংস্কারক। পেশায় আইনজীবী বর্ষা দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে লিঙ্গ বৈষম্য, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ ও কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন। ১৯৯০ সালে তিনি ‘দলিত মহিলা বিকাশ মণ্ডল’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা মহারাষ্ট্রের গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে নারীর অধিকার সুরক্ষা এবং বৈষম্য প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। মহারাষ্ট্রের কিছু এলাকায় শিশুকন্যাদের নিখোঁজ, অবৈধ লিঙ্গ নির্ধারণ এবং পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার, আইনি লড়াই ও গণসচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন তিনি। তাঁর আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজের গভীরে প্রোথিত অবৈধ লিঙ্গ নির্ধারণের চক্রগুলি প্রকাশ্যে আসে। শুধু তাই নয়, তিনি প্রায় ৫০টিরও বেশি স্ট্রিং অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর সহায়তায় কন্যাভ্রূণ হত্যায় যুক্ত দুর্নীতিগ্রস্ত অনেক চিকিৎসককে জেলে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। নারী অধিকার রক্ষায় তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ২০২৫ সালে তিনি পান জাতিসংঘের পপুলেশন অ্যাওয়ার্ড। বর্ষা দেশপাণ্ডে আজ শুধু একজন সমাজকর্মী নন, ভারতীয় নারী আন্দোলনের এক দৃঢ়, প্রতিবাদী ও অনুপ্রেরণাদায়ক কণ্ঠস্বর।
আরও পড়ুন-মানবে না হার, তৃণমূল আবার: ১ জানুয়ারি থেকে জোড়া কর্মসূচি আত্মতুষ্টি নয় যুদ্ধের সময়, বার্তা অভিষেকের
ডায়না পুন্ডোল
ভারতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে পুরুষ-প্রাধান্যের কার-রেসিং প্রতিযোগিতায় এক ব্যতিক্রমী নাম ডায়না পুন্ডোল। মহারাষ্ট্রের পুণেতে পার্সি পরিবারে জন্ম ডায়নার রেসিং-এর অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর বাবা। ২০১৮ সালে কোয়েম্বাটোরে JK Tyres আয়োজিত ‘Women in Motorsports’ নামক ট্যালেন্ট হান্টে অংশ নিয়ে ২০০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে শীর্ষ ছয়ে জায়গা করে নেন তিনি। এটি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। এই সাফল্যের ফলে একটি নামী টায়ার কোম্পানির জাতীয় রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপে এক বছর বিনামূল্যে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। ২০২১ সালে তিনি ভক্সওয়াগন পোলো কার চ্যাম্পিয়ানশিপে এবং ২০২৩ সালে এমআরএফ স্যালুন কার্স ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন। এর ঠিক পরের বছর MRF–MMSC FMSCI ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কার রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ-এর স্যালুন কার্স বিভাগে জাতীয় শিরোপা জয় করে তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেন, প্রথম এবং একমাত্র ভারতীয় মহিলা হিসেবে। দুই সন্তানের মা ডায়নাকে কার রেসিং-এর মতো পুরুষ প্রাধান্যের খেলায় অংশগ্রহণ করার কারণে অনেক সমালোচনা ও কটাক্ষের শিকার হতে হয়েছে। সেসব পরোয়া না করে নিজের লক্ষ্যে তিনি এগিয়ে গেছেন এবং সাফল্যের শিরোপা অর্জন করেছেন। প্রমাণ করে দিয়েছেন লক্ষ্যে অবিচল, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাস থাকলে কোনও কাজই অসম্ভব নয়।
আশ্রিতা কামাথ
বর্তমান সময়ে ভারতীয় সিনেমা জগতের একটি আলোচিত নাম হল আশ্রিতা কামাথ। কলকতায় জন্ম আশ্রিতা বেড়ে উঠেছেন চেন্নাইয়ে। অন্ধ্রপ্রদেশের ঋষি ভ্যালি স্কুলে পড়ার সময় ঋষি ভ্যালি ফিল্ম ক্লাবের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্রতি ভালবাসা জন্মায় তাঁর। মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পাশ করার পর তিনি পা রাখেন বলিউডে। এখানে তিনি ফিচার ফিল্ম ও বিজ্ঞানের শিল্প বিভাগে কাজ করেন। এই সময় তিনি আরাধনা শেঠের ‘ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট’, জোয়া আখতারের ‘জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা’ ছবিতে কাজ করেন। ২০১১ সালে তিনি লস এঞ্জেলেসের AFI কনজারভেটরিতে প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে নির্বাচিত হন। এখানে তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘টম ইয়োডা স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পান। তাঁর থিসিস চলচ্চিত্র ‘ইন্টারস্টেট’ স্টুডেন্ট অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পায় এবং ‘ডাস্টল্যান্ড’ সেরা আর্ট ডিরেকশনের জন্য মনোনীত হয়েছিল। হলিউ়ডের অনেক বড় বড় প্রযোজনায়ও কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে তিনি জেমস ক্যামেরনের অবতার-২ ও অবতার-৩ ছবিতে আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন। এককথায় বলতে গেলে আশ্রিতা কামাথ ভারত ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধুন।
দেবদত্তা মাজি
২০২৫ সালে JEE Advance পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল করে শিরোনামে উঠে এসেছেন বাংলার মেয়ে দেবদত্তা মাজি। দেশের অন্যতম কঠিন এই পরীক্ষায় আইআইটি খড়্গপুর জোন থেকে প্রথম হওয়ার পাশাপাশি সর্বভারতীয় স্তরে মহিলাদের মধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করেছেন। ৩৬০ নম্বরের মধ্যে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৩১২। পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়ায় বাসিন্দা দেবদত্তা মাধ্যমিকে রাজ্যে প্রথম হয়েছিলেন এবং উচ্চমাধ্যমিকে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেছিলেন। দেবদত্তার লক্ষ্য আইআইসি বেঙ্গালুরু থেকে বিটেক করা। তিনি বিশ্বাস করেন পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। ছোট শহর থেকে উঠে এসে দেশের কঠিনতম পরীক্ষায় সাফল্যলাভ করে দেবদত্তা প্রমাণ করে দিয়েছেন জেদ, ধৈর্য, নিষ্ঠা এবং অধ্যবসায় থাকলে যে কোনও স্বপ্ন বাস্তব হওয়া সম্ভব।
বিবি জান
গ্রামীণ সমাজে কৃষিক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল নাম বিবি জান। কর্নাটকের ধারওয়াড় জেলার কুন্দগোল তালুকের তীর্থ গ্রামের বাসিন্দা বিবি জানের একসময় একা বাড়ির বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ২০১৯ সালে তাঁর জীবনে আসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর একজন সংযোজকের প্রয়োজন ছিল। তিনি এই পদের জন্য আবেদন করতে চান কিন্তু স্বামী প্রথমে তাঁকে অনুমতি দেন না। দৃঢ়সংকল্প বিবি জান তাঁকে বুঝিয়ে, পারিবারিক বাধা অতিক্রম করে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শিক্ষিতা বিবি জানের যোগ্য নেতৃত্বে ১৪ জন নারীর ছোট্ট দলটি এখন পরিণত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি নারীর কৃষকের সমবায়ে। তিনি মিলেট প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট পরিচালনা করছেন এবং ৩০টি গ্রাম জুড়ে জৈব ও জলবায়ু সহনশীল পদ্ধতিতে মিলেট চাষের প্রসার ঘটিয়েছেন। তাঁদের এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি তাদের ‘ইকুয়েটর প্রাইজ’ প্রদান করেছে যা ‘জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের নোবেল পুরস্কার’ নামে খ্যাত। বিবি জান প্রমাণ করে দিয়েছেন সুযোগ ও সহায়তা পেলে গ্রামীণ মহিলারাও কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে।
এই নারীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, সৃজনশীলতা থেকে শুরু করে নেতৃত্বদান, সবেতেই তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁদের সাফল্য আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। এটা বোঝায়, অবদমন নয় নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে জাতির প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব। তাঁদের কীর্তি ভবিষ্যতের আলোর দিশা, আগামী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার আলো।

