সুইস ব্যাঙ্ক। ১৮ জুন, ২০২১ সালে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের জমা রাখা টাকার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। প্রায় সমস্ত প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে যে, ২০১৯-এর শেষে সুইস ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের গচ্ছিত রাখা টাকার পরিমাণ যেখানে ছিল ৬,৬২৫ কোটি টাকা, সেখানে ২০২০-র শেষে তা বেড়ে হয়েছে ২০,৭০০ কোটি টাকা। বিগত ১৩ বছরে সুইস ব্যাঙ্কে টাকা জমা রাখার পরিমাণ এটাই সর্বোচ্চ।
এখন প্রশ্ন, সামর্থ্যবান ভারতীয়রা কেনই বা সুইস ব্যাঙ্কের ওপর এত অতিরিক্ত পরিমাণে নির্ভরশীল? এর মূল দুটো কারণ হচ্ছে, সুইজারল্যান্ডের ব্যঙ্কিং আইনের প্রতি ভরসা এবং একই সঙ্গে ভারতীয় অর্থনীতির এই দুরবস্থা। চলুন, এবার বিস্তারিতভাবে বুঝে নিই।
আরও পড়ুন-বিপ্লব দেব প্রশাসনকে তীব্র আক্রমণ পরিবহন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের
একজন সুইস ব্যাঙ্কার তাঁর গ্রাহকের কোনও তথ্য কাউকে দিতে বাধ্য নন। এটা রীতিমতো নীতি এবং আইনবিরুদ্ধ। কোনও ব্যাঙ্কার যদি গ্রাহকের ন্যূনতম তথ্য ফাঁস করেন, তবে আইনত তাঁর জেল ও জরিমানা উভয়ই হতে পারে। ঠিক এই কারণেই সুইজারল্যান্ড হয়ে উঠেছে বিশ্বের ব্যাঙ্কিং পরিষেবার এক বড় কেন্দ্র। তিনশোর উপরে ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক পরিষেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে। উল্লেখযোগ্য, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি ব্যাঙ্ক হচ্ছে ক্রেডিট সুইস এবং ইউবিএস।
অবশ্য, সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে সুইস ব্যাঙ্কগুলো তাদের গ্রাহকদের পরিচয় প্রকাশে বাধ্য, সেই অপরাধ সুইজারল্যান্ডেই হোক, আর অন্য কোনও দেশেই হোক।
রমরমা ব্যবসার যুগে সুইস ব্যাঙ্কগুলোর সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। কিন্তু ইদানীং আরও চাপ বাড়তে থাকায় কমতে থাকে ব্যাঙ্কের সংখ্যা। যেমন ১৯৯৬ সালে সুইস ব্যাঙ্কের সংখ্যা ছিল ৪০৩টি, ২০১৯ সালে তা কমে হয়েছে ১৫৭টি। আইন ভঙ্গ বা অনিয়মের জন্য এখন পর্যন্ত ৮৫টি সুইস ব্যাঙ্ককে ৫৫০ কোটি ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কের একটি ইউবিএস ২০০৯ সালে জরিমানা দেয় ৭৮ কোটি ডলার এবং আরেক বড় ব্যাঙ্ক ক্রেডিট সুইস ২০১৪ সালে জরিমানা দেয় ২৬০ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাপী সম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও সুইস ব্যাঙ্কের অংশ কমেছে। তবুও সুইস ব্যাঙ্কের বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন-ককটেল টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি DCGI-এর
যে অর্থ বিদেশে যায়, তার বেশিরভাগই অপ্রদর্শিত বা দুর্নীতির। অর্থ অবশ্য আরেকভাবেও যায়। সেটা হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে, বিশেষ করে আমদানি রফতানির মাধ্যমে। এসব উপায়ে যে টাকা পাচার হয়ে গেছে, সেটা কিন্তু সুইস ব্যাঙ্ক এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির রিপোর্টের মধ্যেও পরিষ্কার।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চাপের কারণে সুইস ব্যাঙ্কগুলো এখন বেশি নজর দিচ্ছে উঠতি অর্থনীতির দেশগুলোর প্রতি। বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলো তাদের বিশেষ নজরে রয়েছে। অথচ টাকা পাচার ঠেকানোর কোনও পদ্ধতি ভারতে নেই, উদ্যোগও নেই। সুতরাং সুইস ব্যাঙ্ক যতই জৌলুস হারাক, পাচারকারীদের অর্থ পাচারের সুযোগ ও জায়গার অভাব হবে না। অতএব, ভারত থেকে টাকা যে সুইস ব্যাঙ্কগুলোতেই যাবে – এ আর এমন কী অস্বাভাবিক ব্যাপার!
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকাশ ভারতে সুইস ব্যাঙ্কের যে সব শাখা রয়েছে, তাদের ব্যবসা বেড়েছে, ভারতীয় এবং সুইস ব্যাঙ্কগুলির নিজেদের মধ্যে লেনদেন বেড়েছে, এবং সুইজারল্যান্ডের কোম্পানিগুলির যে সহযোগী সংস্থাগুলি ভারতে রয়েছে, তাদেরও পুঁজি বেড়েছে। আর এ থেকেই স্পষ্ট যে বেশ কিছুসংখ্যক ভারতীয় সুইস ব্যাঙ্কগুলোকেই এখনও প্রাধান্য দিচ্ছেন।
এদিকে ভারতীয় অর্থনীতি প্রায় ধ্বংসের পথে। গত দু’বছর ধরে প্রতিটা ত্রৈমাসিকেই ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমেছে। বিনিয়োগ যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে রফতানি। অর্থনীতির মূল অভিমুখটা ছিল অনেকদিন ধরেই নিম্নগামী। তার ওপরে লকডাউন- বলা চলে, পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে কড়া লকডাউন হয়েছে। তার প্রভাব কোভিড সংক্রমিতের সংখ্যায় খুব একটা দেখা না গেলেও কিন্তু অর্থনীতির একেবারে যাকে বলে বারোটা বেজে গেছে।
আরও পড়ুন-Tripura: এবার অভিষেক, ব্রাত্য সহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ‘ভয় পেয়েছে বিজেপি’ বললেন কুণাল
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউন শুরুর পর তিন মাসে জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন সঙ্কুচিত হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ যা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
উৎপাদন, নির্মাণ, হোটেল, পরিবহণ, আবাসন-সহ অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই সঙ্কোচন দেখা গেছে। এপ্রিল থেকে জুন — এই তিন মাসের জিডিপি-র সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে কৃষি ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই সঙ্কোচন হয়েছে অর্থনীতির।
বিমুদ্রাকরণ ও জিএসটির মতো ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক নীতি ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। সঙ্গে রয়েছে বিজয় মালিয়া, মেহুল চোক্সি, নীরব মোদি কেস, যারা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাঙ্ক জালিয়াতি করে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে বিদেশে পালিয়েছে। কত ব্যাঙ্ক যে লালবাতি জ্বালিয়েছে এদের জন্য, তার ইয়ত্তা নেই। তার ওপর আবার সম্প্রতি কেন্দ্র সরকার ব্যাঙ্কগুলো থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস তুলে নিতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, সুইস ব্যাঙ্কের টাকা ফেরত আনবেন। দেশের অর্থনীতি যখন এত দুর্বল, আজ দেশ যখন লড়াই করছে এমন প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তখন কোথায় নরেন্দ্র মোদির সেই প্রতিশ্রুতি? বোঝাই যাচ্ছে তা ছিল শুধু ভোটের রাজনীতি। ২০১৪-র নির্বাচনের আগে মোদি সরকার বলেছিল সুইস অ্যাকাউন্টে কালো টাকা ভারতে ফেরত আনার কথা। আজও সেই বিষয়ে কোনও উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অনুরাগ সিং ঠাকুর বলেছিলেন, ‘‘আয়কর বিভাগ কালো টাকা (অপ্রকাশিত বৈদেশিক আয় ও সম্পদ) এবং ইমপোজেশন অফ ট্যাক্স অ্যাক্ট, ২০১৫-র অধীনে ধারাবাহিক এবং সমন্বিত পদক্ষেপ নিয়েছে, যেহেতু এই আইন ১ জুলাই ২০১৫ থেকে কার্যকর হয়েছে।’’ কিন্তু এর পর দেশবাসী আর কোনও পদক্ষেপ দেখতে পায় না। অমিত শাহ একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট বলেই দিয়েছেন, কালো টাকা ফেরত এনে আম জনতার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়ার কথা একটি বিশুদ্ধ ‘জুমলা’। নির্বাচনী প্রচারে ওরকম মিথ্যা ভাষণ একটু-আধটু নাকি চলে, আর সাধারণ মানুষও নাকি সেটা জানে। তারাও নাকি এসব প্রতিশ্রুতি সিরিয়াসলি নেয় না।
এই কথাতেই স্পষ্ট, কালো টাকা ফেরত আনার ব্যাপারে মোদি সরকার কতটা সিরিয়াস।