আজও বিকল্প নেই ব্রেইলের

অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নানান পথের সন্ধান দিলেও আজও দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির কোনও বিকল্প নেই। ব্রেইল পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং ব্রেইলকে জনপ্রিয় করে তুলতে জাতিসংঘ এর আবিষ্কর্তা লুইস ব্রেইল-এর জন্মদিন ৪ জানুয়ারিকেই ‘বিশ্ব ব্রেইল দিবস’ ঘোষণা করেছে। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ব্রেইল এক নতুন দিগন্ত
প্রাচীন গ্রিসে নাকি অন্ধদের বেঁচে থাকারই অধিকার ছিল না! ভোরের সূর্যোদয়, সন্ধের সূর্যাস্ত, সমুদ্রের অতলান্তিক গভীতরতা, পাহাড়ে শান্ত স্থির নিমগ্নতার চাক্ষুষ উপলব্ধি থেকে যাঁরা বঞ্চিত তাঁদের চেয়ে দুর্ভাগা কি আর কেউ আছেন! দু-চোখে যার আঁধার তার সম্বলমাত্র শুধুই অন্তর্দৃষ্টি আর কল্পনাশক্তি। সেই অন্তর্দৃষ্টিই তাঁদের স্বপ্ন দেখায় আকাশচুম্বী হওয়ার আর সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে আলাদিনের এক আশ্চর্য প্রদীপ ব্রেইল। যা দৃষ্টিহীনদের অন্ধকার পৃথিবীর মাঝে অনেকটা আলো।
ব্রেইল পদ্ধতি আজও প্রাসঙ্গিক
দৃষ্টিহীন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ব্রেল বিশেষজ্ঞ— সকলেরই অভিমত, ব্রেলের বিকল্প আজও নেই। দৃষ্টিহীনদের জন্য অডিও বুক, স্ক্রিন রিডিং সফটওয়্যার আসা সত্ত্বেও ব্রেইলের প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘ব্রেইল’ দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক কাজ যেমন বই পড়া, লেখা, হিসাব করা, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, গল্প পড়া, পথ চলা ইত্যাদিতে সহায়তা করে। পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক এমন অন্ধ মানুষকে কারও সাহায্য ছাড়া অ্যাসাইনমেন্ট করা, ক্লাসের নোট করা এমনকী অনলাইনে ক্লাস বুঝতেও সহায়তা করে এই পদ্ধতি। ব্রেইল পদ্ধতিতে খুব সহজেই বর্ণমালা শেখার সুযোগ রয়েছে। অনেকটা আমাদের মতোই।

আরও পড়ুন-ভারত উগ্র ধর্মান্ধদের দেশ হয়ে উঠছে, আতঙ্কের আবহ চারিদিকে

রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লে
ব্রেইল ডিসপ্লেতে বেশ কিছু পিন রয়েছে। এগুলো বিভিন্নভাবে ওঠানামা করে কম্পিউটার স্ক্রিনে চলমান দৃশ্য বুঝতে সহায়তা করে। কম্পিউটারের সঙ্গে বিশেষ একটি কেবল দিয়ে ব্রেইল ডিসপ্লে যুক্ত করা হয়। কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে চলমান দৃশ্য নিজে থেকে ব্রেইলে পরিবর্তন করে এটি নিজস্ব স্ক্রিনে চালু করে। রিফ্রেশেবল ব্রেইলের একটি লাইন জুড়ে বিদ্যুৎ চালিত পিন থাকে যা স্ক্রিনে সবসময়ই চলমান থাকে। রিফ্রেশেবল ব্রেইলে ২০, ৪০ ও ৮০ অক্ষর এবং বাটনযুক্ত কি-বোর্ড রয়েছে। এটি ব্রেইল নোটবুকের সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। রিফ্রেশেবল ব্রেইল ডিসপ্লের সাহায্যে খুব সহজেই লেখার ধরন, ওয়ার্ড ফরম্যাট, স্পেসিং এবং বানান চেক করা যায়।
ব্রেইল প্রিন্টার
ব্রেইল প্রিন্টার হল এক ধরনের বিশেষ প্রিন্টার যা কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যেকোনও লেখার ব্রেইল কপি প্রিন্ট করে। ব্রেইল প্রিন্টারের মাধ্যমে একজন ছাত্র নিজের লেখা যেকোনও কাজ বা অ্যাসাইনমেন্ট ব্রেইল কপিতে প্রিন্ট করতে পারবে। এই প্রিন্টারের জন্য বিশেষ শক্ত এবং মোটা কাগজের প্রয়োজন হয় যে কাগজের এক পিঠে অক্ষরগুলো প্রিন্ট করা হয়।
ইলেকট্রনিক ব্রেইল নোট টেকার
এই যন্ত্রটি সাধারণত সেসব দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রদের সহায়তা করে, যাঁরা ক্লাসে বিভিন্ন নোট টুকে নেন বা শিক্ষকের কথা শুনে নিজে থেকে নোটস টাইপ করে নেন। পরবর্তীতে এটি কম্পিউটারে সংরক্ষণ করে রাখা যায় অথবা চাইলে ব্রেইল কপিতে প্রিন্ট করে নেওয়া যায়। এছাড়াও রয়েছে ব্রেইলের আরও অনেক কিছু।
দৃষ্টিহীনদের জন্য শিল্পের সঙ্গেও পরিচয় করিয়েছে ব্রেইল আর্ট। তাদের জন্য এখন পৃথিবী জুড়ে রয়েছে ব্রেইল আর্ট লাইব্রেরি। হাতের আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে, বুঝে, কল্পনা করে এক নতুন অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে পারছে তারা। রয়েছে নামী শিল্পীদের ব্রেইল আর্টের বইও। এখানেই শেষ নয় রেস্তোরাঁয় চালু হচ্ছে ব্রেইল মেনুও। আর কী চাই! দৃষ্টিহীনরাও আমজনতার সঙ্গেই রেস্তোরাঁয় বসে মেনু কার্ড পড়ে খাবার অর্ডার দেন অনায়াসে।

আরও পড়ুন-জেলায় জেলার চরম হয়রানির শিকার প্রবীণ ও অসুস্থরা

ব্রেইল-এর আবিষ্কার
লুইস ব্রেইল আবিষ্কৃত ছয় বিন্দুর পদ্ধতি বিশ্ব জুড়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা আজ সমাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে এবং পেশাগত দক্ষতা বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু কীভাবে হল এই পদ্ধতির আবিষ্কার? ১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসের কাছে কুপভ্রে নামের ছোট্ট একটি গ্রামে লুইস-এর জন্ম। বাবা চামড়ার দ্রব্য তৈরি করতেন। একদিন বাবার চামড়া ফুটো করবার যন্ত্র নিয়ে খেলতে গিয়ে সেই যন্ত্র হাত ফসকে ব্রেইলের একটি চোখকে মারাত্মকভাবে আঘাত করে। পেনিসিলিন আবিষ্কার তখনও না হওয়ায় আঘাতপ্রাপ্ত চোখ থেকে সংক্রমণ পাশের চোখেও ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে দুটো চোখ নষ্ট হয়ে যায় লুইস ব্রেইলের। চোখের দৃষ্টি হারানোর পর লুইস থেমে থাকেননি। তাঁর ছিল অদম্য মনোবল এবং ইচ্ছাশক্তি। এরপর তিনি অর্গান এবং চেলো বাজানো শুরু করলেন। পড়াশোনার জন্য ভর্তি হলেন প্যারিসের ব্লাইন্ড স্কুলে। এখানেই একদিন জানতে পারলেন অ্যালফাবেট কোডের কথা। মূলত ফরাসি সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি ‘নাইট রাইটিং’ নামের এক ধরনের স্পর্শনির্ভর লিপি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ব্রেইল আবিষ্কার করেছিলেন। ফরাসি ভাষার প্রতিটি অক্ষরের জন্য ১২টি ডটকে বিভিন্ন বিন্যাসে সাজিয়ে একটা নতুন বর্ণমালা সৃষ্টি করা হয় ‘নাইট রাইটিং’ লিপিতে। এই ডটগুলোয় হাত বুলিয়ে সেনারা বিশেষ অবস্থায় লেখা নির্দেশনাগুলো কোনওরকম আলোর সাহায্য ছাড়াই পড়ে নিতে পারতেন। ১৮২১ সালে ‘নাইট রাইটিং’ নিয়ে কাজ করা শুরু করে কিশোর লুইস ব্রেইল। সেই ১২টি ডটের বর্ণমালাকে আরও সহজবোধ্য করে ৬টি ডটে বিন্যস্ত করে নতুনভাবে সাজালেন। ব্রেইল লিপির মূল কাঠামো এই ছয়টি বিন্দুর সমন্বয়ে তৈরি। এই বিন্দুগুলোর ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাসে গঠিত হয় অক্ষর, সংখ্যা, বিরামচিহ্ন, এমনকী সঙ্গীতলিপিও। ১৮২৯ সালে, ২০ বছর বয়সে, লুইস ব্রেইল তাঁর প্রথম বই প্রকাশ করেন। এটাই ‘ব্রেইল পদ্ধতি’ নামে ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে রইল।

Latest article