একজন সেদিনের বাংলা রুপোলি পর্দার ফার্স্ট লেডি কানন দেবী অপরজন হলেন এদিনের টলিউডের ফার্স্ট লেডি অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় । তিনি একজন স্বতন্ত্র নারী । সেদিনের কানন দেবীর মতোই তিনি অসমান্য প্রতিভার অধিকারি গায়িকা, নায়িকা ,নৃত্যশিল্পী এবং ট্রেন্ড সেটার। বয়স তখন তাঁর পাঁচ কি ছয় সেই সময় থেকেই তাঁর নৃত্য,সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ শুরু। পাশাপাশি ছিল আবৃত্তিরও। আসলে একমাত্র সন্তান তাই তাকে সবকিছুতে শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তোলার একটা স্পৃহা কাজ করেছিল বাবা মার মনে। মেয়ের মধ্যেও সেই খিদেটা জাগিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁরা। খুব ছোট বয়সে কেন শিখছি ,কিসের জন্য শিখছি সেই চেতনা বিকাশ না ঘটলেও ক্রমাগত এই শিখতে থাকা, তালিম নেওয়া যেন তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
আরও পড়ুন- ভারতীয় চলচ্চিত্রে নায়িকাদের মধ্যে প্রথম গায়িকা ছিলেন এই অভিনেত্রী
বাবা ছিলেন একাধারে চাটার্ড অ্যাকাউনটেন্ট, ব্যাঙ্ককর্মী,শিক্ষক তাই বাবার কাছে প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্রটাই প্রাধান্য পেত সব সময় ।কিন্তু মা এর চাওয়া ছিল অন্য। যদিও বাবা বাধা দেননি কোনও কিছুতেই। মা খুব ভাল গান গাইতেন,গিটার বাজাতেন । দিদা যেমন গান গাইতেন , তেমনই তাঁর হাতের কাজও ছিল দুর্দান্ত । মাও দিদার সঙ্গে শৈশবের সব অবসর গুলো হয়ে উঠতো শিল্পসুষমায় ভরা।
অর্পিতার বড় হয়ে ওঠা হাওড়া জেলায় ।তখন খুব লোডশেডিং হত । আর লোডশেডিং মানেই পড়াশুনোর ছুটি । লন্ঠনের আলোয় দিদা আর নাতনি অবসর যাপনের মূল উপকরনই ছিল গান। কানন দেবীকে ,কেএল সাইগলকে তখনই চিনে ফেলেছিলেন অর্পিতা গানের মধ্যে দিয়েই। আরও কত পুরনো নামজাদা সঙ্গীত শিল্পীর গান নিয়ে কেটে যেত তাঁদের বেশ কয়েক ঘন্টা । এমন শৈশব বুঝি সব মেয়েদের হয়না। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হলেও পুতুল খেলা, মাঠে দৌড়নো ,খেলনাবাটি কোনকিছুই আকর্ষণ করতনা তাকে। ডানপিটে বরাবর।ছক ভাঙ্গার চেষ্টা তাঁর ছোট্ট থেকেই , তাই বড় হয়ে তিনি আলাদাই হলেন সবার চেয়ে ।
আরও পড়ুন- Tripura: এবার অভিষেক, ব্রাত্য সহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ‘ভয় পেয়েছে বিজেপি’ বললেন কুণাল
নাচের গুরু থাঙ্কমণি কুট্টি ,গানের গুরু শম্ভুনাথ মুখোপাধ্যায়ে,অরুণ ভাদুড়ী এবং শিপ্রা বসু।ভরতনাট্যম আর ক্লাসিকাল ঘরানার সঙ্গীতের তালিম সঙ্গে আবৃত্তি। শুধু তালিম নিয়েই শেষ নয় বহু বহু প্রতিযোগিতায় সচ্ছন্দে অংশগ্রহণ করেছেন অর্পিতা। মায়ের সঙ্গে ডোভারলেন মিউজিক কনফারেন্স, রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমি , নেহেরু চিল্ড্রেন মিউজিয়াম এ বিভিন্ন নাচ ও গানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন।এর পাশাপাশি রেডিওতে গান ও আবৃত্তির প্রচুর প্রোগ্রাম করেছেন। দূরদর্শনে সেই সময়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হরেকরকম্বা ,চিচিংফাঁকেও অংশগ্রহণ করেছেন ।কোনও প্রতিযোগিতায় প্রথম ,দ্বিতীয় তৃতীয় ছাড়া বড় একটা কিছু হননি। জীবনের পথে চলতে গেলে যে প্রতিযোগিতা মূলক মনোভাব ও পেশাদারিত্ব প্রয়োজন সেটা তার মধ্যে এসেছিল এইভাবেই।
আরও পড়ুন- অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠছেন সাধন পাণ্ডে, কথা বলছেন ইশারায়
তারঁ অভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা বাহুল্য। তিনি যে একজন দক্ষ অভিনেত্রী এই কথা কে না জানে। কিন্তু অভিনয়ের কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা কোনওদিন। যদিও নাচের মধ্যেও যে একটা অভিনয়ের যোগসূত্র রয়েছে সেটা অর্পিতা নিজেও মানেন। আর গান জানাটা অভিনয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণ অঙ্গ। আবৃত্তি হল ঊচ্চারণের স্পষ্টতা। বলা যেতে পারে এগুলোই হয়ত তাকে অভিনয় সাবলীল হতে সাহায্য করেছে বেশ কিছুটা । অন্তর্নিহিত প্রতিভা তো ছিলই।
৯৭ সালে কলকাতা তিলোত্তমায় অংশগ্রহণ করেন। এর আগে মডেলিং করেছেন চুটিয়ে।তিলোত্তমায় অংশ নেওয়া সেই সুবাদেই। গুণের সঙ্গে অসামান্যা রূপসী ছিলেন তিনি। তিলোত্তমা হলেন ।যেটা টেলিভিশনে টেলিকাস্ট হল ।ব্যস আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নামী পরিচালক প্রভাত রায় এর ‘তুমি এলে তাই ‘ ছবিতে ডেবিউ । একই সঙ্গে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘অসুখ ‘ ছবিতেও অফার পান।এরপর দেবা,দেবদাস, প্রেমশক্তি,প্রতারক ,দাদাঠাকুর,ঋতুপর্ণ ঘোষের উৎসব ও আরও অনেক ছবিতে অভিনয় করেন। বিয়ের পর ৬ বছর সন্তানের জন্য তাকে বিরতি নিতে হয়। ওই সময়টাতেও থেমে থাকেননি। নিজের পরিবারের প্রোডাকশন হাউজ ‘আইডিয়াজ’ এর হয়ে কাজ শুরু করেন। বহু নামি চ্যানেলের জন্য ফিকশন করেন।’আইডিয়াজ ‘ তার হাত ধরেই আবার নতুন করে প্রতিষ্ঠা পায়। এখান থেকেই তার নিজেকে আবার নতুন করে চেনা।
আরও পড়ুন- বিপ্লব দেব প্রশাসনকে তীব্র আক্রমণ পরিবহন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের
এরপর নিজের কোম্পানি খোলবার পরিকল্পনা। দিল্লীতে শুরু করেন নতুন কোম্পানি মাইডিয়া ১০০।অভিনয় ফিরে আসেন অভীক মুখোপাধ্যায়ের ‘একটি তারার খোঁজে ‘ ছবির মাধ্যমে। অনেক ভাল ভাল ছবি তার ঝুলিতে যার মধ্যে অন্যতম হল চিত্রকর, শব , অব্যক্ত,বরুণবাবুর বন্ধুরা, বহমান,হবু চন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী, গুলদস্তা ইত্যাদি।
বিরাট স্ট্রাগল তাকে করতে হয়নি কারণ অর্পিতা নিজে মনে করেন আর্থিক প্রয়োজনের জন্য তিনি এই পেশায় আসেননি ফলে কম্প্রোমাইজ করতে হয়নি কখনও। মা -বাবার স্বপ্ন পূরণ এবং সব সময়ই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার খিদেটাই তাকে এই জগতে টিকে থাকতে এবং সফল হতে সাহায্য করেছে। সহযোগিতা যেমন পেয়েছেন আবার সমালোচনাও শুনতে হয়েছে কখনও কখনও ।
নাম্বার ওয়ান হওয়ার দৌড়ে সামিল হতে চাননি অর্পিতা কোনও দিন। শুধু কাজটা মন দিয়ে করে যেতে হবে এটাই ছিল জীবনের আসল লক্ষ্য। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রায়োরিটি অনুযায়ী নিজের দায়িত্ব গুলো এক এক করে সাফল্যর সঙ্গে পালন করেছেন। ঠিক যেমন নতুন করে গানের জগতে ফিরছেন তিনি একাঙ্ক নাটক’ গহরজান ‘ এর মাধ্যমে। প্রথমবার লকডাউনের সময়ই এর পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে পড়ায় মঞ্চস্থ করা যায়নি। এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ তাঁর কাছে। অনস্টেজ লাইভ এই নাটক যা খুব শীঘ্রই দেখা যাবে। তিনি মনে করেন অভিনয়েরও রেওয়াজ প্রয়োজন তাই থিয়েটারও করেছেন। তার নতুন ছবি ‘আবার বছর কুড়ি পর’ শীঘ্রই রিলিজ করবে। একটা নিপাট বন্ধুত্বের ছবি। চরিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্টই তাঁর পছন্দ।মৌলিক ভাবনা ও একটা সামাজিক বার্তা থাকবে এমন ছবি করতে চান আগামী দিনে।এ যুগের মেয়েদের আইকন তিনি । তাই তিনি মনে করেন এই সমাজের সর্বস্তরের মেয়েদেরই আর্থিক সাবলম্বী হওয়া ভীষণ জরুরী।