প্রায় ৩৮০ দিন বাদে সাতশোরও বেশি কৃষকের মৃত্যুর পর দিল্লির ফ্যাসিবাদী সরকার বলল খানিক কেশে, ‘‘বড্ড বেশি কৃষক গেছে।/আইনের জটে ভেসে!’’ নিরবচ্ছিন্ন কৃষি আন্দোলনের চাপে সেই সঙ্গে পাঞ্জাব-উত্তরপ্রদেশের ভোটের দিকে তাকিয়ে আপাতত প্রত্যাহৃত হল কৃষি আইন। প্রধানমন্ত্রীর এই পিছু হটা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের সাফল্য। তবে ক্ষমতাসীন দলের এ হেন পশ্চাদপসরণ এই প্রথম না। শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ আইন থেকে শুরু করে, নাগরিকত্ব আইন বা জিএসটি সবক্ষেত্রেই আলোচনার পরিসর না রেখে আইন প্রণয়ন করতে গিয়েই সরকারকে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। জিএসটির ক্ষেত্রে মুখ রক্ষা হলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সিএএ-এনআরসি আইন ধামাচাপা দিতে হয়েছে আর কৃষি আইন নিয়ে তো ইউ টার্ন নিতে হল।
তবে এতে উল্লসিত হয়ে যদি ভেবে বসেন গণতন্ত্রের সামনে মোদীর বিলম্বিত বোধোদয় তবে তা আপনার নির্বুদ্ধিতার উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে। লক্ষ্ করবেন, টিভির পর্দায় মোদি বলেছেন, তিনি কৃষকদের মঙ্গল সাধনে ব্রতী ছিলেন। অধিকাংশ কৃষকদের সমর্থন তাঁর ঝুলিতে ছিলই শুধুমাত্র কিয়দংশের অনিচ্ছায় বা ভুল বোঝার (পড়ুন শয়তানির) দরুণ তিনি এই মহৎ রায় থেকে বিরতি নিলেন। কৃষক আন্দোলন মোদিদের চিন্তা ভাবনা আমূল পাল্টে দিয়েছে এ রকম ভাবটা ভুল। বরং আরও প্রকট করেছে তাঁর সেই মনোভাব, কৃষকদের তিনি আন্দোলনজীবী’ মনে করেন। অর্থাৎ, মোদি সরকার মোটেই স্বধর্মচ্যুত হয়নি। অযথা গণতান্ত্রিকতায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনও ব্যস্ততাই তাদের নেই। কারণ তিনি জানেন কৃষি রাজ্যের বিষয়। আর বর্তমানে এই ক্ষেত্রটি প্রায় প্রতিটি রাজ্যে যে অবস্থায় আছে তাতে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা সহজেই সম্ভব। দেশের ২০টি রাজ্যে চুক্তিচাষ আইনসিদ্ধ, ২৩টি রাজ্যে কৃষকদের থেকে সরাসরি ফসল কেনার ছাড়পত্র আছে, ২২টি রাজ্যে বেসরকারি মাণ্ডির স্বীকৃত, ২১টি রাজ্যে কৃষির পণ্যে ই-ট্রেডিং হয়। অর্থাৎ কর্পোরেট যা চায় তা বেশির ভাগটাই সম্পন্ন করা হয়ে গিয়েছে। এবার আইন প্রত্যাহৃত হলে ইতর বিশেষ পরিবর্তন হবে না।
কৃষি ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে কৃষকদের গরম কড়াই থেকে সিধা আগুনে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা হয়েছিল। কোনও রক্ষা কবচ ছাড়াই তাদের কর্পোরেট সংস্থার সঙ্গে মোকাবিলা করতে বলা হল। মিডলম্যান বা মহাজনরা তবুও কৃষকদের পরিচিত গাঁ-গঞ্জের মানুষ, কিন্তু কর্পোরেট সংস্থার এজেন্টরা বড় শহর থেকে আসবে। তাদের সঙ্গে চুক্তিচাষে আবদ্ধ হওয়ার পর তারা যদি কোনও সমস্যায় পড়ে বা তার দরুণ জরিমানা হয় তা হলে আদালত যাওয়ার কোনও অবকাশ কৃষি আইনে ছিল না।
সংস্কার প্রয়োজন ছিল কৃষিক্ষেত্রে, এই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু গণতন্ত্রকে পদদলিত করে, বিরোধিদের সঙ্গে বা কৃষক সংগঠনের সঙ্গে কোনও আলোচনায় না গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে প্রজাগণ্য করে গায়ের জোরে অধ্যাদেশ এনে যে সংস্কারের আয়োজন হয়েছিল তা ছিল সর্বাংশে ভুলে ভরা। যে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে মুখর ছিলেন সংস্কার করতে গিয়ে তার মূলেই তিনি কুঠারাঘাত করলেন। এম.এস.পি-র নিশ্চয়তা নেই অথচ কর্পোরেট সংস্থা সরকারের কাছে এফ.সি.আই.-তে খাদ্য পণ্য মজুত রাখার মূল্য সুনিশ্চিত আছে।
নব্বইয়ের দশকে যখন আই.এম.এফ-এর সহায়তায় নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতির সংস্কার এনেছিলেন তখনও বিরোধী স্বরকে সম্মান জানিয়েই পথ বার করা হয়েছিল যে পথ ধরে অটল বিহারী বাজপেয়ীও হেঁটেছিলেন। ২০০৮ সালে পরমাণু চুক্তির সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার ফেলার চেষ্টা করেছিল বাইরে থেকে সমর্থন দেওয়া বাম দলগুলি একযোগে, প্রধানমন্ত্রীর ছোট্ট উত্তর ছিল প্রকাশ কারাতের প্রতি ”So be it.” বাকিটা ইতিহাস। অর্থাৎ সংস্কার করতে একটি শক্ত সমর্থ মেরুদণ্ড সঠিক দিশা দৃঢ় প্রত্যয় প্রয়োজন। ছাতির মাপ ৫৬ না ৫.৬ সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আরও পড়ুন: জঙ্গিপুর-ধুলিয়ানে আসন্ন পুরসভা নির্বাচন, শীতঘুমে বিরোধীরা, সক্রিয় তৃণমূল
প্রধানমন্ত্রী এক সময় কৃষকদের আয় বৃদ্ধির বারবার স্বপ্ন দেখাতেন। ২০০২-০৩ থেকে ২০১৫-১৬ এই সময়কালে দেশের মাথা পিছু আয় ৫ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে। কিন্তু চাষি পরিবারের আয় বেড়েছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ। মাঝখান থেকে কৃষি সংস্কার স্বখাত সলিলে। ভারতীয় অর্থনীতিতে বড় কৃষক বা আড়তদারের যে কর্তৃত্ব তা খর্ব করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কর্পোরেট বা বিদেশি বিনিয়োগ এনে রাতারাতি বিরাট পরিবর্তন করা যাবে বিষয়টি, এতটা অতি সরলও নয়। আবার বিদেশি পুঁজিমাত্রই বিষবৎ পরিত্যাজ্য এই মত পোষণ করাও আর এক বলখিল্যতা। মুক্ত বাজারের অলিখিত নিয়ম হল, পুঁজির শাসন সবাই মেনে চলবে, এ ভাবনা অবাস্তব। তাই প্রয়োজন সরকারি হস্তক্ষেপ। এই হস্তক্ষেপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দুইই হতে পারে, দেশের মিশ্র অর্থনীতির শর্ত অনুযায়ী।
কৃষিই ভারতের ৫৮ শতাংশ মানুষের রুজি রুটির একমাত্র পন্থা। কৃষির বাজারে মুক্ত অর্থনীতির প্রবেশ ঘটাতে গেলে কৃষকদের জন্য বিমা, প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, আইনি সুরক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থা না রেখে বাজার মুক্ত হলে আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির বড় অবলম্বন, গণবন্টন বা রেশন ব্যবস্থা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ খাদ্যপণ্যের বাজারে যখনই বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটবে তখন পণ্যের চাহিদা বাড়ার দরুণ দাম বাড়বে। দাম বাড়লে তার প্রভাব গ্রামীণ অর্থনীতিতে পড়বে। কর্পোরেট মুখী কৃষি আইন সে দায় স্বীকার করেনি।
কৃষকদের দুটি দাবি—বিদ্যুৎ বিল ও ফসলের গোড়া পোড়ানোর ক্ষেত্রে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তা রদ করা। এসব সরকার মোটামুটি মেনে নিয়েছে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির অপসারণের বিষয়টি কিন্তু সরকার মুখে কলুপ এঁটেছে। তবে কি ক্ষমা চাওয়া আদতে নাটক ছিল? যে নাটকের আর একটি অঙ্ক পাঞ্জাবে অভিনীত হল? এবার কেন্দ্রীয় সরকার দণ্ডবিধি পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক। এবং সেই উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, দেশের সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সব হাইকোর্টের বিচারপতি ও সাংসদদের চিঠি দিয়েছেন। কৃষির মতো আইনশৃঙ্খলাও রাজ্যের বিষয়। তাও, ফ্যাসিবাদী সরকার যে এবার সবাইকে নিয়ে পথ চলার নাটক করছেন, তার পেছনেও কৃষক আন্দোলনের জয় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।