শুরুতেই কথাটা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে বলা দরকার।
১৯৯৪ তে কথাটা বলতে শুনেছিলাম জয়া চ্যাটার্জীকে। “ভদ্রলোক সাম্প্রদায়িকতার” দিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তার মধ্যে দিয়ে বিংশ শতাব্দীতে ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু সাংস্কৃতিক কৌম লক্ষণে যারা বাঙালি তাদের সাম্প্রদায়গত পরিচয় নির্মাণ পরিষ্কার হয়ে যায়। জয়া চ্যাটার্জির মতে, আমরা সাম্প্রদায়িকতাকে কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক হিংসা, দাঙ্গা কিংবা ধর্মীয় প্রতীকের ধারণার মধ্যে দিয়ে ভেবে থাকি। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিংসার বাইরেও যে সংস্কৃতি ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা আছে, যার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’-র পার্থক্য, তিনি সেটাকেই তুলে ধরে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোনও দাঙ্গা বা হিংসা কেন্দ্রিক বিদ্বেষের থেকে নয়, বরং উদারবাদী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ‘ভদ্রলোক’ সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এখানে তাই আরএসএস বিজেপির উত্তর ভারতীয় হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। স্পষ্ট কথায়, বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে “সাম্প্রদায়িকতা নেই” বলতে তৃণমূল কংগ্রেস যেটা বোঝে, সেটা হচ্ছে দেশের অন্যান্য অংশ বা রাজ্যের (মূলত উত্তর ভারত) তুলনায় প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক হিংসার অনুপস্থিতি। এই হিংস্র অনুদারতার কারণেই উত্তর ভারতীয় হিন্দি বলয়ের হিন্দুত্ববাদীরা বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বহিরাগত। নিছক ধর্মীয় পরিচয়ে অভিন্নতার কারণে তাদের এক করে দেখলে বা দেখালে ভুল হয়ে যাবে। আর, এই ভুলটাই বিজেপি বার বার বাংলায় ইচ্ছাকৃত ভাবে করে আমাদের বাঙ্গাকিয়ানাকে গিলে খেতে চাইছে। আর তাতে, বুঝে না – বুঝে মদত দিচ্ছে বামেরা।
এজন্যই আজ যখন আমরা পেছনে ফিরে তাকাই বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ আমাদের কাছে একটা বিচ্ছিন্নপর্বের ঘটনাবলি হয়ে ওঠে । সেই সাম্প্রদায়িক হিংসার দাগ মুছে ফেলতে অনেক সময় সেজন্যই আমরা তুলে ধরতে চাই সেই সময় মানুষের সংহতিমূলক ভূমিকা। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অতীব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কোথাও গিয়ে তা দৈনন্দিন সাম্প্রদায়িকতা বা সংস্কৃতি ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে জিগির তুলতে দেয় না।
জাতীয়তাবাদী বাঙালির ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা সহ বাংলার নানা অংশে গড়ে উঠেছিল ব্যায়াম সমিতি। এক ধরনের বিপ্লবী কেন্দ্র ছিল এগুলি।এগুলির গড়ে ওঠার পেছনে সাম্প্রদায়িক প্রসঙ্গ যতটা না ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল দুর্গা পূজো এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকার সংহতকরনের প্রয়োজনীয়তা। কেউ বলতেই পারেন, এই সংহতকরণ ‘হিন্দু’ কেন্দ্রিক ছিল, পুরুষ কেন্দ্রিক ছিল। কারণ, একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, বাঙালি পুরুষদের মধ্যে পুরুষত্ব ও শক্তি ফিরিয়ে আনতে এই প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, সেই সময় ব্রিটিশদের দ্বারা হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষদের চিত্রিত করা হতো মেয়েলি হিসেবে। মৃণালিনী সিনহা ১৯৯৫ তে প্রকাশিত তাঁর বই “The Manly Englishman and the Effeminate Bengali Babu” তে পাঠকদের এই পুরুষত্ব কেন্দ্রিক রাজনীতির বিষয়ে লিখতে দেখিয়েছেন, ব্রিটিশদের দাগিয়ে দেওয়া এই পুরুষত্বহীনতাকে মুছে ফেলতে হিন্দু বাঙালি পুরুষত্ব ফিরিয়ে আনতে এক দীর্ঘ লড়াইয়ে নেমে পড়ে আর দিকে দিকে ১৯০০–১৯৩০–এর মধ্যে অনেকগুলি ব্যায়াম সমিতি গড়ে ওঠে। শক্তি বৃদ্ধি শুধু সীমিত থাকে না ব্যায়ামে, শক্তির সঞ্চয় করার জন্য প্রয়োজন হয় শক্তির আরাধনার। ঠিক এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা যায় এই ব্যায়াম সমিতি আর দুর্গা পুজোর একটা ইতিহাস আছে এই বঙ্গে, এবং শহর কলকাতায়। শক্তি অথবা যেটাকে আমরা বলে থাকি, feminine power, সেই মাতৃশক্তির ধর্মীয় প্রতীককে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির চর্চা। আজ যে শক্তির আরাধনাকে নারীশক্তির প্রতীক হিসেবে মানা হয়ে, সেই শক্তির আরাধনা গড়েই উঠেছিল পুরুষত্ব পুনরুত্থানের প্রণোদনায়। ভারতের অন্য কোথাও এটা দেখা যায়নি। সেজন্য বাঙালি বজরঙ্গবলীর উপাসনা নয়, দুর্গা পুজোতেই ব্রতী সেদিন হয়েছিল, আজও রয়েছে।
আরও পড়ুন-স্মৃতি-শেফালির ব্যাটে অনায়াস জয় ভারতের
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দুর্গা পুজোর মণ্ডপে বীরাষ্টমী পুজোয় যে তরোয়াল পুজো হয়ে থাকে, তাঁর সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনও যোগাযোগ নেই। এই বীরাষ্টমী ব্রত পালন মূলত জাতীয়তাবাদীদের একটা রাজনৈতিক সমাবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ আয়োজন । ধর্মের সংস্রব সত্ত্বেও এই ব্রত পালন “ধর্মনিরপেক্ষ” জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অংশ। শক্তির আরাধনার একটা রাজনৈতিক মোড়। রাচেল ফেলল মাকডারমট তাঁর বইয়ে আমাদের দেখিয়েছেন কি ভাবে দুর্গা বা কালী বিংশ শতাব্দীতে একটি রাজনৈতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছিল।ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার পরিপ্রেক্ষিতে এগুলির প্রসারণ, আজ যে ন্যারেটিভ বিজেপি এগুলিকে কেন্দ্র করে তৈরি করতে চাইছে, সেই মুসলমান বিদ্বেষ এগুলির উপলক্ষ ছিল না আদৌ।
জয়া চ্যাটার্জি তাঁর লেখায় দেখিয়েছিলেন ধর্ম নয়, সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে বাঙালি সাম্প্রদায় গত পরিচয় গঠন হয়েছে, যা প্রচলিত অর্থে সাম্প্রদায়িক নয়।
বিজেপির অসভ্যতার পরিণামে সাধারণের মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কোন ধর্মীয় উৎসব “ধর্ম” থেকে শুধু “উৎসব”-এ পরিণত হতে পারে? কোন ধর্মীয় উৎসব সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে? কোন ধর্মীয় উৎসব ধর্ম থেকে বেরিয়ে একটা সর্বব্যাপী সংস্কৃতিতে পরিণত হতে পারে? আসলে, এই “ধর্ম” থেকে “উৎসব”-এ পরিণত হওয়া একটা ক্ষমতার কথা বলে, বাঙালি সংস্কৃতিগত ভাবে যে ক্ষমতার অধিকারী। উত্তর বা মধ্যভারতীয় যা নন। আজ কেবল দুর্গা পুজো নয়, বাঙালির দুর্গা বন্দনা সেই সংস্কৃতির জায়গাটা গ্রহণ করেছে বলেই বিংশ শতাব্দীর সর্বজনীন পুজো ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজনীতি থেকে এখনকার সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক উৎসবের রাজনীতি, বাঙালির সাম্প্রদায়িক অস্মিতাকে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিতে পরিণত করেছে।
এই পরম্পরার গৌরব অন্বিত প্রকাশ আজ দুর্গা অঙ্গনের (Durga Angan) শিলান্যাস।
দুর্গার পূজায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা হয়তো হিন্দুদের, কিন্তু মূলবাণী সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে নিবেদিত। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার সামাজিক বন্ধন, ভ্রাতৃত্ববোধের এক নতুন প্রণোদনা। দেবীর যুদ্ধরত রূপ লোকশিক্ষার একটি দৃষ্টান্ত। অশুভশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির যুদ্ধ; অন্যায়, অসত্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়, সত্য ও সদাচারের সংগ্রামের প্রতীক। তাই দুর্গা বন্দনার প্রেক্ষাপট হলো অন্তরের আসুরিক শক্তির বিনাশ। দেবীর ‘১০ হাত’ ঐক্য বা সম্মিলিত শক্তির প্রতীক। ঐক্যবদ্ধভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর, অন্যায়কে প্রতিহত করার শিক্ষাই দেবীর প্রতিমা থেকে শিক্ষণীয়। সুতরাং দুর্গাপূজা শক্তি, সংহতি বা ঐক্যের প্রতীক।বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূলে গ্রথিত এই ঐকতানের কাছে বিভেদ বিদ্বেষ সঞ্চারের সকল অপপ্রয়াস পরাভূত হবেই।
দুর্গাঙ্গনের (Durga Angan) শিলান্যাস সেই বার্তাই বয়ে আনছে।

