ভাড়ায় দেওয়া হয়েছিল
রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাল লাল ঘোষ। তিনি ছিলেন বিরাট জমিদার। বিপুল সম্পত্তির মালিক। বরানগরের বিখ্যাত কাশীপুর উদ্যানবাটির মালিক ছিলেন তিনিই। উদ্যানবাটির মোট এলাকার আয়তন ছিল ১১ বিঘার কিছু বেশি। পরবর্তীতে এটাই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্যদের ভাড়ায় দেওয়া হয়েছিল। মাসিক ৮০ টাকায় প্রথমে ছয় মাস। পরে আরও তিন মাস।
বাগানটি চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। উত্তর সীমানার কাছে কয়েকটি ঘর রান্নাঘর ও ভাণ্ডারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। ঘরগুলোর সামনেই রয়েছে মূল দোতলা বাড়ি। এই বাড়ির নিচে রয়েছে চারখানি ও উপরে দু’খানি ঘর। উপরের বড় ঘরটিতেই রামকৃষ্ণ থাকতেন। ছোট ঘরটি তাঁর স্নান ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হত।
পরবর্তী সময়ে এই উদ্যানবাটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বড় ঘরটি বর্তমানে মঠের প্রধান উপাসনালয়। ঘরটির ঠিক নিচেই একতলায় একটি হল ঘর আছে। সেটা ছিল ভক্তদের বসার ঘর। বর্তমানে এটা মঠের দ্বিতীয় উপাসনালয়। এই ঘরের উত্তরে একটি সিঁড়ির ঘর আছে। তার পাশে পূর্বদিকের ঘরটিতে থাকতেন মা সারদা। এই ঘরটি বর্তমানে মা সারদা মন্দির। হল ঘরের দক্ষিণের ঘরটিতে থাকতেন সেবকরা। এটা বর্তমানে একটি ক্ষুদ্র সংগ্রহালয়। বাড়িকে চারদিক দিয়ে ঘিরে আছে গোলাকার পথ। বাগানের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে উদ্যানবাটির প্রধান ফটকটি অবস্থিত। বাগানে ছিল পুকুর। আম, লিচু, খেজুর ইত্যাদি নানা ফলের গাছ।
নিরিবিলি জায়গা
উদ্যানবাটিতেই জীবনের অন্তিম দিনগুলো শিষ্যদের সঙ্গে কাটিয়েছেন রামকৃষ্ণ। একটা সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৮৮৫ সালে তাঁর গলা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় এই যন্ত্রণাময় অবস্থার নাম ক্লার্জিম্যানস থ্রোট। তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। চিকিৎসার জন্য ওই বছরের অক্টোবর মাসে রামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতার শ্যামপুকুরে। ডাক্তারের মতে, রামকৃষ্ণ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শ্যামপুকুরে কিছুদিন থাকার পর ডাক্তারের পরামর্শে ভক্তরা ১১ ডিসেম্বর বিকেলে রামকৃষ্ণকে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে নিয়ে আসেন। কলকাতা থেকে মাইল তিনেক উত্তরে জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। রামকৃষ্ণের খুবই পছন্দ হয়েছিল।
আরও পড়ুন-স্মৃতির ক্যালেন্ডারে ২০২৫
নির্বিকল্প সমাধি লাভ
কথিত আছে, এই উদ্যানবাটিতেই নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা স্বামী বিবেকানন্দ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেছিলেন। এখানেই নরেন্দ্রনাথ এবং আরও কয়েকজন ভক্তকে রামকৃষ্ণ গৈরিক বস্ত্র ও সন্ন্যাস প্রদান করেন। নরেন্দ্রনাথ ছাড়াও রামকৃষ্ণের ষোল জন সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন, যাঁরা রামকৃষ্ণের উপদেশ অনুযায়ী সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ভক্তদের কাছে তাঁরা পরমহংসের দূত নামেও পরিচিত। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সংস্কারে এই ষোড়শ শিষ্যের অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই গুরুর সঙ্গে থাকতেন উদ্যানবাটিতে। বাকিরাও উদ্যানবাটিতে গুরুর সঙ্গে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়।
ছোট থেকেই ঈশ্বরে আসক্তি
রামকৃষ্ণের শিষ্যদের মধ্যে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছিলেন প্রসিদ্ধ বাঙালি সন্ন্যাসী। পিতৃদত্ত নাম ছিল রাখালচন্দ্র ঘোষ। জন্ম ১৮৬৩ সালের ২১ জানুয়ারি বসিরহাটের শিকরা-কুলীন গ্রামে। ছোট থেকেই ঈশ্বরে আসক্তি। ধ্যান অনুশীলন করতেন। বারো বছর বয়সে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় পাঠানো হয়। দক্ষিণেশ্বরে আসার সঙ্গে সঙ্গে রামকৃষ্ণ তাঁকে কাছে টেনে নেন। গুরুর নির্দেশে গূঢ় আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করেন। ১৮৮৬ সালে গুরুর মৃত্যুর পর যখন বরানগরে নতুন সন্ন্যাসী ভ্রাতৃত্ব গঠিত হয়। রাখাল তাতে যোগ দেন। সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। নতুন নাম হয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ।
অদ্বৈত বেদান্ত অধ্যয়নচর্চা
স্বামী তুরীয়ানন্দ ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্যতম প্রিয় শিষ্য। পিতৃপ্রদত্ত নাম হরিনাথ চট্টোপাধ্যায়। ১৮৬৩ সালের ৩ জানুয়ারি উত্তর কলকাতায় জন্ম। কম বয়সেই ধ্যান এবং শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্ত অধ্যয়নচর্চা শুরু করেন। সতেরো বছর বয়সে প্রথমবার দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের দর্শন পান। এরপর থেকে প্রায়শই গুরুর কাছে যেতেন। গুরু তাঁকে যোগীপুরুষ বলে আখ্যায়িত করেন। কাশীপুরে রামকৃষ্ণের জীবনের শেষ অসুস্থতার সময় গুরুর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। গুরুর মৃত্যুর পর হরিনাথ বরানগর মঠে যোগ দেন। স্বামী তুরীয়ানন্দ নাম ধারণ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন-দীপু দাসের হত্যার ঘটনায় সরব অভিষেক, প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি না থাকা নিয়ে খোঁচা
তীব্র সাধনায় নিমজ্জিত
আর এক শিষ্য স্বামী অভেদানন্দ। ১৮৬৬ সালের ২ অক্টোবর উত্তর কলকাতায় জন্ম। পিতৃপ্রদত্ত নাম কালীপ্রসাদ চন্দ্র। ১৮৮৪ সালে আঠারো বছর বয়সে ছাত্রাবস্থায় তিনি দক্ষিণেশ্বরে যান। রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করেন। ১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে, রামকৃষ্ণের জীবনের শেষ অসুস্থতার সময়ে প্রথমে শ্যামপুকুর এবং পরে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য নিজ বাসগৃহ ত্যাগ করেন। ১৮৮৬ সালে তাঁর গুরুর মৃত্যুর পর বরানগর মঠের একটি ঘরে নিজেকে বন্ধ করে তিনি তীব্র সাধনায় নিমজ্জিত হন। সহশিষ্যদের মধ্যে তিনি কালী তপস্বী নামে পরিচিত পান। গুরুর মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাসী হয়ে স্বামী অভেদানন্দ নাম ধারণ করেন।
জীবিকার সন্ধানে কলকাতায়
স্বামী অদ্ভুতানন্দের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। মননশক্তি তাঁকে বাকিদের মধ্যে অনন্য করে তুলেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিহার প্রদেশের ছাপরায় জন্ম। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল রাখতুরাম। তিনি রামকৃষ্ণের অন্যান্য শিষ্যদের কাছে লাটুরাম বা লাটু মহারাজ নামে পরিচিত ছিলেন। দারিদ্রের ফলে লাটুরাম জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় আসতে বাধ্য হন। রামকৃষ্ণের গৃহস্থ ভক্ত রামচন্দ্র দত্তর সহায়তায় গুরুর পরিচারক হিসেবে যোগ দেন। গলায় ক্যানসার ধরা পড়লে সুবিধার জন্য ভক্তরা রামকৃষ্ণকে দক্ষিণেশ্বর থেকে শ্যামপুকুরে নিয়ে যান, তখন লাটু ব্যক্তিগত পরিচারক হয়ে তাঁর সঙ্গে যান। পরে ১৮৮৫-র ১১ ডিসেম্বর রামকৃষ্ণের সঙ্গে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে চলে যান। গুরুর শেষ দিনগুলিতে গুরুসেবায় নিযুক্ত ছিলেন। পরে সন্ন্যাস গ্রহণের পর স্বামী অদ্ভুতানন্দ নাম পান।
বয়োজ্যেষ্ঠ সাক্ষাৎশিষ্য
স্বামী অদ্বৈতানন্দ ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বয়োজ্যেষ্ঠ সাক্ষাৎশিষ্য। জন্ম ১৮২৮ সালের ২৮ অগাস্ট। জগদ্দলের কাছে। পিতৃপ্রদত্ত নাম গোপালচন্দ্র ঘোষ। ১৮৮৪ সালে স্ত্রী মারা গেলে তিনি রামকৃষ্ণের কাছে আসেন। বেশ কয়েকবার সাক্ষাতের পর গোপালকে রামকৃষ্ণ তাঁর শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তাঁকে বড় গোপাল বা অধ্যক্ষ বলে সম্বোধন করেন। কারণ তিনি ছিলেন রামকৃষ্ণের চেয়ে আট বছরের বড়। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তিনি সন্ন্যাস ব্রত নেন এবং স্বামী অদ্বৈতানন্দ হন।
দীক্ষাশিক্ষা নিতেন
অন্যতম শিষ্য স্বামী নির্মলানন্দ ১৮৬৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর কলকাতার বাগবাজার এলাকার জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল তুলসীচরণ দত্ত। আঠারো বছর বয়সে বলরাম বসুর বাড়িতে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। পরে গিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। গুরুর কাছ থেকে দীক্ষাশিক্ষা নিতেন। কাশীপুর উদ্যানবাটিতে তিনি রামকৃষ্ণের জীবনের শেষ পর্যায়ে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। গুরুর মৃত্যুর পর বরানগর মঠের স্থায়ী সদস্য হন। সন্ন্যাস গ্রহণ করে স্বামী নির্মলানন্দ নাম পান।
তৃতীয় অধ্যক্ষ
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন-এর তৃতীয় অধ্যক্ষ স্বামী অখণ্ডানন্দ। পিতৃদত্ত নাম গঙ্গাধর ঘটক গঙ্গোপাধ্যায়। জন্ম ১৮৬৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। আহিরীটোলায়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন না। পরে গীতা ও উপনিষদ মুখস্থ করেন। ১৮৭৭ সালে বাগবাজারে দীননাথ বসুর বাড়িতে রামকৃষ্ণের দেখা পান। তখনই তাঁর প্রতি আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। ১৮৮৩ সালের মে মাসে উনিশ বছর বয়সে দক্ষিণেশ্বরে দ্বিতীয়বার রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর নিয়মিত যেতেন। ১৮৮৫ সালের সেপ্টেম্বরে, যখন রামকৃষ্ণ ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য প্রথমে শ্যামপুকুর এবং পরে কাশীপুরে চলে আসেন, তিনিও গুরুসেবায় নিযুক্ত হন। রামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর ১৮৮৭ সালে কেদারনাথ এবং বদ্রীনাথ পরিদর্শন করার পর তিব্বত ভ্রমণে যান। ১৮৯০ সালে ভারতে ফিরে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। স্বামী অখণ্ডানন্দ নাম পান।
শিক্ষক ছিলেন মহেন্দ্রনাথ
১৮৬৫ সালের ৩০ জানুয়ারি ভাঙড়ের নাওড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দের। পিতৃপ্রদত্ত নাম সারদাপ্রসন্ন মিত্র। কলকাতার শ্যামপুকুরে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের ছাত্র। সেখানে প্রধান শিক্ষক ছিলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বা ‘শ্রীম’। ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’র লেখক। তিনিই ১৮৮৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করার জন্য সারদাপ্রসন্নকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে নিয়ে যান। এরপর সারদাপ্রসাদ প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণের কাছে যেতেন। ধীরে ধীরে রামকৃষ্ণকে নিজের গুরু ও পথপ্রদর্শক হিসেবে মানতে শুরু করেন। তিনি রামকৃষ্ণের শেষ সময়ে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে গুরু সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি সন্ন্যাসের ব্রত গ্রহণ করেন। ত্রিগুণাতীতানন্দ নামে পরিচিত হন।
ইঞ্জিনিয়ার থেকে সন্ন্যাসী
স্বামী বিজ্ঞানানন্দর জন্ম ১৮৬৮ সালের ৩০ অক্টোবর। বেলঘরিয়ায়। পিতৃপ্রদত্ত নাম হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। সংস্কৃতে পণ্ডিত। ধর্ম-দার্শনিক কাজে ছিলেন দক্ষ। ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। ১৮৭৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বেলঘরিয়ায় কেশবচন্দ্র সেনের বাড়িতে সর্বপ্রথম রামকৃষ্ণকে দেখেন। ১৮৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণেশ্বরে যান। হরিপ্রসন্নের প্রতি অগাধ ভালবাসা এবং স্নেহ দেখান রামকৃষ্ণ। এরপর হরিপ্রসন্ন পড়াশোনার জন্য বাইরে চলে যান। তিনি পুণেতে থাকাকালীন শ্রীরামকৃষ্ণ মারা যান। এরপর হরিপ্রসন্ন বিভিন্ন শহরে চাকরি করেন। ১৮৯৬ সালে স্বামী বিবেকানন্দ পশ্চিমের দেশ ভ্রমণ সেরে ফিরে আসার কিছু আগে হরিপ্রসন্ন আলমবাজার মঠে যোগ দেন। সেখানে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন এবং স্বামী বিজ্ঞানানন্দ নামে পরিচিত হন।
নিত্যসিদ্ধ বা ঈশ্বরকোটী
স্বামী নিরঞ্জনানন্দ ছিলেন সেই কয়েকজন শিষ্যদের মধ্যে একজন, যাঁদের রামকৃষ্ণ নিত্যসিদ্ধ বা ঈশ্বরকোটী বলে অভিহিত করেছিলেন। যার অর্থ পূর্ণতাপ্রাপ্ত আত্মা। তিনি ১৮৬২ সালে রাজারহাট-বিষ্ণুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম নিত্যনিরঞ্জন ঘোষ। তিনি নিরঞ্জন নামেই পরিচিত ছিলেন। আঠারো বছর বয়সে প্রথমবার রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ পান। পরে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর নিরঞ্জন সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন এবং স্বামী নিরঞ্জনানন্দ নামে পরিচিতি পান।
সংসার বিমুখ বৈরাগী
১৮৬১ সালে ১০ ডিসেম্বর হুগলির আঁটপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন স্বামী প্রেমানন্দ। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল বাবুরাম ঘোষ। ভগিনী কৃষ্ণভামিনী ছিলেন রামকৃষ্ণের গৃহস্থ শিষ্য বলরাম বসুর স্ত্রী। ছোট থেকেই বাবুরাম ছিলেন সংসার বিমুখ বৈরাগী পুরুষ। মহেন্দ্র গুপ্তর সহযোগিতায় রামকৃষ্ণর সান্নিধ্য পান। এরপর দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে যাতায়াত শুরু করেন। পরে নরেন্দ্রনাথ দত্তের সাক্ষাৎ পান। ১৮৮৬ সালের অগাস্ট মাস পর্যন্ত রামকৃষ্ণের চিকিৎসা ও সেবায় তিনি বাকি গুরুভাইদের সঙ্গে হাত মেলান। পরে সমস্ত গুরুভাই আঁটপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটায় একত্রিত হয়ে সন্ন্যাস নেন। স্বামী প্রেমানন্দ নাম পান।
আচার-উপাসনায় আগ্রহ
১৮৬৩ সালে ১৩ জুলাই হুগলির খানাকুলের ইছাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। পিতৃপ্রদত্ত নাম শশীভূষণ চক্রবর্তী। ছোটবেলা থেকেই আচার-উপাসনায় আগ্রহ। কলকাতার কলেজে পড়ার সময় ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন এবং কেশবচন্দ্র সেনের কাছে রামকৃষ্ণের কথা শোনেন। ১৮৮৩ সালের অক্টোবরে দক্ষিণেশ্বর যান এবং রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিকতার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। কলেজের পড়াশোনা সরিয়ে রেখে শ্যামপুকুর এবং কাশীপুরে রামকৃষ্ণের অন্তিম সময়ে তাঁর সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। গুরুর দেহত্যাগের পর বরানগর মঠে যোগ দেন। সন্ন্যাস গ্রহণ করে রামকৃষ্ণানন্দ নাম পান।
কঠোর ও অভাবী জীবন
১৮৬৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটি ধনী ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে স্বামী সারদানন্দর জন্ম। পিতৃপ্রদত্ত নাম শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী। ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেনের প্রভাবে আসেন। ১৮৮৩ সালের অক্টোবর মাসে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে দক্ষিণেশ্বর যান। এরপর থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার রামকৃষ্ণের কাছে যেতেন। এইভাবেই আধ্যাত্মিক অনুশীলনের দিকনির্দেশ পেতে শুরু করেন। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তিনি বরানগর মঠে কঠোর ও অভাবী জীবন অতিবাহিত করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর স্বামী সারদানন্দ নামে পরিচিত হন।
আরও পড়ুন-মাসিক বেতনে এগিয়ে বাংলা
সাধনা ও ধ্যান অনুশীলন
রামকৃষ্ণের অন্যতম প্রধান শিষ্য স্বামী শিবানন্দ। ১৮৫৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বারাসতের কাছে একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতৃপ্রদত্ত নাম তারকনাথ ঘোষাল। ১৮৮০ সালের মে মাসে রামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে প্রথমবার রামকৃষ্ণকে দেখেন। কয়েকদিন পরে দক্ষিণেশ্বরে যান। কিছুদিন রামকৃষ্ণের সঙ্গ পাওয়ার পর তিনি তাঁর নির্দেশনায় সাধনা ও ধ্যান অনুশীলন শুরু করেন। এরপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের তিন বছর পর স্ত্রী মারা গেলে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। গুরু রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন। নতুন নাম হয় স্বামী শিবানন্দ।
মননশীল প্রকৃতির
১৮৬১ সালের ৩০ মার্চ দক্ষিণেশ্বরের কাছে জন্মগ্রহণ করেন স্বামী যোগানন্দ। পিতৃপ্রদত্ত নাম যোগীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী। শৈশব থেকেই মননশীল প্রকৃতির ছিলেন। দিনের বেশকিছু সময় ধ্যান করতেন। সতেরো বছর বয়সে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। সেই সময় তিনি পড়াশোনা করছিলেন। রামকৃষ্ণ যোগীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সম্ভাবনাকে বুঝে তা পরিপুষ্ট করার জন্য বারবার দক্ষিণেশ্বরে আমন্ত্রণ পাঠাতেন। বাবা-মা তাঁর বিয়ে দেন। বিয়ের পর যোগীন্দ্রনাথ আবার রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেন। আবার তাঁর আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর স্বামী যোগানন্দ নাম পান।

চৈতন্য হউক
এঁদের পাশাপাশি রামকৃষ্ণর কয়েকজন গৃহস্থ শিষ্য ছিলেন। তাঁরা হলেন রানি রাসমণি, মথুরমোহন বিশ্বাস, হৃদয় মুখোপাধ্যায়, লক্ষ্মী দেবী, শম্ভুচরণ মল্লিক, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, অধরলাল সেন, অঘোর ভাদুড়ী, অতুলচন্দ্র ঘোষ, অশ্বিনীকুমার দত্ত, বৈদ্যনাথ, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, রামচন্দ্র দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। রামচন্দ্র দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন সেই দিনের সাক্ষী, যেদিন রামকৃষ্ণ কাশীপুর উদ্যানবাটিতে কল্পতরু হয়েছিলেন।
১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি বিকেলে গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং অন্যান্য শিষ্যদের আশীর্বাদ করেন রামকৃষ্ণ। তিনি সমাধিস্থ হন। শিষ্যরাও ভাবোন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। ভক্তরা বলে থাকেন, রামকৃষ্ণ সেদিন পুরাণে বর্ণিত ‘কল্পতরু’-তে পরিণত হয়েছিলেন। সবার মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের চৈতন্য হউক’’। সেই উপলক্ষে রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসীরা এবং রামকৃষ্ণের গৃহী ভক্তরা প্রতি বছর ১ জানুয়ারি ‘কল্পতরু দিবস’ পালন করেন। নানা জায়গায় এই দিনটি উদযাপিত হলেও কাশীপুর উদ্যানবাটির কল্পতরু উৎসব সবচেয়ে বিখ্যাত। ১৮৮৬ সালের ১৬ অগাস্ট এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব দেহ রাখেন।

