যতই করো হামলা, জিতবে ফের ঐক্যবদ্ধ বাংলা

বিজেপি বাংলা-বিরোধী জমিদার। এক গণতান্ত্রিক উপায়ে ২০২৬ সালে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপিকে বিদায় জানাবে। যেমনটা প্রাপ্য, ঠিক তেমনভাবেই বিজেপিকে বিদায় জানানো হবে। এ-ক্ষেত্রে কোনও দয়াময়া দেখানো হবে না। বুঝিয়ে দিচ্ছেন চিরঞ্জিৎ সাহা

Must read

“হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।”

আরও পড়ুন-রহস্য রোমাঞ্চ ফ্যান্টাসি

বাংলার আকাশে স্বাধীনতা-পরবর্তী নিকষতম দুর্যোগের ঘনঘটা। সম্প্রীতির পালে ভর করে তরতরিয়ে এগিয়ে চলা শান্তিতরী হঠাৎই বিচ্ছিন্নতাবাদী সুনামির কবলে। বিভেদকামী ব্রিটিশের মানসপুত্র, নিজেদের রামভক্ত বলে জাহির-করা গেরুয়াধারীরা শূর্পণখা কিংবা রাবণের ধাঁচে ছদ্মবেশের আশ্রয়ে বাঙালিকে সম্মোহনের মায়াজালে জড়াতে মরিয়া। উৎসব, উদযাপন ও ঐক্যের স্বর্গোদ্যান বাংলাকে খাদ্যাভ্যাস কিংবা ধর্মের অজুহাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী কুঠার হাতে লন্ডভন্ড করার অভিশপ্ত প্রয়াস নিয়ে রোজই বাংলায় হানা দিচ্ছে উগ্র মানসিকতাসম্পন্ন একদল রক্তপিপাসু। প্রাচীন জলদস্যুদের উত্তরসূরি গেরুয়া হার্মাদরা আসে আকাশপথে। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে লুঠ করে গরিব বাঙালিকে। মিথ্যে হিন্দুত্বের ললিপপ চুসিয়ে অবৈধ রোহিঙ্গা মুসলমান খেদানোর নাম করে এসআইআরে নিজভূমে পরবাসী ঘোষণা করে মতুয়া হিন্দুদের। বিজেপির কাছে হিন্দুরা ভোট ব্যাঙ্কের বেশি আর যে কিছুই নয়, তার প্রমাণ মেলে কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের ভাষণে— “৫০ লক্ষ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি মুসলমান বাদ দিতে গিয়ে যদি আমার সম্প্রদায়ের এক লক্ষ মানুষকে ভোটদান থেকে বিরত থাকতে হয় তাতে কি আসে…” অর্থাৎ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মানসিক টানাপোড়েনের দুনিয়ায় বিরাজমান বাংলার অদৃশ্য দেড় কোটি রোহিঙ্গা মুসলিম তাড়ানোর পরিসংখ্যান যথার্থই মতুয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার এক অভিনব কৌশল। এসআইআরের খসড়ানুযায়ী, ডানকুনি পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের জলজ্যান্ত তৃণমূল কাউন্সিলর সূর্য দে নাকি মৃত! এতদিন ভগবানের হাতে থাকা জন্ম-মৃত্যুর ক্ষমতা এবার বিজেপির দৌলতে নির্বাচন কমিশনের হাতে! অথচ পদবি দেখে সহজেই অনমেয় সূর্যবাবু কিন্তু মুসলিম নন। “দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস”-এ প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার আসামে বিদেশি সন্দেহে যে কয়েকশো লোককে গ্রেফতার করেছে, তাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রবীণ কর্মীও রয়েছেন।

আরও পড়ুন-আতশ কাচের নিচে টেস্ট কোচ গম্ভীর

বিগত পাঁচ দশকে অসমের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ১.৬ লক্ষ মানুষকে অ-নাগরিক ঘোষণা করেছে, যাদের মধ্যে ৬৯,৫৫৯ জন হিন্দু। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সুপ্রিম কোর্ট এবং গুয়াহাটি হাইকোর্ট ঘোষিত বিদেশিদের দীর্ঘ কারাবাসের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার পর বেশ কয়েকজনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ ভারতবর্ষে সত্যিই “হিন্দু খতরে মে হ্যায়” এবং তার জন্য একমাত্র দায়ী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। দেশবাসীর খাদ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করতে না পারলেও আমিষ, নিরামিষ বিভাজন সৃষ্টি করে মানুষের গ্রাসাচ্ছদনের ন্যূনতম সংস্থানটুকু কেড়ে নিতেও বদ্ধপরিকর বিজেপি আর তার নমুনা মেলে ব্রিগেডে গীতাপাঠের নামে গণপিটুনির আয়োজনে যেখানে চিকেন প্যাটিস বিক্রির কারণে প্রহৃত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শেখ রিয়াজুলকে কলকাতা ছাড়তে হয়। ভোটসর্বস্ব বিজেপির রাজনীতিতে আজকের গীতাপাঠের ময়দান কালকের “বাইবেল রিডিং”-এ মুহূর্তে বদলে যেতে পারে শুধুমাত্র ভোট অঙ্কের অছিলায় আর তার প্রমাণ মেলে হিন্দু কিংবদন্তি রাজা রামমোহন রায়কে নিয়ে মধ্যপ্রদেশের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ইন্দর সিং পারমারের মন্তব্যে— “ব্রিটিশরা বেশ কয়েক জন ভারতীয়কে ভুয়ো সমাজ সংস্কারক হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন, যিনি ব্রিটিশদের দালাল হিসাবে কাজ করতেন।’’ কিংবা সাম্প্রতিককালে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির বাঙালি বিপ্লবী সূর্য সেনকে “মাস্টার” অথবা সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকে “বঙ্কিমদা” বলে সম্বোধন। বঙ্কিমচন্দ্র, সূর্য সেন কিংবা রামমোহনরা কিন্তু শেখ রিয়াজুলের মতো মুসলিম ছিলেন না। তাঁদের অপরাধ আদতে একটাই যে, তাঁরা বাঙালি। এই ঘৃণ্য মানসিকতার বিরুদ্ধেই তৃণমূলকে হয়ে উঠতে হবে নিজেদের অস্মিতার পাহারাদার। ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে এ লড়াই বাঙালির জাতিসত্তাকে রক্ষার সংগ্রাম। বিজেপির মদতে ইতিমধ্যেই ময়দানে হুমায়ুন কবিরের মতো বিভেদকামী শকুনরা যারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে বাংলাকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে মরিয়া।
ধর্মীয় মেরুকরণের জমাট বারুদের ওপর বাংলাকে বসিয়ে ফায়দা লুটতে বদ্ধপরিকর বিজেপি, আইএসএফ এবং জেইউপি-সহ অন্যান্য ক্ষমতাপিপাসু দল আর বাঙালির চিরাচরিত সহনশীলতায় ভর করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শে এই চক্রান্তকে বানচাল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে ময়দানে নামতেই হবে আপামর তৃণমূল কর্মীকে। না হলে হিন্দু, মুসলিম, রোহিঙ্গা কিংবা খ্রিস্টান নয়, মরবে সাধারণ বাঙালি আর আর তাদের লাশের ওপর দিয়ে এই বাংলা সাক্ষী থাকবে ঔদ্ধত্যের এক গেরুয়া ইমারতের যেখানে নিজের দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নরেন্দ্র মোদির তাহেরপুরের জনসভায় যোগ দিতে গিয়ে তিনজন সাধারণ বিজেপি কর্মী ট্রেনে কাটা পড়লেও মহারাজের চোখেমুখে অনুশোচনার কোনও অভিব্যক্তি ধরা তো পড়েই না, উপরন্তু ধ্বনিত হয় বাংলা দখলের নির্লজ্জ হুঙ্কার। আসলে —
“বিজেপির দর্শন নয় মোটে শক্ত,
সবচেয়ে খেতে ভাল বাঙালির রক্ত।”
অথচ দিন কয়েক আগেই যুবভারতীতে মেসির উপস্থিতিকালীন বিশৃঙ্খলায় সসম্ভ্রমে পদত্যাগ করেন বাংলার ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। ঠিক-ভুলের ঊর্ধ্বে স্বয়ং ভগবানও নন। কিন্তু ভুল-পরবর্তী নমনীয়তাই সংজ্ঞায়িত করে তৃণমূলকে আর এই ধারা আগামী দিনগুলিতেও সফলভাবে বজায় রাখা তৃণমূল কর্মীদের নৈতিক দায়িত্ব। বঙ্গদেশকে গিলোটিনে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলা বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের স্লোগান হোক ঐক্যবদ্ধতার সুর যেখানে ধর্ম কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে ধ্বনিত হোক বাঙালিয়ানার জয়গান। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর “মেরেছে কলসীর কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না”র আদলে বাংলার প্রতিটি জনকল্যাণমুখী প্রকল্পের আশীর্বাদ পৌঁছে যাক সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়িতেও। হিন্দু-মুসলিম, বাম-বিজেপির ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি হোক সংঘবদ্ধ। নাহলে কোনও এক কাকেভোরে লালনের বাংলায় বাজবে ভোজপুরি গান। দাদাবৌদি, ডি-বাপিকে গুঁড়িয়ে চলবে পনির বিরিয়ানি। ইলিশ, পাবদা, কাতলা কালিয়াকে নিষিদ্ধ করা হবে অনুপ্রবেশকারীরূপে। হোটেলে চারাপোনার পরিবর্তে মিলবে রাজমা চাউল। অনাদির কাটলেট বদলে যাবে ঠেকুয়ায়, কফি হাউসের নাম বদলে তৈরি হওয়া “নমো হাউসে” ফিশফ্রাইয়ের জায়গায় বিক্রি হবে বড়াপাও। বাঙালির আড্ডার বিশ্বস্ত ঠিকানা প্রিন্সেপ ঘাটের নতুন নামকরণে “মালব্য ঘাট”-এ গেরুয়া হরফে লেখা থাকবে— “Couples are not allowed.” তৃণমূল কর্মীদের আগামী তিন মাসের তৎপরতা ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারে একটা গোটা জাতিকে—
“লালন, সিরাজ, চৈতন্য আমার দেশের লোক,
লড়াই এবার বাঙালিয়ানার অস্মিতাতেই হোক…”

Latest article