বিশ্ব জুড়ে যে ঐতিহ্যের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে তা আমাদের কাছে এখনও অপার বিস্ময় জাগায়। মুগ্ধতার মাপকাঠিতে বড়-ছোট বিচার করা যথেষ্ট কঠিন। ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপত্য, ভাস্কর্য, নিদর্শনগুলি ইতিহাসকে জানার এবং নতুন করে খোঁজার স্পৃহাকে টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের কলকাতা শহরেও রয়েছে একগুচ্ছ ঐতিহ্যশালী স্থাপত্যের সম্ভার, আজ রইল
রাজভবন-এর কথা…
১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ শাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর থেকে এই ভবনটি ভারতের ভাইসরয়ের সরকারি বাসভবনে পরিণত হয়। এর আগে ভাইসরয়ের বাসভবন ছিল বেলভেদরে স্টেট। ১৯১১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের সরকারি বাসভবনে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এটি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের সরকারী বাসভবন হিসাবে কাজ করে এবং তারপর থেকে এটি ‘রাজভবন’ (Raj Bhavan) নামে পরিচিত হয়। অন্যান্য রাজ্যের রাজ্যপালদের সরকারি আবাসনকেও একই নামে অভিহিত করা হয়।
আরও পড়ুন – বিজেপির হয়ে এবার এনআইএ
১৭৯৯ সালের আগে গভর্নর-জেনারেল ওই স্থানে অবস্থিত ‘বাকিংহাম হাউস’ ভাড়া নিয়ে থাকতেন। বর্তমান রাজভবনের পুরো জমিটি ছিল চিৎপুরের নবাব মোহাম্মদ রেজা খানের অধীনে। ১৭৯৯ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল, মার্কেস ওয়েলেসলি একটি প্রাসাদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ভারতকে শাসনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের এ দেশের প্রধান প্রতিনিধির জন্য একটি আলাদা প্রাসাদসম বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা থেকে তিনি এই ভবনের নির্মাণকাজে ব্রতী হন। লর্ড ওয়েলেসলি পুরো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতার স্থাপত্য রূপ দিতে এই বিশালাকার প্রাসাদ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
১৭৯৯ সালে এই ভবনের নির্মাণ কাজশুরু হয়, শেষ হতে সময় লাগে প্রায় চার বছর, ১৮০৩ পর্যন্ত। ক্যাপ্টেন চার্লস ওয়াইট হলেন এই ভবনের ডিজাইনার। কার্জনের পারিবারিক প্রাসাদ ডার্বিশায়ারের কেডলেস্টন হলের আদলে ভবনটি স্বতন্ত্র বারোক ওভারটোন সহ একটি নিওক্লাসিক্যাল শৈলী অনুসরণ করে নির্মিত হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে, এটির নির্মাণ শুরু হওয়ার ১০০ বছর পরে, কার্জন পরিবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান পুত্র, জর্জ নাথানিয়েল কার্জন ভারতের ভাইসরয় হিসাবে রাজভবনে ছিলেন। শোনা যায়, লর্ড কার্জন একবার গভর্নমেন্ট হাউসকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, “নিঃসন্দেহে বিশ্বের যে কোনও সার্বভৌম বা সরকারের প্রতিনিধি দ্বারা দখলকৃত সেরা সরকারি ভবন এটি।” ১৮৬০ সালে ভাইসরয় লর্ড এলগিন এই ভবনে প্রথম ধাতব গম্বুজ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে লর্ড কার্জন এই বিল্ডিংয়ে ইলেক্ট্রিসিটি এবং লিফট লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
রাজভবন (Raj Bhavan) মোট ৭,৮০০ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এবং প্রায় ১১ হেক্টর একটি প্রাঙ্গণ দ্বারা বেষ্টিত। রাজভবনের ছয়টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি করে। পূর্ব ও পশ্চিম দিকের চারটি ফটকের উপরে সিংহের খিলান অবস্থিত। রাজভবনের সর্বোত্তম ভিউ উত্তর গেট থেকে পাওয়া যায় যেটি প্রধান ফটক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এই গেট দিয়ে প্রবেশ করে সামনে একটি সুসজ্জিত চিনা কামান রয়েছে, ১৮৪২ সালে চিনের নানকিং থেকে একটি ড্রাগনের উপর বসানো ছোট এই কামানটি আনা হয়েছিল। তিনতলা বিশিষ্ট ভবনের মাঝখানে একটি বিশাল সেন্ট্রাল এরিয়া রয়েছে। এছাড়াও রাজভবনে পাবলিক হল, বারান্দা, ব্যাঙ্কোয়েট হল এবং সিংহাসন কক্ষ ছাড়াও মোট ৬০টি কক্ষ রয়েছে।
আবাসনের অংশটি চারটি স্যুটে বিভক্ত। প্রথম তলার উত্তর-পশ্চিম শাখায় ‘প্রিন্স অফ ওয়েলস স্যুট’ যেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিদর্শন করার সময় থাকেন। ওয়েলেসলি স্যুটটি উত্তর-পূর্ব শাখার দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত, ডাফরিন স্যুটটি উত্তর-পশ্চিম শাখার দ্বিতীয় তলায় এবং চতুর্থ স্যুটটি অ্যান্ডারসন স্যুট। রাজ্যের প্রাক্তন গভর্নর কেশরীনাথ ত্রিপাঠী অবশ্য এই স্যুটগুলির নাম ভারতীয় নামে পরিবর্তন করেছেন, যেমন: প্রিন্স অফ ওয়েলস স্যুট থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কক্ষ, ওয়েলেসলি স্যুট থেকে বিদ্যাসাগর কক্ষ, ডাফরিন স্যুট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা কক্ষ এবং অ্যান্ডারসন স্যুট থেকে বিবেকানন্দ কক্ষ।