আরাবল্লী রক্ষায় কঠোর সুপ্রিম কোর্ট, পরিবেশের উপর প্রভাব দেখতে আগের রায়ে স্থগিতাদেশ জারি

Must read

নয়াদিল্লি: আরাবল্লী পর্বতমালা (Aravalli Range) ও এর বিস্তৃতি নির্ধারণে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের প্রস্তাবিত সংজ্ঞাকে ঘিরে বড়সড় মোড় নিল সুপ্রিম কোর্টের শুনানি। সোমবার ভারতের শীর্ষ আদালত গত ২০ নভেম্বর দেওয়া তাদের আগের রায় আপাতত স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আগের ওই রায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া আরাবল্লীর সংজ্ঞাকে আদালত গ্রহণ করেছিল, যার ফলে আরাবল্লী অঞ্চলের একটি বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রিত খনি উত্তোলনের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় কেন্দ্রের নীতির বিরোধিতায় আন্দোলনে নেমেছিলেন পরিবেশকর্মীরা। পরিবেশরক্ষার যুক্তিতে সোমবার আগের রায়ে স্থগিতাদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট।

আরাবল্লী (Aravalli Range) পাহাড়শ্রেণির কোন অংশকে পাহাড় বলে বিবেচনা করা হবে, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। তাতে সিলমোহর দেয় সুুপ্রিম কোর্টও। এবার পূর্ববর্তী ওই নির্দেশ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ। বলা হয়েছে, আরাবল্লী পাহাড়ের ‘সংজ্ঞা’ এখনই নির্ধারণ করা যাবে না। পূর্ববর্তী রায়ও এখনই কার্যকর হবে না। এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছে আদালত। আরাবল্লী পাহাড়ের ওই ‘সংজ্ঞা’ নির্ধারণের ফলে পরিবেশের উপর কী প্রভাব পড়তে পারে, তা খতিয়ে দেখার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্তের বেঞ্চ।

প্রসঙ্গত, আরাবল্লী পাহাড়শ্রেণির কোন অংশকে পাহাড় বলে বিবেচনা করা হবে, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিল কেন্দ্রের পরিবেশ মন্ত্রক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নয়, বরং আশপাশের এলাকার চেয়ে ১০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতার ভূখণ্ডই কেবলমাত্র আরাবল্লী পাহাড় বলে গণ্য হবে— এমনই ছিল কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের প্রস্তাবিত সংজ্ঞা। গত ২০ নভেম্বর ওই ‘সংজ্ঞা’য় সিলমোহর দেয় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাইয়ের বেঞ্চ। এই সংক্রান্ত একটি রায়ও দেয় শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম কোর্ট গত মাসে ওই রায় দেওয়ার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওই রায়ে আপত্তি জানানো হয়। আরাবল্লী পাহাড়শ্রেণি সংরক্ষণের দাবিতে রাজস্থান এবং হরিয়ানার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদে সরব হন স্থানীয় মানুষ। উদ্বেগপ্রকাশ করেন পরিবেশ এবং বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের একাংশও। এই অবস্থায় গত শনিবার এই বিষয়ে স্বতঃপ্রণোদিত পদক্ষেপ করে সুপ্রিম কোর্ট।

আরও পড়ুন-ওড়িশার পর এবার অসমে ৫ পরিযায়ী শ্রমিককে নিগ্রহ

প্রধান বিচারপতি সূর্য কান্ত, বিচারপতি জে কে মহেশ্বরী এবং বিচারপতি এ জি মাসিহের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চ জানায়, আরাবল্লী সংক্রান্ত সংজ্ঞার আইনি ও পরিবেশগত বিষয়ে আরও স্পষ্টতার প্রয়োজন রয়েছে। আদালতের পর্যবেক্ষণ, আগে যে কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে আরাবল্লীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তাতে মূলত আমলাদের আধিপত্য ছিল। পরিবেশগত প্রভাব সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য এখন একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি। শীর্ষ আদালত আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, আরাবল্লীর সংজ্ঞাকে মাত্র ৫০০ মিটারের একটি বেল্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেললে তা একটি ‘কাঠামোগত বৈপরীত্য’ তৈরি করতে পারে। এর ফলে একদিকে যেমন সংরক্ষিত বনাঞ্চলের আয়তন কমে যেতে পারে, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রিত খনির পরিধি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

শুনানির সময় বেঞ্চ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। আদালত জানতে চায়, পাহাড়ের দুটি চূড়া বা শৃঙ্খলের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাগুলিতে (গ্যাপস) খনি উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া পরিবেশগতভাবে কতটা সমীচীন। বিশেষ করে, যদি ১০০ মিটারের বেশি উঁচু দুটি পাহাড়ের মধ্যে ৭০০ মিটারের ব্যবধান থাকে, তবে সেই এলাকাটিকে পরিবেশগত নিয়মের অধীনে কীভাবে বিবেচনা করা হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম কোর্ট জোর দিয়ে বলেছে যে, এই প্রাচীন পর্বততন্ত্রের পরিবেশগত ধারাবাহিকতা এবং কাঠামোগত অখণ্ডতা রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। কোনো নিয়মের ফাঁকফোকর দিয়ে যাতে প্রকৃতির ক্ষতি না হয়, তা নিশ্চিত করতে বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞ মতামতের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রস্তাবিত কমিটির মূল কাজ হবে আমলাতান্ত্রিক সুপারিশের পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশগত মাপকাঠিতে আরাবল্লীকে সংজ্ঞায়িত করা। প্রস্তাবিত নতুন সংজ্ঞার ফলে যেসব এলাকা খনি উত্তোলনের জন্য উন্মুক্ত হবে, সেখানে খননকার্য চললে ভূগর্ভস্থ জলস্তর এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যের ওপর কী প্রভাব পড়বে তা খতিয়ে দেখা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত ‘৫০০ মিটার বেল্ট’ কি আরাবল্লীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যথেষ্ট, নাকি এটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন— তা বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে যাচাই করা। আরাবল্লী রাজস্থানের থর মরুভূমিকে দিল্লি ও হরিয়ানার দিকে এগিয়ে আসতে বাধা দেয়। খনি উত্তোলনের ফলে পাহাড়ের উচ্চতা কমলে মরুপ্রসারণের ঝুঁকি কতটা বাড়বে, তা বিশ্লেষণ করা। এই ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করেছে এবং কেন্দ্র-সহ চার রাজ্য— রাজস্থান, গুজরাত, দিল্লি ও হরিয়ানাকে নোটিশ পাঠিয়ে জবাব তলব করেছে। আগামী ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত আগের রায়টি স্থগিত থাকবে। আদালতের এই হস্তক্ষেপে আপাতত আরাবল্লী অঞ্চলে নতুন কোনও খনির ইজারা দেওয়ার পথও বন্ধ রইল।

Latest article