এক যে ছিল মেয়ে। দীঘল, ছিপছিপে, খেলুড়ে। সুযোগ পেলেই ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বল পিটিয়ে বেড়াত মাঠে। আর জিততে চাইত সারাক্ষণ। নদীয়ার চাকদহের মতো মফসসলে যা স্বাভাবিক নয়। তাতে অবশ্য কিছু এসে যেত না মেয়েটির। হ্যাঁ, একদম ছোট্ট থেকেই বাবুল ওরফে ঝুলন (Jhulan Goswami) ছিল এরকমই। কিন্তু ১৯৯২-এর ওয়ার্ল্ড কাপ টিভিতে দেখার পর মন ঘুরে যায় ঝুলনের। ফুটবল থেকে ভালবাসা সরে যায় ক্রিকেটে। তখন ঝুলন বছর পনেরোর। কিন্তু সেই সময়ে একটি মেয়ের ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে ভাবা যতটা বিরল ছিল, ততটাই কঠিন ছিল চাকদহের মতো জায়গা থেকে ট্রেনিং করা। আর সেই কঠিন কাজটাই ঝুলন করে দেখিয়েছিলেন ওই স্কুলে পড়া বয়স থেকে। চাকদা থেকে কলকাতা ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে বিবেকানন্দ পার্কে কোচ স্বপন সাধুর কাছে প্রথাগত ট্রেনিং শুরু করেন তিনি ! আত্মীয়-পরিজনের বাঁকা হাসি, তির্যক মন্তব্য সয়ে চালিয়ে গিয়েছিলেন লড়াই, এমনই ছিল জেদ, এতটাই ছিল স্বপ্নপূরণের খিদে। আর এভাবেই চাকদহের ফ্রেন্ডস ক্লাব আর নবারুণ সমিতির মাঠে ক্রিকেট শুরু করা বাবুলের ঝুলন গোস্বামী হয়ে ওঠা। ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার ঝুলনের (Jhulan Goswami) আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেটে প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করা। ২০০৭-এ আইসিসি বর্ষসেরা মহিলা ক্রিকেটার নির্বাচিত হওয়া। ২০১০-এ অর্জুন পুরস্কার ও ২০১২-তে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপ্ত হওয়া।
বিনয়ী ঝুলন এগুলোর কোনওটাকেই ‘বিরল’ মনে না করলেও, ‘প্রথম জীবনের স্ট্রাগল সবারই থাকে, কারো কম, কারো বেশি,’ বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও, আসলে যে পুরো জার্নিটাই বিরল, ব্যতিক্রমী, দৃষ্টান্তমূলক তা সারা পৃথিবী মানে। আর এই লড়াইয়ের ছবিই সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার জন্য ঝুলনের বায়োপিক বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বাঙালি হিসেবে বাড়তি গর্ব ছিল আমাদের, ছিল অপেক্ষাও। প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছিল। শুরুতে কথা ছিল পরিচালক সুশান্ত দাস ছবিটি করবেন হিন্দিতে। আর ঝুলনের চরিত্রে অভিনয় করবেন অনুষ্কা শর্মা। প্রযোজনা করবে তাঁর নিজেরই প্রযোজনা সংস্থা ‘ক্লিন স্লেট ফিল্মজ’। ইডেনে এসে ঝুলনের সঙ্গে অনুষ্কাকে কথাবার্তা বলতে ও ট্রেনিং করতেও দেখা গিয়েছিল। ভারতীয় ক্রিকেটের ফার্স্ট লেডি হিসেবে অনুষ্কা যে স্বামী বিরাট কোহলির কাছেও জোর তালে ক্রিকেট শিখছেন এ-ও শুনে ঝুলন ও অনুষ্কার ফ্যানেরাও উৎসাহিত হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই ভাটা। অপেক্ষা দীর্ঘতর হওয়া। পরিচালক যে পরিবর্তিত হয়েছিল সে খবর আগেই মিলেছিল। মাঝে খবর রটেছিল অনুষ্কা নিজেও আর ছবিটি করবেন না। তাঁর জায়গায় নতুন মুখের সন্ধান শুরু হয়েছিল। আর এসবের মাঝেই পরে ঠিক হওয়া মিতালি রাজের বায়োপিক ‘সাবাস মিঠু’র কাজ শুরু হয়ে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি রিলিজ হওয়ার পথে কিন্তু ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’-এর কোনও নিশ্চিত খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু শোনা গিয়েছিল, ২০২২-এ ছবির শুটিং শুরু হওয়ার কথা।
আরও পড়ুন-ঋষভ-বুমরায় জয়ের হাতছানি
বহু প্রতীক্ষিত সেই খবরেই শেষ অবধি সিলমোহর দিলেন অনুষ্কা শর্মা স্বয়ং। তাঁর প্রোডাকশন হাউস ‘ক্লিন স্লেট ফিল্মজ’ই প্রযোজনার দায়িত্বে। আর ঝুলনের (Jhulan Goswami) চরিত্রে অভিনয়ও করবেন তিনি নিজেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একটি লুক-এর ছবিও দিয়েছেন তিনি। ছবির ‘টিজার’ও প্রকাশ করেছেন। সেই সঙ্গে জানিয়েছেন, ছবিটি করতে তিনি কতটা আগ্রহী। কারণ ঝুলনের লড়াইয়ের কাহিনি শুনে ও ঝুলনের সঙ্গে কথা বলে তিনি নিজে ভীষণই উদ্দীপিত। “সবাই সফল ঝুলন গোস্বামীকে চেনেন। কিন্তু সেই সাফল্যের জন্য তাঁর অধ্যবসায়, তাঁর প্রতিদিনের সংগ্রাম, তাঁর অনমনীয় জেদের কথাও সকলে দেখতে পাবেন ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’-এ। ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর পুরো সফরের ছবিই ধরা হবে”, জানিয়েছেন অনুষ্কা। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছিলেন ঝুলন। অল্পের জন্য তাঁরা হেরে যান কিন্তু সারা বিশ্ব দেখেছিল ভারতীয় মহিলা টিমের লড়াই। অনুষ্কা আরও জানিয়েছেন, ‘ছবিটি আমার কাছে বিশেষ হতে যাচ্ছে, কারণ, এটা অসাধারণ একটা আত্মত্যাগের গল্পও। যে সময় তিনি দেশের জন্য লড়াই শুরু করেছেন, সেই সময় মহিলা ক্রিকেট টিমকে গুরূত্ব কোনওস্তরেই সেভাবে দেওয়া হত না। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক ঝুলন গোস্বামীর চরিত্রে অভিনয় করতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।‘
ছবিটির কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন অভিষেক ব্যনার্জি। টিজারটি প্রকাশিত হয়েছে নেটফ্লিক্সের তরফে। আর ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’ -এর পরিচালনার দায়িত্বে এসেছেন প্রসিত রায়। প্রসিত কলকাতারই ছেলে। এর আগে অনুষ্কার প্রোডাকশন হাউসেই ২০১৮-তে ‘পরী’ ছবিটির মাধ্যমে তাঁর পরিচালনায় হাতেখড়ি। ‘পরী’তে অনুষ্কার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন আর এক বাঙালি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’-এর কাজ শুরু করার জন্য পুরো টিমই ভীষণ উৎসাহী। অপেক্ষায় দর্শকেরাও।