কিছু কিছু জিনিস জানতে বুঝতে বা টের পেতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার পড়ে না। সাদা চোখেই কালোটা ধরা পড়ে যায়। এবারের কেন্দ্রীয় বাজেট তেমনই একটা বিষয়। এতে যে গরিবগুর্বো মানুষগুলো ভয়ঙ্কর রকমের উপক্ষিত, সে-কথা বোঝার জন্য অর্থনীতিশাস্ত্রে বিশারদ হওয়ার দরকার নেই। সত্যি চিত্রটা খালি চোখেই পড়া যাচ্ছে।
প্রথমেই ধরা যাক মিড-ডে মিল প্রকল্পের কথা, গত বাজেটেই এ-বাবদ বাজেট বরাদ্দ ২০১৩-‘১৪-র তুলনায় ১ শতাংশ কম ছিল। এবার তাতে আরও কাটছাঁট। স্কুলগুলো বন্ধ ছিল। কিন্তু বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো তো আর শীতঘুম দিচ্ছিল না। তাদের খিদে ছিল। অপুষ্টি ছিল। বিশ্বক্ষুধা ও অপুষ্টি সূচকে ভারতের অবস্থান মোটেই ভাল নয়। কেন্দ্রীয় সরকার ওই সূচকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্ধিহান। এনিয়ে ঊষ্মা প্রকাশেও অকুষ্ঠিত। কিন্তু এ-সংক্রান্ত রিপোর্ট চ্যালেঞ্জ করে কোনও সুনিদিষ্ট তথ্য উপাত্ত তারা সামনে আনতে পারেনি। সাম্প্রতিকালে শীর্ষ আদালতে মোদি সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, না-খেতে পেয়ে মানুষ মরেছে, এ-সংক্রান্ত কোনও তথ্য তাদের কাছে নেই।
গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ প্রকল্প এমজি নরেগা প্রকল্প। অতিমারির সময়ে যারা দরিদ্রতর হয়েছে তাদের টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই প্রকল্পের গুরুত্ব সমধিক। গত বছর এই খাতে তার আগের বছরের তুলনায় দুই-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল। পরে তা প্রায় ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। তাতেও কিন্তু সব চাহিদা মেটেনি। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে বকেয়া মজুরির বিপুল পরিমাণই তার প্রমাণ। তবু এবারের বাজেটে গত বাজেটের মতোই বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির যে বিপুল বন্দোবস্ত রয়েছে তার সুবাদেই এমজি নরেগা-র মতো প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ফুরোবে। শুনতে ভাল লাগলেও, বাস্তব সত্য অন্য কথা বলছে। দেশে বেকারত্ব তীব্রভাবে বাড়ছে। অতিমারি-উত্তর পর্বে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের বিষয়ে কোনও তথ্যও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। তবে আমরা ভালভাবেই জানি, এরকম শ্রমিকদের (Poor People) একটা বড় অংশ এমজি নরেগার সুবিধা ভোগ করে থাকেন।
শিক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দ প্রায় ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। অতি উত্তম ! কিন্তু যখন অর্থমন্ত্রী সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের পড়াশোনার ঘাটতি মেটানোর নিশ্চয়তা দেন এবং সেই সঙ্গে জানান, এই ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা হিসেবে তিনি ২০০টি টিভি চ্যানেল খোলার আয়োজন করেছেন, সেই সঙ্গে ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে উচ্চমানের ‘ই-কনটেন্ট’ পড়ুয়াদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আয়োজন করেছেন, তখন পুরো আয়োজনটাই একটা অর্থহীন প্রদর্শনের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মনে হয়, এ-সবই যেন অন্য গ্রহের পডুয়াদের জন্য আয়োজন। মনে হয় কারণ, শিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটি জানাচ্ছে দেশের ৭৭ শতাংশ স্কুল পড়ুয়ার কাছে মোবাইল ফোনের সুবিধাটুকুও নেই।
নয়া শিক্ষা নীতিতে পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটানোর কোনও কথাই বলা হয়নি। জাতীয় শিক্ষা মিশনের আর্থিক সংগতি দু’বছর আগে যা ছিল তার চেয়েও কম। শিক্ষকদের শূন্য পদ পূরণের পরিবর্তে বিদ্যাঞ্জলি প্রকল্পের অধীন স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে শিক্ষকতার কাজ করানোর কথা বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর গরিব কল্যাণ যোজনায় বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর দ্বিগুণ অর্থ কর্পোরেটের কর ছাড়ের জন্য খরচ করা হচ্ছে।
এ-সবের পরেও যদি কেউ বলেন, অতিধনীরা যদি কর-এ ছাড় পায় তবে সে-অর্থ ঘুরে ফিরে অর্থনীতিকেই মজবুত করবে। কিন্তু মুশকিল হল, অতিধনী ব্যক্তি যদি কর ছাড়ের অর্থে ইমপোর্টেড বিএমডব্লু কেনেন কিংবা সেই টাকায় বিদেশে ঘুরতে যান, তাতে আর যা-ই হোক, দেশের গরিবের (Poor People) নগদ অর্থের চাহিদা মিটবে না। বরং পাঁচ টাকা দামের বিস্কুটের প্যাকেট দেশ জুড়ে যদি বেশি বিক্রি হত, তাতে গরিবের উপকার হত, দেশের কর্মসংস্থান বাড়ত। এই সাদামাঠা কথাগুলো ভাবার বা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার কোনও দরকার আছে কি !