পুঁথিপত্রের নারী নন, তাঁরা খেটে-খাওয়া আম আদমি থুড়ি আম ঔরত। সকাল থেকে রাত— পেটের দায়টাই যাঁদের কাছে বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য। নেই নারীদিবস নিয়ে মাথাব্যথা। নেই ফেমিনিজমের জ্ঞানগম্যি। গলি থেকে ফুটপাত এবং চৌরাস্তায় প্রতিনিয়ত এ-দেশের নারীর স্বাধীন মানচিত্রে জ্বলজ্বল করছেন এঁরাই। লিখেছেন বিতস্তা ঘোষাল
নারীদিবস কাকে বলে জানা নেই। জানা নেই মহিলাদের অধিকার নিয়ে এখন কত আইন আছে। জানে না রাজ্য বা কেন্দ্রে নারীর সুরক্ষার জন্য মহিলা সেল আছে। এ-ও জানে না ফেমিনিজম বলে একটা কথা আছে। মি টু শব্দটার মানে কী! শুনে অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
বিখ্যাত লোক বলতে জানে ‘মমতা দিদি’, আলিয়া ভাট-সহ গুটিকয়েক নাম। ‘মমতা দিদি’ কে হন? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে হেসে বলে— দিদি দেশ চালান। আমাদের কথা ভাবেন।
আরও পড়ুন-এক দলিত মেয়ে এক আকাশ স্বপ্ন
সাহিত্য জগৎ— সেটা কী? তাতে পেট ভরে? টাকা আসে?
সাংবাদিক? খবরের কাগজ?
ওই যে যারা টিভিতে খবর করে। মাইক হাতে ধরে দৌড়ায়।
ইচ্ছে করে না ওভাবে তুমিও টিভিতে এস।
না, বাবা, ও-সব পারব না।
এদের প্রত্যেকেরই প্রায় পুঁথিগত শিক্ষা নেই বললেই চলে। মুখে মুখে হিসেব রাখেন।
এ হিসেব জীবনের। এই জীবনবোধই তাদের শিখিয়েছে সংসার চালাতে গেলে একা পুরুষের কাঁধে বন্দুক রেখে আর পেট ভরে না। রোজগার না বাড়ালে সন্তান পড়ানো, পরিবার চালানো অসম্ভব। তা ছাড়া বর-বউ আলাদা করে কিছু করার দরকার কী! দুজনে মিলেই তো সংসার।
তাই সকাল থেকে নেমে পড়ে তাদের ছোট্ট হেঁশেল সামলাতে। নিজের হাতে রান্না, কুটোনো অবশ্য কেটে দেয় বর।
মশলা তৈরি করে নিজেরাই বাড়িতে। আঠারো রকম উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় গরম মশলা। কয়েকটি নাম উল্লেখ করলেও বাকিটা বলে না। কারণ সেটা তাদের একান্ত নিজের। কিন্তু ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনম। তাই গন্ধ শোঁকায়। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় মুচকি হেসে। বলতো, কী কী আছে?
গরম হাতে-গড়া রুটি, কাকঁড়া আর মুরগির তুলতুলে মাংস মুখে দিয়ে বোঝার বৃথা চেষ্টা করি।
আরও পড়ুন-ফের গোয়া সফরে অভিষেক
দ্রৌপদীর রান্না আমার খাওয়া হয়নি। কিন্তু এ-কথা হলফ করে বলতে পারি বড় বড় অনেক মাস্টার কুক হার মানবেন।
নাহ্, এ-সব প্রশস্তিতে কিছুই যায় আসে না তাদের। বরং লাজুক হাসি আর খুন্তি নাড়ার আত্মবিশ্বাসে স্তম্ভিত হই, মুগ্ধ হই।
নাম তার শাহিদা। নাম তার রমা, বীণাও হতে পারে। কিংবা মেরি। এদের সঙ্গে দেখা হয় হাইওয়ে থেকে গলির গলি, তস্য গলিতে, ফুটপাত থেকে চৌরাস্তায়, দীঘা তাজপুর মন্দারমনণি, পাড়ার মোড়ে, অফিস পাড়া কোর্ট চত্বর, বইপাড়া… সর্বত্র।
সারা ভারত জুড়ে এমন সব মেয়েরাই যুগযুগান্তর ধরে সকলের অলক্ষ্যে, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে বহু পরিবারের চালিকাশক্তি। তাদের হাতেই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে।
কেউ তারা হোম স্টে চালায়, কেউ বা চায়ের দোকান, কেউ বা রুটি তরকারি, মুড়ি চপ, বেগুনি। পাহাড়ে দেখেছি গ্যাস সিলিন্ডারও পিঠে নিয়ে পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে আসছে।
আরও পড়ুন-ফের গোয়া সফরে অভিষেক
পাড়ায় পাড়ায় ভোর থেকে যত ফুল বিক্রি হয়, দেবতার চরণে যাবার জন্য লাইন পড়ে যেখানে, ফুলওয়ালি মাসি, দিদি বলে রাত সাড়ে তিনটেয় ঘর থেকে বেরিয়ে ফুল কেনে আড়তদারের কাছে। তারপর ট্রেন ধরে ছড়িয়ে যায় শহর থেকে শহরতলি।
শুধু কি ফুল? সবজি বা মাছ বিক্রেতা নারীর সংখ্যাও কম নয়। প্রত্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলের অনেকেই এখন জীবন ধারণের প্রয়োজনে ছোট্ট ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নদীতে মাছ ধরতে। এমনই দুই মহিলার সঙ্গে দেখা হল সম্প্রতি। বললেন— বেঁচে থাকাটাই যখন প্রধান উদ্দেশ্য তখন পেট চালাতে গেলে যা পারি সেটাই করব। ছোট থেকেই নদীর সঙ্গে বাস। তাই জীবনসংগ্রামেও নদীই ভরসা। তাদের মুখেই জানলাম, এখন বহু মহিলাই এভাবে মাঝনদীতে গিয়ে মাছ ধরে আনে রাত থাকতেই। ভোরে তাই নিয়ে নিজেরাই পৌঁছে যায় বাজারে। এতে তাদের হাতে সরাসরি টাকা উঠে আসে।
তাদের ঘরের অধিকাংশ ছেলে হয় বাঘের থাবায় আহত, নয় কুমিরের পেটে।
আপনাদের সে ভয় নেই? এমন তো আপনাদের সঙ্গেও হতে পারে।
ভয় পেলে পেট চলে না। তাদের নির্ভেজাল উত্তর।
আরও পড়ুন-ফের গোয়া সফরে অভিষেক
আবার ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে এগোলে দেখা যায় পেট্রোল পাম্পে তেল দিচ্ছে মেয়েরাই। আগে এমন মেয়ে শুধু মাত্র দেখা যেত উডল্যান্ডস নার্সিংহোমের উল্টোদিকের পেট্রোল পাম্পে। এখানেই যে স্ন্যাক্স কাম বার এখন সেটাও আগে নারী-পরিচালিত ছিল। সময়টা নব্বই দশকের শেষে। অনেকেই সেই পাম্পে যেত শুধু তাদের দেখার জন্য। সময় বদলেছে। এখন পাল্টে যাওয়া অর্থনীতিতে শুধু কলকাতা নয়, শহরতলি জুড়ে এদের সঙ্গে দেখা মেলে। ডানলপ থেকে সাউথ সিঁথি, বালিগঞ্জ থেকে হাইওয়ে।
এখন এদের মধ্যেই কেউ চালাচ্ছে বাস, কেউ ট্যাক্সি, উবের। মূল উদ্দেশ্য একটাই। সংসার প্রতিপালন। যতগুলো বিউটি পার্লার বা সাঁলো তার নিয়ন্ত্রকও বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা মেয়েরাই। হয়তো তাদের গা দিয়ে ঘামের গন্ধ আমরা টের পাই না উগ্র পারফিউমের আড়ালে। কড়া মেক আপ, হাইলাইট করা চুল, চোখের কাজলে ঢাকা ক্লান্ত মুখ।
শখ করে এসেছ?
কথা বলে দেখেছি, এদের বক্তব্যগুলো প্রায় একই রকম।
সংসার চালাতে পয়সা চাই।
আমাদের অত শখ করলে চলে না।
উপায় নেই দিদি। বর কিছু করে না।
নেশাভাঙ করে। মারে।
বরকে ছেড়ে দিয়েছি। আমি রোজগার করব, আর বসে বসে নেশা করবে? মারবে? অমন সোয়ামির মুখে…।
আইন আদালতে যাওনি? প্রশ্নে বেশ বিরক্তি।
ওসব বড়লোকদের। এই তো বেশ আছি।
সমাজ সম্মান দেয়?
উত্তর পাই নিমেষেই। আগে নিন্দা শুনতাম, বিচ্ছিরি ইঙ্গিত আসত। কিন্তু থেমে থাকলে চলবে না। পেট কোনও কথা শোনে না, মানে না।
সবটাই কি তা হলে পেটের তাগিদেই? মন থেকে, শখে বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যে কথা আমরা প্রতিনিয়ত বলি, শিক্ষার কথা বলি, সেগুলোর কোনও মূল্য নেই এদের কাছে?
নাহ্! মন বা শখ বা স্বাধীনতা নিয়ে এরা ভাবতে রাজি নয়। এরা বুঝে নিয়েছে জীবনসংগ্রামে অন্নসংস্থান করারটাই সবচেয়ে বেশি দরকার।
টিভি দেখ?
সব বাজে। ‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’র বাইরে কিছু দেখায় নাকি! এই তো আমি আমার শাশুড়ি, ননদ মিলেই কাজ করি, ভাবি না তো বিষ দেব, ক্ষতি করব! ওসব বড়লোকদের গল্প। সেখানে এসব হয় বোধ হয়!
চমকে যাই শুনে। বলি, কেন সব গল্পেই তো তোমাদের মতো মেয়েরাই নায়িকা।
হাসে, এত জোরে হাসে বুকে এসে লাগে। হাসি থামলে বলে— আমাদের মতো মেয়েদের সত্যিই কি তোমরা বউ করে নিয়ে যাবে? আর যদি যাও তবে এত অত্যাচার করবে কেন? কিছু মনে কোরো না দিদি, তোমাদের মতো শিক্ষিত, লেখাপড়া জানা লোকেরাই মেয়েদের এত ছোট করতে পার! আমরা কারও ক্ষতি করার সময় পাই না।
স্তম্ভিত হয়ে যাই এ-হেন উচ্চারণে। এ-যেন সপাটে চড় মারল গালে। হাত না উঠিয়েই।
এদের দেখতে দেখতে, কথা বলে, বেশ কিছু মুহূর্ত একসঙ্গে কাটিয়ে বড় ক্লিশে মনে হয় সো কলড ফেমিনিজম। দাবি আর আদায়— এই দুইয়ের মধ্যে কোনওটাতেই বিশ্বাসী না হয়ে প্রান্তিক এই মেয়েরা বদলে ফেলছে অর্থনৈতিক ভিত্তি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের অজান্তেই বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে কবে, নীরবে, নিরুচ্চারে। কোনও প্রচারের আলোয় না থেকেই। তারাই যেন বলছে—
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথা তারা না জেনেও চিনিয়ে দিচ্ছে নিজেদের। নিজের মতো করেই গড়ে নিয়েছে এই স্বাধীন নারীর মানচিত্র। আর এখানেই সব যদি বাদও দিই, তবু আশা রাখি বিশ্বব্যাপী একদিন এরাই হবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। আপামর মানুষ এদের জানাবে কুর্নিশ।