কথাকলি ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্তের এক সুপ্রাচীন নৃত্যশৈলী। যা খুবই মৌলিক , পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় সাধ্য একটি শিল্পকলা।সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল এটি পুরুষ প্রধান নৃত্যশৈলী। কিন্তু এই রকম একটি মৌলিক ও পরিশ্রম সাধ্য শিল্পকলার শিল্পী যখন একজন নারী হন তখন এটাও আরও মৌলিকতম বিষয় হয়ে যায়। আজকে যিনি একক কৃতিত্বের হকদার সেই রম্যাণি রায় যখন এই শিল্পকলায় এসছেন তখন এদেশে কোনও মহিলা কথাকলি শিল্পী কেউ ছিলেন কী না তা বড় একটা কানে আসেনি। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে রম্যাণীর আগে কোনও মহিলা কথাকলি শিল্পী ছিল না। এটি তাঁর লোকসমক্ষে উঠে আসার আরও বড় কারণ।
কথাকলি যে কোনও নৃত্যকলা নয় তা জানা গেল রম্যাণির মুখ থেকেই।এটা আসলে নাট্যকলা বা ডান্স থিয়েটার। কথা অর্থাৎ গল্প ,কলি অর্থাৎ সংস্কৃতে যার অর্থ অভিনয়।তাহলে বিষয়টা হল সেই গল্পকে মুখাভিনয় এবং হস্তমুদ্রার সাহায্যে নাটকের স্লটে অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপন।
কথাকলি নৃত্যে একজন মহিলার প্রথম পদক্ষেপ খুব সহজ ছিলনা। কারণ এই নৃত্যের সবটাই মৌলিক। প্রসাধন থেকে শুরু করে কস্টিউম।
মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে রম্যাণির মমতাশঙ্কর ডান্স ট্রুপে নৃত্যশিক্ষার সূচনা। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রম্যাণির নৃত্যশিক্ষার তখন ছিল শুধুইআর পাঁচটা স্কুল পড়ুয়ার মতোই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি। কিন্তু ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করে নাচ ছাড়া সে অসম্পূর্ণ। এই স্বপ্ন কে পূর্ণতা দেওয়া ও তারই কর্তব্য। মর্ণিং শিফটে কলেজ পড়াশুনো আর দুপুরে রির্হাসাল সঙ্গে পারফরম্যান্স। কিন্তু খিদে যেন মিটছিলনা। সংঘবদ্ধ নৃত্য নয় একক নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন রম্যাণি।স্পৃহা ছিল ছক ভেঙে বেরনোর। সেই স্পৃহা থেকেই ভরতনাট্যমের প্রশিক্ষণ শুরু। গুরু আর শিক্ষক হিসেবে পেলেন কলামন্ডলমের ভি আর ভেঙ্কট আর তাঁর স্ত্রীকে। ভি আর ভেঙ্কট নিজে একজন কথাকলি শিল্পী। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই কথাকলি নিয়ে মাস্টার্স করলেন তিনি।
কিন্তু কথাকলিশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা বা তাঁকে পেশায় পরিণত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। পেশাগত অনিশ্চয়তা ছাড়াও এর খরচ ছিল আকাশচুম্বি। কারণ কথাকলির যে কস্টিউম তার ন্যূনতম দাম হল একলক্ষ থেকে দেড়লক্ষ টাকা। এই পোশাকের সঙ্গে যে আভূষণ পরা হয় তা কেরলের একটিমাত্র পরিবারই তৈরি করে। অর্ডার দিলে যা হাতে আসতে সময় লাগে সাত – আটমাস।কাঠের উপর খোদাই করে ফয়েলের কাপড় ,সেমি প্রেশাস স্টোন আরও নানা উপকরণে তৈরি হয় অর্ণামেন্টস। কাজেই একপ্রকার অসম্ভব ছিল এই পোশাক কেনা। কিন্তু হাল ছাড়েননি রম্যাণি। স্কুলে চাকরি করে অল্প অল্প অর্থ সঞ্চয় করতে থাকে পাশাপাশি মিনিস্ট্রি অফ কালচার থেকে ফেলোশিপ পেলেন। সেখান থেকে টাকা জমা কস্টিউম কিনে ফেলেন।
কিন্তু পোশাক কেনার পর বুঝলেন সমস্যা এখানেই শেষ নয়। কথাকলির প্রসাধন শিখতে হলে প্রসাধন শিল্পীদের সময় লাগে সাত থেকে দশ বছর।কারণ চরিত্র অনুযায়ী ভেবে ভেবে মেকআপ করতে হয় যা খুবই কঠিন।আর এই মেকআপ এর পরিকাঠামো কলকাতায় নেই তাই মেকআপ আর্টিস্ট পাওয়া দুরূহ।ফলে এটাও রম্যাণিকেই শিখতে হবে।কথাকলিতে সত্ত্ব ,রজঃ ,তম এই তিন গুনে উপর আধারিত হয়ে চরিত্রগুলোর আলাদা আলাদা মেকআপ হয়
সেই অসাধ্য সাধনও করে রম্যাণি। সবশেষ ঘাটটা ছিল সবচেয়ে কঠিনতম। তা হল কস্টিউমের ওজন। পোশাকের ওজন প্রায় ৩৫ কেজি আর মাথার মুকুটের ওজন প্রায় আট থেকে দশ কেজি।এই পরিমাণ ওজনের ভার বহন করা কোনও মহিলার পক্ষে অসম্ভব ছিল।কিন্তু অদম্য জেদ , আত্মবিশ্বাস ,ভালবাসা তাকে সব বাঁধা পার করে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মহিলা কথাকলি শিল্পীর পরিচিতি দেয়। দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশেও তার পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। শুরু করেছেন ‘প্রয়াস’ নামক সংস্থা যেখানে শুধু ছাত্র নয় ছাত্রীরাও শিখছে কথাকলি। করোনা অতিমারিতেও থেমে থাকেনি তার পারফরম্যান্স। ডিজিটাল শো করেছেন বহু সংস্থার হয়ে।