অসার সত্য সার [SIR]

কাঁথির শান্তি(কুঞ্জ)র ছেলের একটাই এজেন্ডা : বাংলার বুকে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের সম্প্রীতির বিনাশ। বাংলার মাটিকে অসম্মান করার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর হিন্দি বলয়ের গুরুদের প্রিয় পাত্র হতে চান। রাজনৈতিক ফায়দার স্বার্থে এসব অপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তিটির রোহিঙ্গা তত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতা আজ প্রমাণিত। লিখছেন ডোমকল গার্লস কলেজের সমাজতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

ক্লান্ত, অশীতিপর ৯৬ বছরের বৃদ্ধ নিখিলচন্দ্র সরকার হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যে শুনানিতে গেছেন, বসার জায়গার অপ্রতুলতার জন্য টোটোর মধ্যে বসেই অপেক্ষা করছেন তিনি। এই ছবি কোচবিহারের দিনহাটার। বছর ৭০-এর অষ্ট অধিকারীর শরীরের ডানদিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত, মেয়ের হাত ধরে শুনানি কেন্দ্রে পৌঁছন বেলা ৩টেয়, শুনানি শেষ হয় বিকেল সাড়ে ৫টায়। এই ছবি হুগলির চুঁচুড়ার। উত্তর থেকে দক্ষিণ গোটা বাংলাতেই এই করুণ, যন্ত্রণাদায়ক ছবিগুলি বারংবার উঠে আসছে এসআইআর-এর শুনানি পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকে। বিষয়ের আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগেই এই প্রশ্নটা এসে যায়, ভারতীয় রাষ্ট্রের কল্যাণকর (ওয়েলফেয়ার) চরিত্রটি কি একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গেল?

আরও পড়ুন-ঠান্ডায় সাদা আস্তরণে ঢাকল মিরিক, খুশি পর্যটকরা

পশ্চিমবাংলার বুকে এসআইআরের সূচনার ঘোষণা থেকে শুনানি অবধি গোটা প্রক্রিয়াটিকে যদি মানব হিতৈষী দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বিজেপি ও বিজেপির দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন কমিশনের আঁতাতের কদর্য রূপটি বারংবার উঠে আসে। এসআইআরের ঘোষণা পর্ব থেকেই পশ্চিমবাংলার বিরোধী দলনেতার কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই বাংলার বুকে দেড় কোটি রোহিঙ্গা বসবাসের তত্ত্ব এবং বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তাঁর বহিষ্কারের হুমকি। এর মধ্যে দিয়ে দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, বাংলার মাটিকে অসম্মান করার মধ্যে দিয়ে তিনি তাঁর হিন্দি বলয়ের গুরুদের প্রিয় পাত্র হতে চান এবং বাংলার বুকে দীর্ঘ সময় ধরে বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের সম্প্রীতিকে তিনি বিনষ্ট করতে চান রাজনৈতিক ফায়দার স্বার্থে। খসড়া তালিকা প্রকাশের পর রোহিঙ্গা তত্ত্বের অন্তঃসারশূন্যতা আজ প্রমাণিত।
এসআইআরের ত্রুটির জায়গা বহুবিধ। ভারতীয় রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের নাগরিকরাই ভোট দিতে পারেন, কিন্তু ভোটার তালিকা আর নাগরিকপঞ্জি এক নয়। এই হেঁয়ালির নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা এখনও অবধি অলভ্য। হেঁয়ালির এই দুর্বিষহ মেঘের মধ্যে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়েছে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খবর এসেছে মানুষের আত্মহত্যার। ২০০২ সালে ভোটার তালিকায় নাম না-থাকাকে সাধারণ মানুষ ভেবেছে নাগরিকত্বহীনতা, তাদের এই ভয়ের আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করেছে বিজেপির নেতাদের কথাগুলো। পরবর্তী সময়ে এসেছে এসআইআর ফর্মে নাগরিকদের আবেদন করার পর্যায়টি। এই আবেদন ফর্মের ‘আবেদন’ প্রক্রিয়াটিকে ঘিরে অনেকগুলো প্রশ্ন করতে হয়। রাষ্ট্র নাগরিকত্ব প্রমাণ করার দায় চাপিয়ে দিচ্ছে নাগরিকের উপর, গোড়াতেই রাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে যে, সে অ-নাগরিক। রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে নাগরিকের প্রধান সম্পর্ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে সন্দেহের। আবেদন আমরা সেই বিষয়ের জন্য করি, যা বর্তমানে আমার নেই। ২০০২ সালের ভোটার তালিকাভুক্ত মানুষ যাঁরা ইতিমধ্যেই ভোটার তাঁদেরকেও আবেদন করতে হচ্ছে। এখানেই অধিকার বিষয়টির অস্তিত্ব প্রশ্নের মুখে এসে যায়। এছাড়াও এসআইআর ফর্মের বিন্যাস ও বয়ান নানা জায়গায় অস্পষ্ট, বিভ্রান্তিকর এবং সেই বিষয়ে জাতীয় নির্বাচন কমিশন নীরব থেকেছে, ফলস্বরূপ বহু উচ্চশিক্ষিত মানুষও ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে আতান্তরে পড়েছেন। ফর্ম বিলি, ফর্ম পূরণ ও জমা দেওয়ার সময় পর্বে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের বিএলও’দের উপর সৃষ্ট অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং সেই অসহনীয় কাজের চাপে একাধিক বিএলও-র আত্মহত্যা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মানবিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়টিকেই তুলে ধরে।

আরও পড়ুন-হরমনপ্রীতের দাপটে জয় ও হোয়াইটওয়াশ

প্রাথমিক খসড়া তালিকা প্রকাশের পরবর্তী সময়ে এসআইআর প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো আরও প্রকট হতে থাকে, সাথে বিজেপির যে মিথ্যাচার সেগুলিও মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। যে বিজেপি দেড় কোটি রোহিঙ্গার বসবাসের গল্প ফেঁদে রাজনৈতিক উসকানি দিতে চাইছিল সেই উসকানির পারদ আজ নেমে গেছে। যে ৫৮ লক্ষের নাম খসড়া তালিকায় বাদ গেছে তার মধ্যে মৃত ভোটার ২৪ লক্ষ ও স্থানান্তরিত ১৯ লক্ষ। জাতীয় নির্বাচন কমিশনের চটজলদি কাজ করার পরিণাম স্বরূপ জীবিত মানুষ আজ মৃত মানুষ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গের নাটাবাড়ির আলিমা বিবি থেকে দক্ষিণবঙ্গের ডানকুনির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের পুরপিতা সূর্য দে এর অন্যতম উদাহরণ, বাকি উদাহরণ অজস্র।
বিজেপি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বিজেপি পরিচালিত সরকার এবং সেই সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রের নাগরিকরা কেবল তাদের কাছে ভোট বাক্সের জন্য ব্যবহৃত সংখ্যা মাত্র। সিএএ-র নাম করে মতুয়াদের নাগরিকত্ব প্রদানের যে আশ্বাস তারা দিয়েছিল সেই আশ্বাস কার্যকর হয়নি। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা থেকে বাদ গিয়েছে ৭ লক্ষ ভোটারের নাম এঁদের বড় অংশই মতুয়া, এই মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা বর্তমানে সন্দিহান, তাঁরা সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্বের আবেদন করেও এসআইআর-এ ঠাঁই পাননি। নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিএএ কার্যকর হলেও নাগরিকত্বের অধিকারের প্রশ্নে বিজেপি সরকার কোনও ভূমিকা নেয়নি, বিজেপি সরকারের অন্যতম প্রতিমন্ত্রী মতুয়া সম্প্রদায়ের শান্তনু ঠাকুরের কথায় ১ লক্ষ মতুয়ার নাম এসআইআর থেকে বাদ গেলেও তাঁর এবং তাঁর সরকারের কোনও করণীয় যে নেই সেই বিষয়টি উঠে এসেছে।
সময় যত এগোবে এসআইআরের অন্তঃসারশূন্যতার দিকটি আরও প্রকট ভাবে ধরা দেবে, নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো ফিকে হবে, কল্যাণকর রাষ্ট্রের জায়গাটি অধঃপতিত হবে, ন্যায়ের প্রশ্নটি তলানিতে এসে ঠেকবে। কিন্তু মানুষের অধিকার, ন্যায়, অস্তিত্বের লড়াইয়ের জন্য জ্বলজ্বল করবে দুটি নাম—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়!

Latest article