পশ্চিমবঙ্গের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য ত্রিপুরা। ফলে, সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূল কংগ্রেসের অধিকতর শক্তিশালী হওয়ার লক্ষ্যে ত্রিপুরাই যে স্বাভাবিক গন্তব্য হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ব বনাম বাঙালিয়ানার লড়াইয়ে গোবলয়ের রাজনীতি হার মানতে বাধ্য হয়েছে জননেত্রীর কাছে। ডেলি প্যাসেঞ্জার হয়ে ওঠা মোদি-শাহকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন বাংলার অগ্নিকন্যা। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এবার ত্রিপুরায় সিঁদুরে মেঘ দেখছে গেরুয়া পার্টির দুয়ারে গুন্ডার সরকার।
ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেস মামলা-হামলা সত্ত্বেও অল্প সময়ের মধ্যেই বিরোধী শক্তির আসনে আসীন হয়েছে। আগরতলায় সিপিএমকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে এবং সারা রাজ্যে প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করছে এই মুহূর্তে। আর তাতেই আতঙ্কিত বিপ্লবের ভৈরব বাহিনী।
ক’দিন আগেই বিজেপির অত্যাচারে মৃত্যু হল তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী মুজিবর ইসলাম মজুমদারের। প্রয়াত কর্মীর বাবা মনসুর আলি কংগ্রেসি আমলে মন্ত্রী ছিলেন। মুজিবর ইসলাম কিছুদিন যাবৎ তৃণমূল কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। ত্রিপুরায় বিজেপির বাইক বাহিনীর অত্যাচারে প্রাণ গেল তাঁর। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরেও চলে গেলেন তিনি।
২০১৯-এ লোকসভার নির্বাচনের সময় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন মামুন খান। তাঁর ওপরেও আক্রমণ শানায় গেরুয়া গুন্ডারা। তাঁকেও কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত মামুন খান সুস্থ হয়ে ত্রিপুরায় ফিরে যান। ফের রাজনীতির ময়দানে প্রত্যাবর্তন। মুজিবর সে সুযোগ পেলেন না।
ত্রিপুরার বুকে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক দৃঢ়তা বৃদ্ধির মূল কান্ডারি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনবার ত্রিপুরা সফর করছেন। একবারও বিপ্লব দেবের পুলিশ তাঁকে সভা করার অনুমতি দেয়নি। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে বাধ্য হয়ে মাত্র একবার পাঁচশো মানুষের সভা করার অনুমতি পেয়েছিলেন তিনি। তাঁকে বহুবার বিজেপির বাইক বাহিনী আক্রমণ করেছে। কিন্তু প্রতিবার আক্রমণের পর তাঁর জেদ আর লড়াইয়ের ক্ষমতা বহুগুণিত হয়েছে। এটা বুঝেই বিজেপির শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি শুরু হয়ে গিয়েছে। গেরুয়া শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব। আগরতলার ২০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের স্বামীর হাতে আক্রান্ত হলেন রাজ্য সরকারের ইঞ্জিনিয়ার প্রশান্ত দত্ত। আবার এই প্রশান্ত দত্তর দিদি ত্রিপুরা রাজ্যের বিজেপি নেত্রী। তা সত্ত্বেও তাঁরই ভাইয়ের উপর আক্রমণ ঠেকানো গেল না। আসলে বিপ্লব দেবের সরকার এখন সবেতেই হারার ভূত দেখছে। তাই রাজ্যের সরকারি আধিকারিকও রেহাই পাচ্ছেন না।
আরও পড়ুন-১৪ জানুয়ারি শুরু হরিয়ানা তৃণমূলের জনসংকল্প যাত্রা
হারার ভয়, হারার ভূতের এমনই দাপট যে বিপ্লব দেবের সরকারের কোনও হুঁশ নেই নাগরিকদের দুরবস্থার বিষয়ে। হাতির তাণ্ডবে অতিষ্ঠ হয়ে তেলিয়ামুড়ার মানুষ নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে রাস্তার পাশে বসবাস করতে শুরু করেছেন। রাজ্য বন দফতরের তা নিয়ে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন আড়াআড়ি দু’ভাগে বিভক্ত। একপক্ষ শাসকদলকে সমর্থন করছেন। অন্যপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসকে চাইছেন। বিপ্লব দেবের নির্দেশে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের আক্রমণ, মিথ্যে মামলা করতে রাজি হচ্ছেন না অনেক পুলিশকর্তাই। আবার পুলিশের একাংশ বিজেপির গুন্ডাদের সঙ্গে মিলে আটকাতে চাইছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। যুব নেতা অভিষেক যথার্থই বলেছেন, তাঁকে আটকাতে যে পরিশ্রম করতে হচ্ছে পুলিশকে, তার পরিবর্তে যদি ত্রিপুরার মানুষের জন্য তাঁরা কিছু করতেন, তাহলে ত্রিপুরাবাসীর উপকার হত।
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমও আক্রান্ত ত্রিপুরায়। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে তৎপর হয়েছে দুয়ারে গুন্ডার সরকার। সাংবাদিকদের জনে জনে ফোন করে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিজেপি সরকারের একাধিক দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের খবর করে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ত্রিপুরা ইনফো ডট কমের প্রকাশক সৌমেন সরকার পরিষ্কার বলছেন, বিজেপি সরকার ভয় পাচ্ছেন সংবাদমাধ্যমকে। তাই এই হামলাবাজি। গত ২৩ নভেম্বরও ‘মৈত্রীসংবাদ’ পত্রিকার সম্পাদক সন্তোষ ভট্টাচার্যর বাড়িতে হামলা হয়। লাগামছাড়া দুর্নীতির খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়েই সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ। অভিযোগ, ‘ত্রিপুরা স্টেট রাইফেলস’-এর নিয়োগেও দুর্নীতি হয়েছে। চরিলাম বিধানসভার ব্রজপুর কেন্দ্রে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি তিন লক্ষ টাকা নিয়েও চাকরি পাইয়ে দেননি এক বেকারকে, এমন অভিযোগও বাতাসে ভাসছে। এরকম সব দুর্নীতির বিষয়ে চাকরিপ্রার্থীরা মামলা পর্যন্ত করতে পারছেন না। হাইকোর্ট চত্বর থেকে তাঁদের গ্রেফতার করছে বিপ্লব দেবের পুলিশ।
ত্রিপুরা এখন এক নেই-রাজ্যের দেশ। ত্রিপুরা এখন এক নৈরাজ্যের রাজ্য। সাধারণ মানুষ গাঁটের কড়ি খরচ করেও পানীয় জল পাচ্ছেন না বিজেপি সরকারের আমলে। আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে জলকর দিতে হবে ২৪০০ টাকা। ভোটের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো ১০ হাজার ৩২৩ জন শিক্ষকের চাকরি আর হল না। প্রতিশ্রুত ৩৪০ টাকা তো দূর অস্ত, একশো দিনের কাজের মজুরিতে ২০০ টাকাও পাচ্ছেন না গরিব মানুষজন। চার বছর হয়ে গেল, এখনও রাজ্যের পড়ুয়ারা সবাই স্মার্ট ফোন পেল না।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় চলছে চরম অব্যবস্থা। কোনও কোনও অঞ্চলে মিটার রিডিং নেওয়া হচ্ছে তো কোথাও হচ্ছে না। দিনের পর দিন কোনও মিটার রিডিং ছাড়াই ভূতুড়ে বিদ্যুতের বিল পাঠানো হচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে। বিশালগড়ের এক রিকশাচালকের বাড়িতে মাসিক বিদ্যুৎ বিল এসেছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। বিশালগড়ের আর এক মুদির দোকানের দোকানি বিদ্যুৎ বিল পেয়েছেন ৮৫ হাজার টাকার। বিদ্যুৎ অফিসে গেলে ঘুষের পরিবর্তে বিদ্যুতের বিল মেটানোর ঢালাও ব্যবস্থা। লুটেপুটে খাওয়ার বিপুল আয়োজন। চরম ভোগান্তি আমজনতার।
একদিকে ডবল ইঞ্জিন সরকারের সামগ্রিক দৈন্য, অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় রাজনীতিতে নির্ণায়কের ভূমিকায় উঠে আসা, এই দুইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ত্রিপুরা এখন এক ঐতিহাসিক প্রহরের আগমনের অপেক্ষায়।