৩৪ বছর আগের কথা। ১লা বৈশাখ উপলক্ষে কলকাতা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে একটা বিরাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে আমি সাংবাদিক হিসাবে ভি আই পি জোনের মধ্যে ছিলাম। মূল আকর্ষণ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর তথা কলকাতা ও বোম্বের সিনেমা এবং গানের জগতের রথী-মহারথীরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন পশ্চিবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী সস্ত্রীক জ্যোতি বসু।
ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ছিল। মূলমঞ্চের সামনে সোফায় বসে ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। তাঁর একটু তফাতেই বসে ছিলেন জ্যোতি বসু। মঞ্চে তখন গান গাইতে উঠেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কয়েকটা গান গাওয়ার পর তিনি ‘রানার ছুটেছে রানার’ ধরলেন। লক্ষ করলাম, হেমন্তবাবুর গানের তালে তালে মাটিতে পা ঠুকছেন লতাজি এবং মাথাটাও দুলছে। গানটা যে তিনি উপভোগ করছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গান শেষ হতেই লতাজি তাঁর শ্রদ্ধার মানুষটির উদ্দেশ্যে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন। একদম দাদা বোনের সম্পর্ক ছিল। তারপর সেই দেখে লতার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন জ্যোতিবাবু। হয়তো উনিও সেই জিনিসটা লক্ষ করেছিলেন। এবার হেমন্তবাবু আর লতা গাইবেন। তা হেমন্তবাবু নিচে নেমে আসার আগেই, লতাজি চটপট মঞ্চে উঠে গেলেন। সল্টলেক স্টেডিয়াম তখন দর্শকের করতালিতে ফেটে পড়ছে। হেমন্তবাবু দর্শকদের উদ্দেশ্যে লতাজিকে দেখিয়ে বললেন – লতা (Lata Mangeshkar) আমার ছোট বোন। এবার ও গাইবে। আপনারা ওঁর গান শুনুন। হেমন্তবাবুর পা ছুঁয়ে লতা আবেগমন্দ্রিত গলায় বললেন – দাদা আপ হামে আশীর্বাদ কিজিয়ে। ম্যায় ঠিকসে গা শকু।
লতাজি হেমন্তবাবু সম্পর্কে বলেছিলেন -তিনি শুধু গায়ক হিসেবে নন, মানুষ হিসেবেও অনেক বড় মাপের মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনেও হেমন্তদা অনেক সাহায্য করেছিলেন অভিভাবকের মতো।তাঁর সাথে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল।
আরও পড়ুন – লতাকে শ্রদ্ধা জানাতে স্মারক ডাকটিকিট
লতাজির রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার পেছনেও হেমন্তবাবুর উৎসাহ ছিল। রবীন্দ্রনাথের গান ঠিকভাবে গাইতে পারবেন কী না, সেবিষয়ে লতাজির ভয় ছিল। ‘তোমার হল শুরু, আমার হল সারা ‘, ‘তুমি রবে নীরবে’, এরকম বেশ কিছু গান হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকরের আমরা শুনেছি। আমাদের ভালো লেগেছে। আমাদের সম্পদ হয়ে আছে। লতাজি আরও বলেছিলেন, আমার সেরা দশটা হিন্দি গানের মধ্যে হেমন্তদার ‘বিশ সাল বাদ’ ছবির ‘কাহি দীপ জ্বলে কাহি দিল’ গানটি অন্যতম।
বাংলার তাঁতের শাড়ি, মিষ্টি, এখানকার শ্রোতা লতাজির খুব পছন্দের ছিল। হেমন্ত তাঁর জন্য তাঁতের শাড়ি আনতেন। তাঁতের শাড়ি পরতেন। একসময় তাঁর লম্বা চুল ছিল, তিনি দুদিকে বেণী বাধঁতেন। হেমন্তদা তাঁকে দেখে বলতেন, লতাজিকে আদ্যোদ্যপান্ত বাঙালি মেয়ে লাগছে।
লতা বলতেন, আমি সবাইকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করিনা। হেমন্তদাকে প্রণাম করতে ভালো লাগে। এর থেকেই বোঝা যায় যে, লতাজি আর হেমন্তবাবু মধ্যে কতটা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল! সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাসগুপ্তদেরপ্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সঙ্গীত, শিক্ষা, শিল্পের পীঠস্থান হিসেবে বাংলার প্রতি তাঁর অগাধ টান ছিল।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও লতা মঙ্গেশকরের (Lata Mangeshkar) অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। মাঝেমাঝেই দুজনের ফোনে কথা হতো। মাসকয়েক আগেও কথা হয়েছে। মাঝখানে সন্ধ্যাদি একটি খবরের কাগজে লতাজিকে নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। সেটা আবার লতাজি বোম্বেতে কোনওভাবে পড়েছিলেন। পড়ে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, সন্ধ্যা তুম মেরে বারেমে ইতনা আচ্ছা কুছ লিখা, মেরে আঁখো মে আঁশু আগেয়া। দুজনে বন্ধু ছিলেন। লতাজি কথায় কথায় বলেওছিলেন – শরীর ভালো থাকেনা। পা ভারী হয়ে গেছে। আর বাইরে বেরোন না। বাড়ির কাজের লোকটিই আমার দেখাশুনা করে। ঠাকুরঘরে বা নিজের ঘরেই বসে থাকি।
লতাজি স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত ছিলেন। ওঁর গলায় স্বামী বিবেকানন্দের লকেট থাকতো সবসময়। ওঁর ঠাকুর ঘরে রামকৃষ্ণ-সারদা, বিবেকানন্দের ছবি আছে। তিনি তো গণেশরও ভক্ত ছিলেন। গনেশচতুর্থীতে পুজো করতেন।
মাঝে মাঝে লতাজি কলকাতায় যখন আসতেন, তখন তিনি উঠতেন হেমন্তবাবুর বাড়িতে। হেমন্তবাবুর মায়ের সাথে লতাজির অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। হেমন্তবাবুর মা মারাঠি রান্না জানতেন না বলে লতাকে একটা স্টোভ দিয়েছিলেন। হেমন্তবাবু যখন পরিবার নিয়ে ভবানীপুরে থাকতেন তখন স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে লতা মঙ্গেশকরকে দক্ষিণেশ্বর, বেলুড়মঠ দর্শন করেছেন। শান্তিনিকেতন ও লতাজি ওঁদের সঙ্গেই গিয়েছিলেন।
ষাট-সত্তরের লতাজি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও থাকতেন। সন্ধ্যাদি একদিন বোম্বের এভারগ্রিন হোটেলে উঠেছেন। সেখানে শচীন দেববর্মন, রাহুল দেববর্মন ছিলেন। লতাজি সেখানে সন্ধ্যাদির সাথে দেখা করতে আসতেন। সন্ধ্যাদির মা সেই হোটেলে রান্না করেছেন, লতাজি খেয়েছেন। লতাজি কখনও টক খেতেন না গানের জন্য।
লতাজির সঙ্গে আরতি মুখোপাধ্যায়েরও খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি আরতিকে বেবি বলে ডাকতেন। মান্না দে কোন এক স্টুডিওতে রেকর্ডিং সময় নিয়ে গিয়ে লতাজির সাথে আলাপ করিয়ে দেন। আরতিকে খুবই স্নেহ করতেন। যখন আরতিদির ‘গীত গাতা চল’ সুপারহিট তখন লতাজি আরতিদিকে খুব উৎসাহ দিতেন।
সরস্বতীর আশিসধন্য হয়েও পারিবারিক জীবনে প্রচুর কষ্ট পেয়েছেন। বারো বছর বয়সে গান শুরু করলেন। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছেই সংগীতের হাতেখড়ি। এরপর হঠাৎ করে দীননাথ মঙ্গেশকরের মৃত্যু হয় এবং দারুন অভাবের মধ্যে পরতে হয়। তখন পুরো পরিবারটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। দুটো মাত্র শাড়ি ছিল। একটা শাড়ি পরে বেরোতেন। রাতে ফিরে সেই শাড়িটাই ধুয়ে, বাসি শাড়িটা ছেড়ে পরেরদিন আবার পরে বেরোতেন। পরবর্তীকালে সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি সবই পেয়েছেন। ভারতরত্ন পেয়েছেন, তাঁকে সুরসম্রাজ্ঞী বলা হয়েছে। আসলে তিনি গানের মাধ্যমে ভারতবাসীকে একসুতোয় বেঁধে রেখেছিলেন। তাঁর গলায় ‘এয় মেরে বতন কে লোগো’ শুনে জওহরলাল নেহরুর চোখে জল চলে এসেছিল। সেই সুরসাধিকা এবার চলে গেলেন।